মার্কেটিং বা বিপণন ব্যবস্থাপনার একটা কথা চালু আছে। ‘ব্র্যান্ড প্রোপজিশন’। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনও ব্র্যান্ডের তরফে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবে বলা থাকে, ওই ব্র্যান্ড ব্যবহার করলে ব্যবহারকারী মানুষজন বা ক্রেতাবর্গ কী কী উপকার বা সুবিধা পাবেন, ব্র্যান্ডটির উপযোগিতা কী— এসব। বস্তুতপক্ষে, ক্রেতারা ব্র্যান্ড প্রোপজিশনের ওপর আস্থা রাখলে তবেই কোনও একটি ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে ওঠে। নচেৎ নয়। অন্য কথায়, উপভোক্তার কাছে ব্র্যান্ডের গ্রহণযোগ্যতা মূলত ব্র্যান্ড প্রোপজিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে সমানুপাতিক সম্পর্কে আবদ্ধ।
আরও পড়ুন-এবার তল্লাশি খাড়্গের কপ্টারেও
এই কারণেই ব্র্যান্ড প্রোপজিশন কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। অনেক ভেবে চিন্তে তবে ব্র্যান্ড প্রোপজিশন বানানো হয়। ব্র্যান্ড প্রোপজিশন এক অর্থে প্রতিশ্রুতি। রক্ষা করার সামর্থ্য না থাকলে দেয় প্রতিশ্রুতি অচিরেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। আর যদি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালনের সামর্থ্য ব্র্যান্ডটির থাকে, তবে ব্র্যান্ড প্রোপজিশন বছরের পর পর, এমনকী দশকের পর দশক টিকে থাকে। সেটাকে বদলানোর দরকার পড়ে না।
বিজেপির ব্র্যান্ড প্রোপজিশন স্বল্প সময়ে এতবার বদলেছে যে গ্রাহক অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটদাতাদের কাছে দলটির বিশ্বাসযোগ্যতা আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
১২ জানুয়ারি, ২০২৪-এ বিজেপির তরফে বলা হল, অন্যদের থেকে প্রত্যাশা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকে না কি মোদি গ্যারান্টি শুরু হয়। এই ব্র্যান্ড প্রোপজিশনের ভিত্তিতে দিকে দিকে নির্বাচনের স্লোগান হয়ে গেল ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। ১৪ এপ্রিল, ২০২৪-এ এই আবহেই বিজেপি যে ইস্তেহার প্রকাশ করল, সেটার শিরোনাম রাখা হল ‘মোদি কি গ্যারান্টি’।
আরও পড়ুন-আশীর্বাদ চাইতে এসেছি, ভোট দিন কাজের নিরিখে, রবিবাসরীয় প্রচারে দেবের বার্তা
আর ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ আসতে না আসতেই, আমরা টের পেলাম, মোদি কি গ্যারান্টি চাদর মুড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিজেপির প্রচারে মোদি কি গ্যারান্টি ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করল। আমরা টের পেলাম, মোদি কি গ্যারান্টির কোনও ওয়ারেন্টি নেই। ‘গ্যারান্টি’ পিরিয়ডের মধ্যে ক্রীত পণ্য খারাপ হলে দোকানদার সেটা বদলে দিতে বাধ্য থাকে। কিন্তু ‘ওয়ারেন্টি’ পিরিয়ডের মধ্যে কোনও পণ্য খারাপ হলে দোকানদার স্রেফ সেটাকে সরিয়ে দেয়, বদলে দেওয়ার দায় নেয় না।
মোদি কি গ্যারান্টি যে মাস দুয়েকের মধ্যে তার ওয়ারেন্টি খুইয়ে বসেছে, সেটা একাধিক কারণে প্রমাণিত ও অনুভূত হচ্ছে। এর সপক্ষে কমপক্ষে দশটি প্রমাণ আছে।
বিজেপির ‘মোদি কি গ্যরান্টি’ নামক ইস্তেহারে লেখা আছে, ‘আমরা নারী সম্ভ্রম নিশ্চিত করব’ (We will ensure the dignity of women). কারা এই গ্যারান্টি দিচ্ছে? হাথরাস, উন্নাও, কাঠুয়া, বিলকিস বানো, ব্রিজভূষণ শরণ সিং, প্রাজ্বল রেভান্নার ঘটনাবলির নায়ক এবং সন্দেশখালিতে নারীসম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে যারা, তারা নাকি এই আশ্বাস দিচ্ছে। বিড়াল গ্যারান্টি দিচ্ছে, মাছ খাবে না! মানুষ কি এতই বোকা যে এই প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখবেন? ‘ভঙ্গুর পাঁচ’ দেশের একটি থেকে আমরা বিশ্বের অর্থনীতিতে শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের অন্যতম হয়ে উঠেছি। ‘মোদি কি গ্যারান্টি’তে এত বড় মিথ্যেটা লেখা আছে। দশ বছর আগে ভারতের জিডিপি-র ৭.২ শতাংশ গৃহস্থর আর্থিক সঞ্চয় ছিল। সেই নিরিখে ভারত ছিল বিশ্বের দশটি বৃহত্তম অর্থনীতির অন্যতম। আজ সেখান থেকে পাঁচ ধাপ নেমে এসেছে ভারতীয় অর্থনীতি। আয়-বৈষম্য বাড়তে বাড়তে ব্রিটিশ জমানার আয়-বৈষম্যকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২-২৩-এ জিডিপির মাত্র ৫.১ শতাংশ পারিবারিক আর্থিক সঞ্চয়ের পরিমাণ। আমাদের অর্থনীতি নাকি এগোচ্ছে? কোন দিকে? পেছন দিকে?
‘মোদি কি গ্যারান্টি’তে বলা হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ্ব নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রী জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যকিং ব্যবস্থার অধীনে এসেছে। একদম মিথ্যে কথা। গত বছর ডিসেম্বর মাসেও পাঁচটি জন ধন অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি দুবছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। তার মানে ১০ কোটি ৩৪ লক্ষ অ্যাকাউন্ট কোনওদিন কার্যকর ছিলই না। ওই সমস্ত অ্যাকাউন্টে ১২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা অব্যহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল।
‘মোদি কি গ্যারান্টি’ দাবি করছে চার কোটিরও বেশি পরিবার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ও অন্যান্য প্রকল্পের সুবাদে পাকাবাড়ি পেয়েছে। অথচ গত জানুয়ারি মাসেই বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অনুমোদন প্রাপ্ত বাড়িগুলোর এক-তৃতীয়াংশ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। যা খুশি একটা বলে দিলেই হল! মিথ্যে কথার তো কোনও সীমা পরিসীমা নেই। ১ টাকায় মহিলাদের ঋতুকালীন ব্যবহারের জন্য স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যাচ্ছে। এটাই মহিলাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় নাকি ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। ২০১৯-২১-এর তথ্য বলছে দেশের এক-পঞ্চমাংশ মহিলা ঋতুর সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। ঋতুকালীন শারীরিক অসুবিধার জন্য দেশের মেয়েদের এক-পঞ্চমাংশ ঋতুর সময় স্কুল-কলেজে যায় না। ক্লাস মিস করতে বাধ্য হয়।
১৪ কোটিরও বেশি যুবক-যুবতী নাকি প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনার অধীনে পোশাদারি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ডাহা মিথ্যে কথা। ২০২২-২৩-এ শ্রম, বস্ত্র ও দক্ষতা উৎকর্ষ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছ, প্রধানমন্ত্রীর কৌশল বিকাশ যোজনা ২-এর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে চাকরিপ্রাপক মোটে ২৩ শতাংশ। আর ৩-এর অধীনে চাকরিপ্রাপক মাত্র ৮ শতাংশ। ২০২২-এর ৩০ জুন পর্যন্ত তো বাজেট-বরাদ্দের অর্ধেকও খরচ হয়নি।
আরও পড়ুন-অরূপের নেতৃত্বে সায়নীর সভা
কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ক্ষেত্রে নাকি নজিরবিহীন বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। ২০২৪-এ কৃষকদের ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে এই মোদি সরকার ১৯ জন কৃষককে হত্যা করেছে, কমপক্ষে ৪০ জনকে আহত করেছে। তাদের মুখে এই দাবি তাই শোভা পায় না। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করার দাবিতেই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। সড়ক, সেতু, রেলপথ ও বিমানবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার নাকি অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করা হয়েছে। এটাও একেবারে নির্জলা মিথ্যা কথা। ডিসেম্বর, ২০২৩-এ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষ পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অনুমোদিত ১৮১টি প্রকল্পের মধ্যে ২৫টির কাজ শেষ হয়েছে। গত ছয় বছরে এই খাতে বরাদ্দ অর্থের ৪০ শতাংশ খরচ হয়েছে।
দাবি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-সড়ক যোজনার অধীনে ৩.৭ লক্ষ কিমি রাস্তা নির্মিত হয়েছে। অথচ ২০২৩-এর জানুয়ারি অবধি এই যোজনার অধীনে চারটি মুখ্য সড়কের কোনওটার নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়নি। এর আগে বলা হয়েছিল, ২০২২–এর মধ্যে অন্তত দুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। মার্চ, ২০২৩ পর্যন্ত পশ্চিম ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ-ধরনের প্রকল্পগুলোর অর্ধেকের কাজও শেষ হয়নি।
‘সৌভাগ্য’ নামক প্রকল্পের অধীনে ২.৮ কোটিরও বেশি বাড়িতে নাকি পুরোদস্তুর বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে নাকি ১০০ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হয়েছে। এটাও মোদি সরকারের আর একটা জুমলা। এই তো গত ডিসেম্বরেই রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের বিদ্যুৎমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ আর অন্ধ্রপ্রদেশ মিলিয়ে পাঁচ লক্ষ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বাকি।
‘মোদি কি গ্যারান্টি’ তাই এমন একটি ব্র্যান্ড প্রোপজিশন, যাতে উপভোক্তারা আস্থা রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। ভোটপ্রচারে বঙ্গে আগত মোদিজিকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।