২২ বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতার কারবারি। বিগত ১০ বছর বিভেদপন্থী প্রধানমন্ত্রী। আর এত দিন ধরে এত কিছু করার পর হঠাৎ মোদিবাবুর বোধোদয় হয়েছে। বিড়াল বলছে মাছ খাব না, কাশী যাব!
বিভেদে মাতোয়ারা জঞ্জাল পার্টি (No Vote To BJP)। সেই পার্টি দশ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন থেকেছে হিন্দু রাষ্ট্র-সাধনার গ্যাস বেলুন উজিয়ে এবং অতঃপর অনুধাবন করেছে, কিংবা বলা ভাল, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে, ভারত নামক আত্মার চরিত্র বদল আদৌ সহজ কর্ম নয়। জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে ঘৃণার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে বটে। সেকাজে এই জুমলাবাজ অনেকাংশে সফল, একথাও সত্য। কিন্তু একাধিক সমীক্ষার ফলে একটা কথা প্রকাশিত। এদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, এদেশ শুধু হিন্দুর বা কেবল মুসলমানের নয়। এদেশ সকলের। পাশাপাশি একথাও সত্য হয়ে উঠছে, ধর্মের উসকানি ঠেলে বেরিয়ে আসছে পেটের ভাত আর মাথার ছাদের সমস্যা। দু’হাতে কাজ আর দুবেলা পেট পুরে খাওয়ার দাবি। আর এটা টের পেয়েই ভোল বদলের খেলায় নেমেছেন মিথ্যেবাদী মোদি, যাঁকে তাঁর অনুগতরা জগন্নাথের চেয়ে বড় ভারত-নাথ বলে মনে করে। ওড়িশার নৃপতি, শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ মন্দিরের আদি প্রতিষ্ঠাতা অনন্তবর্মন চোড় গঙ্গদেব বলেছিলেন, ওড়িশার রাজাধিরাজ মহাপ্রভু জগন্নাথদেব আর তিনি নিজে (অর্থাৎ, অনন্ত বর্মন চোড় গঙ্গদেব) হলেন জগন্নাথের অধীনস্থ সামন্ত রাজা রাউত মাত্র। পরবর্তীকালে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বাবা, বিজু পট্টনায়ক সগর্বে বলেছেন, ওড়িশায় জগন্নাথ বই আর কোনও নেতা নেই। আর এখন, সম্বিতহারা পাত্রে, অবচেতনের দাবি মোদিভক্তের জিভে উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, বিশ্ব জুড়ে যাঁর অগণিত ভক্ত সেই জগন্নাথ দেব নাকি মোদিজির ভক্ত! এই আবহে মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে মোদি এখন বলছেন, তিনি যেদিন ‘হিন্দু-মুসলমান’ করবেন, সেদিনই তিনি সর্বজনীন জীবনে থাকার অধিকার হারাবেন। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিজেপির প্রচারমন্ত্রীর এই অভিমত সম্প্রচারিত হওয়ার পর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশেপাশে চড়ে বেরনো ঘোড়াগুলোও হাসতে শুরু করেছে। ঘোড়াদের হাসার কারণগুলো অস্বীকার করা চলে না।
গত ১৪ মে, ২০২৪-এ বারাণসীতে মনোনয়নপত্র পেশের অব্যবহিত পরেই নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতি করেন না। আর তার ঠিক পরেই দিনই, ১৫ মে, ২০২৪-এ মহারাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি বললেন, কংগ্রেস তো গোটা বাজেটের ১৫ শতাংশ মুসলমানদের দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ পারেনি। কারণ, বিজেপি (No Vote To BJP) ওদের আটকেছে। মুসলমানদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে বিজেপি যে একেবারে ‘চ্যাম্পিয়ন’, সে-ব্যাপারে কৃতিত্ব নেওয়ার ব্যাপারে এতটুকু রাখঢাক করেননি মোদিজি।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের ভরসা বঙ্গ ব্রিগেড
এই সে মাসেরই গোড়ার দিককার কথা, ৩ মে, ২০২৪। বিভাজনের রাজনীতির চাষ করে দাঙ্গার ফসল ফলিয়েছিলেন যে রাজ্যের মাটিতে, সেই গুজরাতে মোদি বললেন, বিরোধী জোট (অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া’) মুসলমানদের ‘ভোট জিহাদ’ করতে বলছে এটা নতুন (কথা), কারণ এতদিন আমরা ‘লাভ জিহাদ’ আর ল্যান্ড জিহাদ’-এর কথা শুনে আসছিলাম, আশা করি, আপনারা সকলে জানেন ‘জিহাদ’-এর অর্থ কী আর এই জিহাদ কার বিরুদ্ধে। গুজরাতে আনন্দ-এ মোদি এই কথাটা বলে কী বার্তা দিলেন? তিনি কি এটাই বলতে চাইলেন না যে যাবতীয় ‘জিহাদ’-এর লক্ষ্য একটাই, হিন্দু। হিন্দুদের বিরুদ্ধেই যাবৎ ‘জিহাদ’, তা সে প্রেম-বিবাহ হোক, জমিজমা সংক্রান্ত হোক আর ভোটদানের বিষয়েই হোক, জিহাদ মানেই মোদির কথায়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ। এসব কথা কথা বলা মানে কি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের তাস খেলা নয়? এসব কথা এভাবে বলা মানে কি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে খেপিয়ে তোলা নয়? মোদি কি ভেবেছেন? দেশের সব লোক বোকা?
গত মাসের শেষের দিককার কথা। তেলেঙ্গানার জাহিরাবাদে ভাষণ দিচ্ছিলেন মোদি, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪-এ তাঁকে বলতে শোনা গেল, বিরোধীরা সংবিধানের অপমান করতে চায়, কিন্তু আমি ওদের জানাতে চাই, যতদিন আমি বেঁচে আছি আমি তাদের দলিতদের, তফসিলি জাতি-উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতির জন্য রেখে দেওয়া সংরক্ষণ ধর্মের নামে মুসলমানদের দিতে দেব না।
এই ঘটনার দিন সাতেক আগেকার কথা, ২১ এপ্রিল, ২০২৪-এ রাজস্থানের বংশওয়াড়ায় ভাষণ দিচ্ছিলেন মোদি, তিনি বললেন, যখন অবিজেপি সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা বলছিল দেশের সম্পত্তিতে মুসলমানদের অধিকার সবচেয়ে আগে, সবার প্রথমে, তার মানে, তারা জাতীয় সম্পদ বিলিয়ে দিতে চাইছে তাদের মধ্যে যাদের বাচ্চাকাচ্চার সংখ্যা বেশি, তারা ওই সম্পদ তুলে দিতে চাইছে তাদের মধ্যে যারা আসলে অনুপ্রবেশকারী। আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ কি অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে দেওয়া উচিত? ভাই-বোনেরা, এটা হল আসলে শহুরে নকশালদের ভাবনা। মা-বোনেরা ওরা আপনাদের মঙ্গলসূত্রটাকেও ছাড়বে না। সেটাও মুসলমানদের দিয়ে দেবে ওরা। এটাও যদি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের তাস খেলা না হয় তবে কোনটা বিভেদ বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা! এই রাজনীতি, এই জুমলা আর সাম্প্রদায়িকতার নোংরামি বিজেপির কাছে নতুন কিছু নয়। ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯-এ ঝাড়খণ্ডের দুমকায় মোদিজি বলেছিলেন, যারা সিএএ-র বিরোধিতা করছে, যারা আগুন লাগাচ্ছে, দাঙ্গা বাধাচ্ছে, পোশাক দেখলেই তাদের চেনা যায়। তারও দুবছর আগের কথা। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭-তে মোদির বক্তৃতা। উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরে মোদির ভাষণ। তিনি বললেন, যদি তোমরা কবরস্থান তৈরি কর, তবে শ্মশানও তৈরি করা উচিত। যদি রমজানের সময় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তবে দেওয়ালির সময়েও বিদ্যুৎ সরবরাহে যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও পক্ষপাতিত্ব করা চলবে না। এইরকম কথা যিনি বলে বেড়িয়েছেন এবং এখনও বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি যদি আমি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতি করি না বলেন, তাহলে হাসি ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে!
একজন বিদূষক বা জোকারই এরকম হাসাতে পারেন। এটা কেরিয়ার হিসেবে মন্দ নয়। আগামী ৪ জুনের পর মনে হয় মোদিকে লোক হাসিয়েই উপার্জন করতে হবে।