গতকাল জি ফাইভে মুক্তি পেয়েছে ‘পাশবালিশ’। কোরক মুর্মু পরিচালিত রোম্যান্টিক থ্রিলার। প্রেম ও রক্তমাখা একটি ভালবাসার গল্প। পিঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এগোতে হয়। শেষপর্যন্ত গেলে বিস্ময় জাগে। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
সিনেমা হিট হয় তারকার জন্য। এটাই প্রচলিত ধারণা। পোস্টারে পছন্দের মুখ দেখে বহু মানুষ সিনেমাহলে ভিড় জমান। ভাল লাগা না-লাগা পরের কথা। নামীদামি তারকাদের পিছনে মোটা অর্থলগ্নি হয়। ছবি হিট হলে মুখে হাসি। উল্টোটা হলে প্রোডিউসারের কপাল পোড়ে। আসলে এ-ও এক ধরনের ফাটকা ব্যবসা। লাগলে ছক্কা, না লাগলে ফক্কা। ছবি সাফল্য পেলে তারকারা থাকেন মাথায়। ফ্লপ হলে মাটিতে।
আরও পড়ুন-নরেন্দ্র দাভোলকর হত্যায় যাবজ্জীবন দুজনের, প্রমাণের অভাবে বেকসুর ৩
তবে ধীরে ধীরে বদল ঘটেছে পরিস্থিতির। মুখ নয়, এখন বিষয়ের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন দর্শকরা। ফলে কিছুটা হলেও কমছে বাজেট। এই যে পরিস্থিতি এবং রুচির বদল, এর পিছনে সিনেমার যতটা না ভূমিকা, তার থেকেও বেশি ভূমিকা ওটিটি প্লাটফর্মের। সেখানে নিয়মিত মুক্তি পাচ্ছে নানান বিষয়ের সিনেমা এবং সিরিজ। তারকাদের সরিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রকৃত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ঘরে বসে, বিছানায় পাশবালিশ জড়িয়ে উৎসাহী দর্শকরা সেগুলো উপভোগ করছেন তারিয়ে তারিয়ে।
পাশবালিশ বলতেই মনে পড়ে গেল, গতকাল জি ফাইভে মুক্তি পেয়েছে একটি সিরিজ। নাম ‘পাশবালিশ’। বেশ কিছুদিন আগেই সামনে এসেছে ট্রেলার। দর্শকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে প্রবল আগ্রহ।
না, এই সিরিজে কোনও তারকা নেই। তবু আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে বিষয়টা। এটা যে একটি রোম্যান্টিক থ্রিলার, বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
আরও পড়ুন-নরেন্দ্র দাভোলকর হত্যায় যাবজ্জীবন দুজনের, প্রমাণের অভাবে বেকসুর ৩
গল্পটা অন্যরকম। পাথরকুঁচি থানার অরিজিৎ সিং চাঁদু ওরফে বাবলাকে নায়ক বলা যেতে পারে। তিনি গেয়ে ওঠেন ‘আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কই গেলা রে’। তাঁর চোখে ভাসে প্রেমিকার মুখ। যাঁর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। এরপর তাঁর এলাকায় আসেন এক নারী, চান্দুর সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা। ফের একবার সম্পর্ক রচিত হয় দুজনের। তবে মেয়েটির বাবার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় বদলে দেয় সমস্তকিছু। খান খান হয়ে যায় স্বপ্নগুলো। হঠাৎ গল্পের মধ্যে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। হামলা হতে থাকে মেয়েটির উপরে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, মেয়েটির গায়ে যে-ই হাত তোলে, সে-ই খুন হয়ে যায়। কীভাবে হয় একটার পর একটা খুন? সেই রহস্যের উন্মোচন করতে আসরে নামেন পুলিশ ইন্সপেকটর। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ভালবাসা, আবেগ এবং প্রতিশোধ। সবকিছু ছাপিয়ে শেষপর্যন্ত ‘পাশবালিশ’ নির্ভেজাল বন্ধুত্বের গল্প, কাউকে আগলে রাখার গল্প।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল চরিত্র চান্দুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুহাত্রো মুখোপাধ্যায়। তিনি একেবারেই তারকা নন। সু-অভিনেতা। বেশকিছু সিরিজের দৌলতে এই মুহূর্তে তিনি পৌঁছে গেছেন দর্শকদের ঘরে ঘরে। তাঁর অভিনয় বড় বেশি সাবলীল। কোথাও অকারণ রং মাখানোর চেষ্টা করেন না। চান না চটক দেখিয়ে বাজি মেরে বেরিয়ে যেতে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছতে। কাজের মধ্যে লেগে থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এতকিছু বলার কারণ, এই সিরিজে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
চান্দুর প্রেমিকার চরিত্রে দেখা গেছে ইশা সাহাকে। বড়পর্দা, ওটিটি প্লাটফর্মে এখন তিনি নিয়মিত কাজ করছেন। তাঁকেও সেই অর্থে তারকা বলা যায় না। মিষ্টি মুখের এই অভিনেত্রীকে দেখে মনে হয়, যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। চোখে-মুখে লেগে রয়েছে আশ্চর্য মায়া, স্নিগ্ধতা। তাঁর অভিনয় এগিয়ে যায় নদীর গতিতে। খুব স্বাভাবিক ছন্দে। সিরিজে তিনি নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। চরিত্রটি সাহসী, সংবেদনশীল এবং স্বাধীনচেতা মেয়ের।
এ ছাড়াও সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌরভ দাস। তিনি দর্শকদের একজন পছন্দের অভিনেতা। সিরিজে তাঁর চরিত্রের নাম স্বদেশ। পাহাড়বংশী বংশের নেতা। একেবারেই সরলরৈখিক নয়। রয়েছে প্রচুর বাঁক। ওঠানামা। ভাঙচুর। তিনি চিত্রনাট্যের দাবি পূরণ করার চেষ্টা করেছেন যথাযথভাবে।
পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে আছেন ঋষি কৌশিক। রাফ অ্যান্ড টাফ লুকে তাঁকে ফাটাফাটি লেগেছে। সুযোগ কম পেয়েছেন। তবে যতটুকু পেয়েছেন দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
আরও পড়ুন-৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই চাই ভোটের চূড়ান্ত হার: সুপ্রিম কোর্ট
সিরিজটি পরিচালনা করেছেন কোরক মুর্মু। দর্শকরা তাঁর কাজ সম্পর্কে সচেতন। গতবছর ‘জেন্টলম্যান’ পরিচালনা করেছিলেন। সিরিজটি সমাদৃত হয়েছিল। ফলে তাঁর প্রতি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। ‘পাশবালিশ’ দেখে মনে হয়েছে, তিনি নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন। বোঝেন, কতটুকু পারেন এবং কতটুকু পারেন না। টানটান চিত্রনাট্যের অপব্যবহার করেননি। কোনও অংশই ঝুলে গেছে বলে মনে হয় না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ইউনিট নিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গে। শীতের মরশুমে। হইহই করেই সেরেছেন শ্যুটিং। পরিশ্রম যে বৃথা যায়নি সেটা সিরিজ দেখেই বোঝা যায়। সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ। পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই। ততটাই দুর্দান্ত ক্যামেরার কাজ। মোটকথা প্রতিটি বিভাগ নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে।
প্রেম ও রক্ত মাখামাখি ভালবাসার গল্প। পিঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এগোতে হয়। শেষপর্যন্ত গেলে জাগে চরম বিস্ময়। লাগে জবরদস্ত কিক। যাই হোক, একটা কথা জোর দিয়ে বলাই যায়, কাঁড়ি কাঁড়ি সিরিজের ভিড়ে ‘পাশবালিশ’ কিন্তু হারিয়ে যাবে না। সঙ্গীহীনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।