সচেতনতাই একমাত্র প্রতিষেধক

হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যানে ভারতের স্থান বিশ্বের তৃতীয়। সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২.৪০ কোটি যার মধ্যে রয়েছে অনেক শিশুও। চলছে গবেষণা। কিন্তু আজও আবিষ্কৃত হয়নি এই মারণব্যাধির প্রতিষেধক। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। সেই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় প্রতিবছর মে মাসে পালিত হয় বিশ্ব এডস টিকা দিবস। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

টিকাকরণের কারণেই একটা সময় গুটিবসন্ত শেষ হয়েছিল চিরতরে এবং পোলিওর ক্ষেত্রেও তা-ই। সদ্য কোভিড ১৯ ভ্যাকসিনের কারণেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। অথচ হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (HIV) আবিষ্কার হওয়ার পর কেটে গিয়েছে ৩৭ বছর! এই এইচআইভি-র কারণেই হয় দুরারোগ্য এডস। প্রতিবছর লক্ষাধিক প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এখনও আবিষ্কৃত হয়নি এইচআইভি-র ভ্যাকসিন।

আরও পড়ুন-সেবকের আশ্রমের ঘটনায় রাজনীতির সম্পর্ক নেই : মুখ্যমন্ত্রী

বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন সিমিয়ান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। মূলত বাঁদরের দেহে এই ভাইরাস মেলে। এসআইভি (SIV) আসলে এইচআইভিরই নিকটাত্মীয়। এইচআইভি-র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে এসআইভি এবং বাঁদর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ১৯৮৩, ’৮৪ সাল নাগাদ এইচআইভি আবিষ্কারের পর সকলে ভেবেছিল খুব দ্রুত ভ্যাকসিনের দেখা মিলবে। কিন্তু এমনটা হয়নি তার মূল কারণ এই ভাইরাসটির একাধিক স্ট্রেনের উপস্থিতি এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেদ করে শরীরে ঢুকে যাওয়ার পদ্ধতিই জটিল করে তুলেছে ভ্যাকসিন প্রস্তুতিকে। ইতিমধ্যে পঞ্চম ভ্যাকসিনের ট্রায়ালও হয়ে গেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। যদিও বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কাজেই এখনও এই রোগের কোনও প্রতিষেধক নেই। মানুষকে সচেতন হতে হবে। এটাই হল সব থেকে বড় প্রতিষেধক। সেই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব এডস টিকা দিবস। বিশ্ব এডস টিকা দিবস শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৭ সালের ১৮ মে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন একটি সভায় বলেছিলেন, এইচআইভি টিকাই একমাত্র এডস রোগের মোকাবিলা করতে সক্ষম। ওই দিনের ওই বক্তৃতা ভিত্তি করেই ১৮ মে বিশ্ব এডস টিকা দিবস পালন শুরু হয় ঠিক তার পরের বছর থেকে। এডস রোগের টিকা নিয়ে সচেতনতার প্রচার করতে এই দিনটির উদযাপন শুরু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে ৩৯ কোটি মানুষ এডসে আক্রান্ত। ২০২২ সালে ভারতে এডসে আক্রান্ত শিশু এবং কিশোর ছিল ১৫ লক্ষ। অর্থাৎ বয়সের সীমা ০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ওই একই বছরে এডস রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ছ’লক্ষের বেশি।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে গদ্দার অধিকারীকে শুনতে হল চোর চোর স্লোগান

এডস কী
এইচআইভি ভাইরাস যার পুরো নাম হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। যা রেট্রোভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত। এর দু’টি ধরন আছে। এইচআইভি-১ ও এইচআইভি-২। এর মধ্যে আমাদের দেশে এইচআইভি-২-তে আক্রান্ত রোগীই বেশি পাওয়া যায়।
এই রোগে আক্রান্ত হলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়। আর সেই কারণেই অন্যান্য জীবাণুঘটিত রোগ খুব সহজেই শরীরে বাসা বাঁধে।
এই ভাইরাস সংক্রমণের বৈশিষ্ট্য হল, এরা মানবদেহে প্রবেশের পরে শরীরে মিশে গিয়ে ভাইরাল রিফ্লেকশনের মাধ্যমে নিজের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এই ভাইরাস দেহের লিম্ফয়েড কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
উপসর্গ
দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
বারবার জ্বর আসা।
দুর্বলতা বেড়ে যাওয়া।
বগল, কুঁচকি, গলার কাছে লিম্ফগ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া।
সাতদিনের বেশি সময় ধরে চলা ডায়েরিয়া।
মুখ, যোনি, পায়ুদ্বারে ঘা।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া।
এই সমস্যাগুলি দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এডস রোগের কারণ
অসুরক্ষিত যৌনজীবন এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এর পাশাপাশি আরও কিছু কারণ রয়েছে।
এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত সুচ দিয়ে মাদক দ্রব্য সেবন করলে।
এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত কারও থেকে রক্ত নেওয়া হলে।
সংক্রমিত গর্ভবতী মায়ের থেকে গর্ভস্থ শিশুর দেহে সংক্রমণ হতে পারে।

আরও পড়ুন-গরিবের চিকিৎসক হতে চান মেধাবী মুস্তাফিজুর

কিছু ভ্রান্তি
জ্বর বা সর্দির মতো এই রোগ ছড়ায় না।
সংক্রমিত রোগীর পাশে বসলে, কথা বললে বা হাত ধরলে এই রোগ ছড়ায় না।
এমনকী সংক্রমিত রোগীকে স্পর্শ করলে বা তাঁর ব্যবহৃত বাসন ব্যবহার করলেও এই রোগ অন্যের শরীরে ছড়ায় না।
মশার মাধ্যমে এইচআইভি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যায় বলে যে ধারণা রয়েছে, সেটাও অমূলক।
এই রোগ ছোঁয়াচে নয় অর্থাৎ এডস রোগীকে একঘরে করে রাখারও প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুন-প্রবল ঔদ্ধত্যে দিল্লিবাসীকে অপমান করে চলেছেন শাহ, কেন্দ্রে সরকার গড়বে ইন্ডিয়াই : কেজরি

তিনধাপে হয় এডস
এইচআইভি সংক্রমণের তিনটে স্টেজ। প্রথমটা হল অ্যাকিউট স্টেজ বা অ্যাকিউট রেট্রোভাইরাল সিনড্রোম। যা সংক্রমণের ৩ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে হয় এবং নিজে থেকেই ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। এতে সাধারণত, জ্বর বা সর্দি-কাশির মতো সমস্যা দেখা যায়।
দ্বিতীয় ক্লিনিক্যাল ল্যাটেন্সি বা ক্রনিক স্টেজ। এই স্টেজে সাধারণত সংক্রমণের কোনও লক্ষণ সেভাবে শরীরে প্রকাশ পায় না।
তৃতীয় স্টেজটাই হল এডস। এই পর্যায়ে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। সেই সময় শরীরে নানা সংক্রমণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রাণঘাতী নানা লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এডস প্রাণঘাতী কিন্তু এডস মানেই মৃত্যু নয়। এইচআইভি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। এই সুযোগে নানা সংক্রমণ মানব শরীরে বাসা বাঁধে। যা পরবর্তীকালে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
না হোক এডস
শারীরিক মিলনের সময় কন্ডোম ব্যবহার করা খুব জরুরি। বিশেষত যাঁরা অনিয়ন্ত্রিত যৌনসংস্রবে অভ্যস্ত।
যৌন রোগের যথাযথ নির্ণয় ও চিকিৎসা। যে-কোনও যৌনরোগ হলেই আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রক্ত দেওয়া বা নেওয়া অথবা ইঞ্জেকশনের সময়ে একটি সিরিঞ্জ একবারই ব্যবহার করুন।
চিকিৎসা
বর্তমানে এই রোগের উন্নততর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যার নাম অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি বা এআরটি। এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের সংখ্যা কমে যায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যায়। ফলে রোগী দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে সক্ষম হন। নিয়মমাফিক চিকিৎসা করলে এবং সতর্কতা অবলম্বন করলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই এডস হয়েছে জানলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।
শিশুদের ক্ষেত্রে
তিনভাবে এই রোগ শিশুদেহে সংক্রমিত হতে পারে। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে ও স্তন্যপানের মাধ্যমে। তাই গর্ভের প্রথম অবস্থায়ই মায়ের এইচআইভি পরীক্ষা করানো উচিত। যদি দেখা যায়, মায়ের শরীরে এইচআইভি ইনফেকশন রয়েছে, তা হলে এআরটি চিকিৎসা শুরু করা উচিত। আক্রান্ত মায়ের শিশুকে স্তন্যপান করানো উচিত নয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা আবশ্যিক।
বর্তমানে সব সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষা-সহ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই চিকিৎসা করতে দেরি না করাই বাঞ্ছনীয়।

Latest article