আগামিকাল আকাদেমিতে মঞ্চস্থ হতে চলেছে ম্যুরে সিসগালের লেখা নাটক ‘টাইপিস্ট’। নাট্য রূপান্তর করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং। শ্রুতি নাটক হিসেবে বহুবার পাঠও করেছিলেন তিনি ‘টাইপিস্ট’। পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনা ও নির্দেশনায় এবার তা মঞ্চস্থ হতে চলেছে। অভিনয়ে দেবশঙ্কর হালদার ও পৌলমী নিজে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়
আরও পড়ুন-Chandannagar lighting: চন্দননগর জুড়ে আলোর জাদু
‘‘আসলে পরিকল্পনাটা ছিল বহুদিনের। বাপি তখন ভীষণভাবে আছে আমাদের মধ্যেই। অনুবাদ না করে ‘টাইপিস্ট’-এর নাট্য রূপান্তর করেছিল বাপি আর শুধু শ্রুতি নাটক হবে তেমন নির্দিষ্ট কোনও ভাবনাও ছিল না কখনও। বাপি নিজে বেশ কয়েকবার নাটকটি পাঠ করেছিল, আমিও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে পাঠ করেছিলাম একবার। এরপর প্রথম যখন ভেবেছিলাম ‘টাইপিস্ট’ মঞ্চে আনব তখন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে।
ঠিক ছিল ও আর আমি করব। বার দুয়েক দু’জনে রিহার্সালও দিয়েছিলাম কিন্তু আর এগোয়নি। তারপর আরও কয়েকবার উদ্যোগী হলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। শেষ অবধি দেবশঙ্কর ও আমি যে কাজটা করতে পারছি এটাই সবচেয়ে আনন্দের।’’ পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় রিহার্সালের ক্লান্তি ছাপিয়ে খুশি বেশি।
আরও পড়ুন-Parking Plaza: কলকাতায় পাঁচ বহুতল পার্কিং প্লাজা
‘টাইপিস্ট’ যে পিতা-পুত্রী দু’জনকেই এত আকৃষ্ট করেছে তার কারণ এর বিষয়। ভীষণ সাধারণ দু’জন মানুষের জীবনের গল্প বলে ‘টাইপিস্ট’। ঠিক যেভাবে এমন সাধারণ মানুষেরা জীবন শুরুর সময়ে অনেক স্বপ্ন লালন করে, আশা রাখে একদিন সেসব সাকার হবে, কিন্তু দিন যায়, জীবন এগোয়, আর সে এগোনো আটকা পড়ে গতানুগতিকতার ছকে, নিত্যকার অভ্যেসে, অবধারিত বাধ্যবাধকতায়। জীবনবৃত্ত সময়ের হাত ধরে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে, কিন্তু স্বপ্নগুলো থেমে থাকে এক জায়গায়, উদ্যোগ ফিকে হতে থাকে, উচ্চাশারা ফসিল হতে থাকে আর এই অনিবার্য পরিণতিকে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি থাকে না মানুষের। অনিরুদ্ধ হালদার আর ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত এই এরকমই দুজন মানুষ। ধর্মতলার যে কোনও সাধারণ অফিসে সাধারণ দু’জন টাইপিস্ট তারা। পরস্পরের সঙ্গে বিশেষ কোনও সম্পর্কে ছিল না তারা কিন্তু সময় ও জীবন তাদের একই পথের সহমর্মী পথিক করে তোলে।
এক ঘণ্টা দশ মিনিটের এই নাটকে এভাবেই অনিরুদ্ধ ও ইন্দ্রাণী আমাদের ভীষণ চেনা জীবনটা নিজেদের জীবন দিয়ে তুলে ধরবে। এই স্বল্প পরিসরেই ধরা পড়বে দু’জনের জীবনের অনেকটা অংশ। তাদের যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব। এই দীর্ঘ সময়ে সহকর্মী থেকে বন্ধু হয়ে ওঠা মানুষদুটোর মনে পরস্পরের জন্য দুর্বলতা তৈরি হলেও সে দুর্বলতাকে বাক্স-বন্দি করতে হয় কারণ কেউই নিজের বৃত্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। সে সুযোগ জীবন তাকে দেয় না। কাজেই আবেগও আক্ষেপ হয়েই রয়ে যায় জীবনভর।
অনিরুদ্ধর চরিত্রে অভিনয় করছেন দেবশঙ্কর হালদার এবং ইন্দ্রাণী-চরিত্রে পৌলমী। দেবশঙ্করকে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে পরিচালক পৌলমী বললেন, ‘‘দেবশঙ্করের অভিনয় ক্ষমতাই প্রথম কারণ। একেবারে ইয়ং এজ থেকে বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় দেবশঙ্করের মতো একজন পাওয়ারফুল অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব করা। সামনে থেকে ওর অভিনয় যখন দেখি, বিস্মিত হয়ে যাই ওর রেঞ্জ দেখে।
এছাড়া আরও একটা কারণ আছে, যার জন্য দেবশঙ্কর আমার কোনও প্রোডাকশনে অভিনয় করলে আমি ভীষণ নিশ্চিন্ত বোধ করি। ও আদ্যপান্ত একজন ভাল মানুষ আর অসম্ভব হেল্পফুল। কোনও ট্যান্ট্রম নেই, স্টারসুলভ আচরণ নেই, যাকে বলে মাটির মানুষ। এরকম একজন মানুষ টিমে থাকলে কাজ অর্ধেক যেন হাল্কা হয়ে যায়।
তাছাড়া আমরা আগেও একসঙ্গে অভিনয় করেছি, তাই সে বোঝাপড়াটাও আছে।’’
একই সুর শোনা গেল ‘অনিরুদ্ধ’ দেবশঙ্কর হালদারের মুখেও। বললেন, ‘‘নাটকটা বহু পুরনো কিন্তু আজও নানা দেশে নানা ভাষায় মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে। এর থেকেই প্রমাণিত এর প্রাসঙ্গিকতা। আসলে এধরনের চরিত্রগুলো খুব সহজে চেনা যায় বলেই এই জাতীয় নাটক এতদিন ধরে থেকে যায়। আমাকে স্বল্প সময়ে চরিত্রটির অনেকগুলো বয়স তুলে ধরতে হয়েছে।
আরও পড়ুন-Bengal BJP: বাংলাকে অশান্ত করছে বিজেপি
চরিত্রটি কখনও খোলামেলা আবার কখনও ঢুকে পড়ে খোলসের মধ্যে। যেমনটা কমবেশি আমরা সকলেই করে থাকি। আবার সমস্যাগুলোও আমাদের সবার খুব চেনা। বাস্তব সমস্যা থেকে তাই কিছু দার্শনিকতা তৈরি হলেও সেই দর্শনের আলোয় মানুষ নিজেকে দেখতে পাবেন বলেই আমার ধারণা। আমার নিজের অন্তত তেমনই বোধ হয়েছে।” পৌলমীর সঙ্গে কাজের প্রসঙ্গে দেবশঙ্করও বেশ খোলামেলা। ‘‘এর আগেও পৌলমীর নির্দেশনায় আমি কাজ করেছি, ‘ফেরা’ ও ‘অন্ধযুগ’-এ। ‘ফেরা’তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই ছিলেন আর ‘অন্ধযুগ’-এ ওঁর অভিনীত চরিত্রটিতেই আমি অভিনয় করি। তারপর এই ‘টাইপিস্ট’।
তিনটি নাটকেই পৌলমী নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করে। আর কাজের সূত্রে এভাবেই অভিনেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায়। তবে আমি মনে করি যে কোনও নতুন নাটকেই নতুন বোঝাপড়া তৈরি হতে লাগে। আর সেটা অভিনেতাদের চেয়েও অভিনীত চরিত্রদের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করতে হয়। একটা সফল প্রোডাকশন তবেই তৈরি হয়। এখানেও সেই তত্ত্ব-তালাশই চলছে। দেখা যাক কতটা সফল হই আমরা।’’
আগামিকাল, ১৪ নভেম্বর, সন্ধ্যা ৬.৪৫, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ‘টাইপিস্ট’ প্রথমবার মঞ্চস্থ হবে আকাদেমিতে। মঞ্চসজ্জা বিলু দত্তের, আলো মনোজ প্রসাদ ও মানস মুখার্জির, সংগীত দিশারি চক্রবর্তীর এবং মেক আপ মহম্মদ আলির। এ বছর মার্চে পৌলমী পরিচালিত ‘কোথায় বামদেব’ নাটকটি মাত্র দুটো শো-এর পরেই বন্ধ করে দিতে হয় প্যান্ডেমিক-এর কারণে, ‘টাইপিস্ট’ নিয়ে পৌলমী এবার তাই খুব আশাবাদী।