পুরুষের তুলনায় ভারতীয় মহিলাদের পুষ্টির ঘাটতি অনেক বেশি। কারণ পুষ্টিকর খাবার পুরুষদের তুলনায় কম খান এদেশের মেয়েরা। দরিদ্র পরিবারে তো বটেও, অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের মেয়েদের পাতেও দুধ, ডিম, ফল খুব সামান্যই পড়ে। একটি আন্তর্জাতিক সায়েন্স জার্নালে সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ব্যাখা দিচ্ছেন, পুষ্টিতে বৈষম্য বস্তুত মানবসমাজে লিঙ্গবৈষম্যের একটি প্রধান লক্ষণ। সব শ্রেণির মহিলার মধ্যেই পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার রীতি পুরুষদের থেকে কম। ডিম, মাছ, মাংসের মতো প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার অর্ধেকেরও বেশি মহিলা খানই না।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের প্রবল চাপে শেষ পর্যন্ত অভিজিৎকে শোকজ কমিশনের
অভাবের সংসারে স্বামী-সন্তানের পাতে ভালটা তুলে দিয়ে নিজে কৃচ্ছ্রসাধন করে খরচ কমানোর চেষ্টা যুগে যুগে করেছেন মেয়েরা। সেসব নজির বারবার উঠে এসছে গল্প-উপন্যাস, চলচ্চিত্রে। জনস্বাস্থ্য গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পৃথিবী জুড়ে খাবারের দাম বাড়লে বা রোজগার কমলে বয়স নির্বিশেষ মেয়েদেরই খাবারের পরিমাণ কমে যায় পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে পর্যাপ্ত পুষ্টি মেলে না তাঁদের। যাঁরা ওয়র্কিং উইমেন তাঁদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। পরিবারের পুরুষ এবং শিশুদের খাইয়ে আজও শেষ পাতে বাসি-পচা-উচ্ছিষ্ট খান ভারতের বহু মেয়ে তাই তাঁদের রক্তাল্পতা, অপুষ্টি দেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সঙ্কট।
আরও পড়ুন-ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে তুলে নেব সিএএ-এনআরসি নির্দেশিকা
কোথায় গলদ
ঠিক সময়ে যদি খাবার পেটে না পড়ে সেই খাবার কোনও কাজে আসে না। খিদে পেলে আমাদের শরীরে এক ধরনের এনজাইম সিক্রেশন হয়। এই এনজাইম ক্ষরণের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। প্রত্যেকদিন যেসময় খাবারটা আমরা খাই সেই সময়ই রোজ খিদে পায়। কিন্তু সংসারের সব দায়িত্ব সামলে যখন মহিলারা সবার শেষে নিজে খান ততক্ষণে এনজাইম ক্ষরণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ খিদেটা মরে গিয়েছে। এই সময় যখন তিনি পেটভরে খেলেন দু-ধরনের ক্ষতি হল। প্রথমত, এনজাইম ক্ষরণের মুহূর্তে খাবার গেল না এবং দ্বিতীয়ত, এনজাইম ক্ষরণ যখন বন্ধ হয়ে গেল তখন খাবার ঢুকল ফলে তখন খাবারটা হজম হল না। এর ফলে মেটাবলিজম প্রসেসটা বাধা পেল। মেটাবলিজমে সমস্যা মানেই শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা দিল। অ্যাসিডিটি বাড়তে থাকল, ব্লটিং, গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যা দেখা দিল।
যিনি ওয়ার্কিং তাঁর ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। বাড়ির লোকের জন্য খাবারটি তৈরি করে নিজেরটি নিতে ভুলে যান বা সময় হয় না নেওয়ার। নিদেনপক্ষে একটু ভাত, ডাল আর ভাজা নিয়ে অফিস দৌড়ন। এবার প্রচণ্ড কাজের চাপে খাবার সঠিক সময়টা চলে গেল। অনেকেই ওই সময় বিকল্প হিসেবে যখন চা বা কফি খেতে থাকেন বিষয়টা তখন একই দাঁড়ায়। পরে খাবার খেলে আর হজম হয় না। অ্যাসিড হয়ে যায়।
গৃহবধূ হন বা ওয়ার্কিং উইমেন এই সময় চা, কফি না খেয়ে যদি হাতের কাছে টুকরোটাকরা কিছু রেখে দিতে পারতেন যেমন একটু ছোলা ভাজা বা সেদ্ধ, অল্প ফ্রাই করা মাখানা, খেজুর বা একটা ফল তাহলেই সমস্যা মিটে যেত। অনেকে সকালে খাবার পর সরাসরি লাঞ্চ করেন এটা ভুল। মিড মর্নিংয়ে একটা কোনও ছোট মিল সবসময় রাখা জরুরি। আর প্রত্যেকটা খাবারের মাঝে ডিউরেশন মেন্টেন করা জরুরি।
মহিলারা আর্থিক দিকটাকে সবসময় গুরুত্ব দেন। বাড়িতে যেটার সঙ্কুলান সেটা তাঁরা নিজের পাত থেকে বাদ দিয়ে দেন ফলে কম খাবার খান আবার পর্যাপ্ত থাকলেও বাড়ির সবাইকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে ভাল খাবারটা তাঁর কপালে জোটে না। প্রতিদিন একটা করে ফল খাওয়া জরুরি সেটা তাঁরা খান না। এক গ্লাস দুধ খাওয়া জরুরি কিন্তু তাঁরা খান না।
আরও পড়ুন-দুই ভারতীয় মশলায় নিষেধাজ্ঞা নেপালে, এভারেস্ট ও এমডিএইচ সংস্থার পণ্য
রান্নার করা পদ্ধতিও পুষ্টির ঘাটতির আরেকটা কারণ। ভারতীয় হেঁশেল মানেই তেল-মশলা দিয়ে রসিয়ে কষিয়ে রান্না। একটা পদ যত কষিয়ে রান্না করা হয় তত তাঁর নিউট্রিয়েন্টস কমতে থাকে। স্ট্যু বা বয়েলড বা গ্রিলড, শ্যালো ফ্রাই করা খাবার থেকে বেশি পুষ্টি শরীরে সরবরাহ হয়। সাধারণ সেদ্ধ বা আতপ চালের বদলে ঢেঁকিছাঁটা চাল, ব্রাউন রাইস খেলে অনেকটা পুষ্টি মেলে।
মহিলাদের পুষ্টির বিভিন্ন পর্যায়
একজন মেয়ের তিনটে ধাপে পুষ্টির চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে আর ওই তিনটে ধাপেই পুষ্টির ঘাটতিও সবচেয়ে বেশি হয়। প্রথমটা হল যখন তাঁদের মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল শুরু হচ্ছে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধি। এই সময় মেয়েদের শরীরে প্রোটিন এবং আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং ভিটামিন ডি-র খুব প্রয়োজন হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় হল যখন একজন মহিলা মা হচ্ছেন বা প্রেগনেন্সি পিরিয়ড বা ল্যাকটেশন পিরিয়ড অর্থাৎ যখন তিনি বাচ্চাকে ফিড করাচ্ছেন। এই সময় তাঁর পুষ্টির সঙ্গে সন্তানের পুষ্টি জড়িত অর্থাৎ পুষ্টির প্রয়োজনটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই সময় খুব সচেতনভাবে পুষ্টির খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন-আজ ঠিক হবে প্লে-অফের চতুর্থ দল
তৃতীয় পর্যায় হল মেনোপজ। এই সময় পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাবার ফলে শরীরে হরমোনের নানা পরিবর্তন আসে। তখন শরীরে যদি সঠিক পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড না থাকে, আয়রনের ঘাটতি থাকে, ক্যালশিয়াম এবং ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি থাকে তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেনোপজের পরেই মহিলাদের অস্টিওপোরোসিসের সমস্যা দেখা দেয়। কাজেই একজন মহিলার মেনোপজের সময় ভিটামিন, মিনারেল এবং প্রোটিন— এই তিনটের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। মহিলাদের এই তিনটে পর্যায় কিন্তু পুরুষদের জীবনে আসে না ফলে স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা পুষ্টির ঘাটতিতেও ভোগেন না।
কীভাবে মিটবে পুষ্টির চাহিদা
মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল শুরু হচ্ছে মানে প্রত্যেকমাসে একটা পরিমাণে একটি মেয়ের ব্লাড লস হচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে তাঁর প্রত্যেক মাসেই পুষ্টির চাহিদা সম্পূর্ণ হওয়া জরুরি। না হলে ঘাটতি থেকেই যাবে। অনেকেরই এই কারণে এই সময় পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। এখন বিভিন্ন স্কুলে আয়রন ট্যাবলেট, ফলিক অ্যাসিড দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য এই উদ্যোগ খুব ভাল। কিন্তু ট্যাবলেট নিলেও খাবারের মাধ্যমে এই সব উপাদানগুলো মেয়েদের শরীরে প্রবেশ করা আরও বেশি ভাল। তাহলে কীসের ঘাটতি হলে কী কী খাবেন একটু জেনে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন-ছিঁড়ল চটি, মঞ্চে বসেই লাগালেন সেফটিপিন
আয়রন
প্রথম হল আয়রন। নব্বই শতাংশ ভারতীয় মহিলাদের আয়রন ডেফিসিয়েন্সি বা ঘাটতি দেখা যায়। হয়তো তাঁরা খাবারের মাধ্যমে আয়রন নিচ্ছেন কিন্তু শুধু সেই আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার খেলেই হবে না, ভিটামিন সি নেওয়াটাও একই সঙ্গে জরুরি কারণ তা না হলে শরীরে আয়রন ঠিকমতো কাজ করবে না। তাই আয়রন রিচ ফুড নেওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবারও খেতে হবে।
আয়রন ট্যাবলেট খেলে তাঁকে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, পেয়ারা, কমলালেবু, টম্যাটো, কিউই ইত্যাদি যে কোনও একটা খেতে হবে। সেটা একটা পাতিলেবুও হতে পারে। এ-ছাড়া আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে যে-কোনও সবুজ শাকসবজি, বিট, বিনস খেতে হবে দিনের যে কোনও একটা সময়।
রোজ একটা ডিম থাকবে তার সঙ্গে দুধ, টোফু, চিয়াসিড, রাগি, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
ভিটামিন ডি
আয়রন এবং ভিটামিন সি-র যেমন একটা যোগসূত্র রয়েছে তেমনই ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি-এর মধ্যেও একটা যোগ রয়েছে। তাই ভিটামিন সি-এর সঙ্গে ভিটামিন ডি-ও নিতে হবে না হলে ক্যালসিয়াম কাজ করবে না।
এবার ভিটামিন ডি বলতে অনেকেই বোঝেন সূর্যের আলো নিলেই বুঝি ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে কিন্তু তা নয়। চারপাশে এতটাই পলিউশন যে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এখন ভালর চেয়ে ক্ষতি করছে বেশি।
তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ভিটামিন ডি-এর ডোজ নেওয়া যেতে পারে অথবা ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যেমন কডলিভার অয়েল, সালমন মাছ, টুনা ফিশ, কমলালেবু, মুসাম্বি, দুধ বা দুধের প্রোডাক্ট, তিলের তেল থেকে ভাল ভিটামিন ডি পাওয়া যায়
ম্যাগনেসিয়াম
ভারতে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতিতে ভোগেন। মূলত যাঁদের উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রয়েছে তাঁদের ম্যাগনেসিয়াম কম থাকলে তাঁদের এই অসুখ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ওষুধও ভাল কাজ করে না ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি হলে। এক্ষেত্রে রোজ যে কোনও ধরনের বিনস খান। সবুজ শাকসবজি, টোফু, কলা এগুলোও ম্যাগনেসিয়াম রিচ ফুড।
আরও পড়ুন-মোদিজি! বিদায়ের সুর তুমি শুনতে কি পাও…
ভিটামিন বি টু
ভিটামিন বি টু-এর ঘাটতি ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে খুব বেশি। এক্ষেত্রে ডিম, চিকেন, মাশরুম, পালংশাক, ড্রাই ফ্রুটসও খেতে পারেন। যেমন আমন্ড, আখরোট এবং পেস্তা। কাজু এবং কিশমিশ খাওয়া যেতে পারে কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের চলবে না। এছাড়া খেজুর খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন বি টু-এর ঘাটতি হলে মাইগ্রেনের সমস্যা খুব বেশি হয়।
ভিটামিন বি টুয়েলভ
একজন মহিলার ভিটামিন বি টুয়েলভের ঘাটতি থাকে প্রায় ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ। কিছুক্ষেত্র তার থেকেও বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মহিলার হিমগ্লোবিন কম থাকে। অর্থাৎ তাঁরা অ্যানিমিক। অ্যানিমিয়ার তিনটে কারণ। ভিটামিন বি টুয়েলভের ঘাটতি থেকে, ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি এবং প্রোটিনের ঘাটতি। আর অ্যানিমিয়া হয় তার কারণ হল যে ব্লাড প্রতি মাসে পিরিয়ডের সময় লস হচ্ছে সেটা পূরণ হয় না। এই ভিটামিন বি টুয়েলভ, ফলিক অ্যাসিড আর আয়রনের ঘাটতি পূরণ হবে বিভিন্ন অ্যানিমাল প্রোটিন, মিল্ক প্রোডাক্ট থেকে। মাছ বা মাংস একশো গ্রাম প্রতিদিন নিতে হবে। দুধের জিনিস ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম রোজ নিলে এই ঘাটতি পূরণ হবে। সেক্ষেত্রে এক কাপ দুধ এবং একশো গ্রাম দই রোজ খেলে এই ঘাটতি অনেকটা কমবে। এছাড়া ক্যাপসিকাম, বেলপেপার ব্রকোলি, স্ট্রবেরি বা সাইট্রাস ফল খেলে ভিটামিন সি-এর সঙ্গে বি টুয়েলভের ঘাটতিও পূরণ হবে।
ভিটামিন এ
এটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেগনেন্সি এবং ল্যাকটেশন পিরিয়ডে। এই সময় ভিটামিন এ, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, প্রোটিনের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ভিটামিন এ আমরা পেতে পারি যে কোনও রঙিন সবজি থেকে। পাকা পেঁপে, পেয়ারা, গাজর, বিন থেকে পাওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন-আজ ঠিক হবে প্লে-অফের চতুর্থ দল
প্রোটিন
ভারতে প্রায় ৮৬ শতাংশের ওপর মহিলা প্রোটিনের ঘাটতিতে ভোগেন।
এর মধ্যে গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে প্রোটিন সবচেয়ে জরুরি। এটা দরকার আগত নতুন শিশুর তার গঠনে এবং মায়ের নিজের জন্য। প্রেগনেন্সির পরে অনেকটা ব্লাড লস হয় তার আগে থাকতে ইন্টারনাল প্রোটিন জমিয়ে রাখা জরুরি। না হলে অ্যানিমিয়া হয়ে যেতে পারে এই ব্লাড লসের কারণে। প্রতি কেজি ওজনে ১.২ গ্রাম প্রোটিন জরুরি, গর্ভবতী মহিলাদের সেটা প্রয়োজন ১.৭ গ্রাম। কাজেই যে গোটা সংসারের হাল ধরে তার পুষ্টির হাল ধরতে হবে পরিবারকেও।