বিগত একশো বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং হিন্দুত্ববাদী শিবির মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেদের আগ্রাসী মিথ্যা সাম্প্রদায়িক ন্যারেটিভ তৈরি করে চলেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহজেই বিশ্বাসযোগ্য নানারকম মিথ্যা গালগল্প তৈরি করে সেগুলির ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্যান-হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পকে কার্যকরী করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এই ন্যারেটিভের একটি সাধারণ চরিত্র হল এতে প্রায় সাতশো বছর ব্যাপী ইসলামি ও মুঘল শাসনকালে হিন্দুদের উপরে মুসলিম নিপীড়ন, হিন্দু মন্দির ধ্বংস, জবরদস্তি ধর্মান্তরিতকরণের এক অর্ধসত্য ও কাল্পনিক কাহিনি পরিবেশন করা। তারা এই কথা সম্পূর্ণ উহ্য রাখে যে এইমুহূর্তে ভারতে এমন অজস্র মন্দির রয়েছে যেগুলো মুসলিম আমলে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বয়ং আওরঙ্গজেব- সহ বহু মুসলিম নৃপতি হিন্দু মন্দির স্থাপনের জন্য জমি বা অর্থ দিয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে সংঘীদের বাস্তব ধারণা থাকলে তারা বুঝত, বাংলার মাটিতে সেই তেরো শতকের সূচনাকাল থেকে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবাবি আমল শেষ হওয়া অব্দি হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতর এক ব্যাপক সমন্বয়ী ভাবধারা বজায় ছিল। স্থানিক ও বিচ্ছিন্ন সংঘাত পেরিয়ে এই সমন্বয়ী ঐক্যের কারণেই বাংলার মাটিতে সঙ্ঘের প্যান ইন্ডিয়ান হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানি সংস্কৃতির শিকড় আজও ছড়াতে পারেনি।
একটি জাতির সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি তার ধর্মীয়, লৌকিক, সাহিত্যিক নিদর্শনের মধ্যেই ধরা পড়ে। বাংলার সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকলেই বোঝা যাবে, এই ঐতিহ্য এক মূলগত সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাতাবরণ বহন করে চলেছে। খোদ বাঙালি মুসলিম সমাজের মধ্যেও গোঁড়া মৌলবি ও মোল্লাতন্ত্রের কেটে দেওয়া গণ্ডি পেরিয়ে, নিষ্ঠাবান প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি সংস্কৃতির বাইরে মুসলিম সন্ত-সাধকদের প্রথাবিরোধী ধর্মাচরণের শিকড় বাংলায় অনেক বেশি গভীর। এর সাধারণ পরিচয় সুফিধর্ম, যা কোনও প্রথাগত ডক্ট্রিনের তোয়াক্কা করে না। এর মধ্যে মিশে গিয়েছিল ভারতীয় যোগদর্শন, কপিলের সাংখ্যতত্ত্ব। বাংলায় বহুযুগ ব্যাপী লালিত তন্ত্রের সঙ্গেও এই সুফিধর্মের যোগ যথেষ্ট বেশি। এর প্রমাণ ভোজবর্মণের তন্ত্রাচার সম্পর্কিত বই ‘অমৃতকুণ্ড’র আরবি-ফারসি অনুবাদ। ভারতে মধ্যযুগে ৬/৭টি সুফি খানদান প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও বাংলায় তিনটি ধারা— চিশ্তিয়া, মদারিয়া ও সুহরওয়ার্দিয়া দ্রুত উত্তর ভারতীয় সুফি ঘরানা থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে জনসমাজে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বাংলার দরবেশরা দেশীয় ভাবধারাকে আত্মস্থ করে সুফিতত্ত্বের একটি নিজস্ব রূপ গড়ে তোলেন। এরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য পিরবাদ। বাংলার পিরেরা ও তাঁদের শিষ্য ও অনুসারীরা তাঁদের এই নব্য সিলসিলাহ্ প্রচারের জন্য দেশীয় বাংলা ভাষায় অজস্র কাব্য রচনা করেন। সৈয়দ সুলতানের ‘জ্ঞানচৌতিশা’ ও ‘জ্ঞানপ্রদীপ’, শেখ মনসুরের ‘সির্নামা’ বইগুলিতে হিন্দু যোগতত্ত্ব, শিব-শক্তির যুগনদ্ধলীলা, তান্ত্রিক অভিচার, সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব ও বৌদ্ধ সৃষ্টিবাদ মিলেমিশে গেছে। ‘জ্ঞানসাগর’-এ আছে পরকীয়া সাধনার কথা, আছে উলট সাধনের রীতি, যা এসেছে নাথ-বাউলদের কাছ থেকে। অর্থাৎ প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগের এই বিশেষ ধর্মাচার সম্পূর্ণ সমন্বয়ী ভাবধারাকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছিল, যার প্রভাব ছিল বাংলার অগণন মানুষের কাছে।
আরও পড়ুন- সন্দেশখালি চক্রান্ত, নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ তৃণমূলের
এই পর্যায় সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন বলেছেন— “এদেশে ধর্ম লইয়া কোনও মারাত্মক বিবাদ ছিল না— না রাষ্ট্রে না সমাজে না গ্রামে না গোষ্ঠীতে না পরিবারে। বাড়িতে একজন শিবের উপাসক, আর একজন বুদ্ধের ভাবক, তৃতীয় ব্যক্তি বিষ্ণুপূজক— এমন ব্যাপার অসাধারণ ছিল না। রাজা বৌদ্ধ রাণী ব্রাহ্মণ্যমতাশ্রিত—এমনও ছিল। এই কারণে সেকালের পক্ষে সমাজে বৌদ্ধ-জৈন-শৈব-বৈষ্ণব— এমন বিভাগ-কল্পনা ভ্রান্ত”। বাংলার হিন্দু-মুসলমান এক যৌথ সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছিল। দুই সম্প্রদায়ের একত্র বসবাস, শ্রীচৈতন্যদেবের সামাজিক বিপ্লব, বিভিন্ন ধরনের সমন্বয়ধর্মী আন্দোলনের উপস্থিতি, লোকসাহিত্যের বিবিধ আঙ্গিকে, অপ্রধান মঙ্গলকাব্যগুলিতে, পিরের মাহাত্ম্যসূচক পাঁচালিতে ধরা পড়েছে। পিরের দরগায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে শিরনি প্রদান, মুসলমান কবির লেখা অজস্র বৈষ্ণব পদ ও রামায়ণ রচনা, হিন্দু কবির জঙ্গনামা বা রসুলচরিত এই যৌথ ধর্মাচরণের প্রমাণ।
এই মিলিত লোকদেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান সত্যনারায়ণ। তিনি সাধারণ হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই আরাধ্য ছিলেন। ক্রমে তাঁকে পৌরাণিক দেবতার মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। স্কন্দপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণে সত্যনারায়ণ বা সত্যপির জায়গা পান। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কবিরাই তাঁকে নিয়ে কাব্যরচনা করেছেন। ভারতচন্দ্র ও রামেশ্বর ছাড়াও যে কবিরা সত্যনারায়ণকে নিয়ে কাব্য লিখেছেন, তাঁরা হলেন ফকিররাম দাস, তাহির মাহমুদ, কাশীনাথ ভট্টাচার্য সার্বভৌম, ফকির গরিবুল্লাহ, দ্বিজ রঘুনাথ চক্রবর্তী, ওয়াজেদ আলি, লেংটা ফকির, নায়েক ময়াজ গাজি প্রমুখ। বাংলার এই সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে বোঝার মতো মেধা বা বুদ্ধি কোনওটাই উত্তর ভারত থেকে আসা বহিরাগত সংঘের নেতাদের নেই।