যদি কেউ বলেন যে তাঁর জন্ম জৈবিক নয় তার মানে শুধু এটা নয় যে তিনি ভগবানের অংশ, তিনি শয়তানের অংশও হতে পারেন! উপরওয়ালা শুধু সাধুদের বরদান করেননি, মহিষাসুরকেও দিয়েছিলেন। আবার সেই মহিষাসুরকে মারতে মা দুর্গা-কেউ ক্ষমতা দিয়েছিলেন। এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ ভোট-পর্ব চলাকালীন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অন্ধ ভক্তদের কিছু উক্তি তথা নর্দমার ভাষা। সপ্তম পর্ব ভোট চলাকালীন মোদি বিহারের পাটলিপুত্রে এক সভায় বলেন, ইন্ডিয়া জোটের এসসি, এসটি, ওবিসিদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তা মুসলিমদের দিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকে আমি আটকাবই। তাদের ভোট ব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতে গিয়ে তারা না হয় মুজরো করতে পারে। এই ভাষ্যেই শয়তানের নর্দমার ভাষা ও বিভেদমূলক চিন্তা পরিস্ফুট।
বিজেপি গত এক দশক ধরে বিজেপি যে নর্দমার ভাষার ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ‘এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স’ পড়া মোদি। সেই নর্দমার ভাষার কিছু নিদর্শন রইল— দিদি ওওও দিদি, লেডি কিম, মা দুর্গার পিতৃপরিচয় জানতে চাওয়া, দিদিকে বারমুডা পরার পরামর্শ, ঠুমকা নাচ, দিদির ধান্দা জানতে চাওয়া, দিদির পরিবার নিয়ে কুকথা, এমনকী দিদির দাম কত বা দিদি আদৌ মহিলা কিনা প্রভৃতি। মাথায় রাখতে হবে এ-কথা শুধুমাত্র তথাগত রায় যাকে ক্লাস এইট পাশ ফিটার বলেছিলেন সেই দিলীপ ঘোষ কিংবা বিজেপি পার্টি যাকে ২০২০ সালের আগে অশিক্ষিত চোর বলেছিল সেই শুভেন্দু অধিকারী বলেনি; বিজেপির সভাপতি ‘অধ্যাপক’ সুকান্ত মজুমদার, ‘অ্যাডভোকেট’ কৌস্তুভ বাগচী, এমনকী প্রাক্তন ‘বিচারপতি’ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত কুকথার জোয়ার দেখিয়েছেন। এ তো গেল শুধু বাংলার কথা এভাবেই অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপির নেতা মন্ত্রী মহিলা-সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নানান ভাবে অসম্মান করে চলেছে। এটা আসলে বর্তমান বিজেপির ডিএনএ আর তাদের এই কুকথার ক্রোনোলজি অনুসরণ করলে বোঝা যায় যে এরা বস্তুত হিংসাবাদী দল।
আরও পড়ুন-বারবার বেফাঁস নীতীশ কুমার, বিহারে বিপাকে পড়েছে এনডিএ, গুরুত্ব হারিয়ে হতাশার বহিঃপ্রকাশ!
মোদি বাবু আসলে ‘ম’ শব্দে ভীত হয়ে পড়েছেন। তাই সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও মমতা দিদির মা-মাটি-মানুষের কাছে হারের জ্বালা তাকে আরও হিংসাত্মক করে তুলেছে। কখনও মুসলিম, মুঘল, মছলি, মটন, মঙ্গলসূত্র, প্রভৃতি শব্দের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নানান সম্প্রদায়কে আঘাত করছেন; আবার এদিন বিহারে নির্বাচনী সভায় মুজরো শব্দের বিশ্রী ব্যবহার করলেন। অবশ্য তিনি খুব নির্দিষ্টভাবে মুজরো শব্দের প্রয়োগ করেছেন। কারণ মুজরো এমন এক নৃত্যশৈলী যা মুঘল আমলে ভারতে প্রচলিত হয়। তাই মুসলমানদের ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে ইন্ডিয়ার প্রসঙ্গে যেভাবে মুজরোর উল্লেখ করলেন তা আসলে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট।
এ-কথার আর এক প্রমাণ পাওয়া যায় এপ্রিল মাসে আলিগড়ের এক নির্বাচনী প্রচারে। সেখানে মোদি বলেন ইন্ডিয়া ক্ষমতায় এলে তারা মুসলিমদের দেশের সমস্ত সম্পদ দিয়ে দেবে এবং মহিলাদের মঙ্গলসূত্র নিয়ে নেবে। যদিও বাস্তবে তার হাত দিয়েই পুলওয়ামায় শহিদ সৈনিকদের স্ত্রীদের মঙ্গলসূত্র খুলে নেওয়া হয়েছে। কারণ সত্যপাল মালিক, তখনকার জম্মু কাশ্মীরের রাজ্যপাল, অভিযোগ করেছেন যে মোদি ওই আক্রমণের আভাস পেয়েও কোনও পদক্ষেপ করেননি। সে-কথা ২০১৯-এর। এবার আর ‘দেশ’কে সামনে রেখে ভোট করা যাচ্ছে না। তাই নতুন ষড়যন্ত্র— বিভাজন ও শাসন। মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িক ভাগ করে ভোট নিশ্চিত করার প্রয়াস তার মঙ্গলসূত্র ও মুজরো উক্তি।
আরও পড়ুন-গাজার শরণার্থী শিবিরে মিসাইল হামলায় মৃত ৪৫, ‘মর্মান্তিক ভুল’ বললেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী
কিন্তু এই মোদি দুবছর আগে এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে মুসলমানদের মধ্যেও পিছিয়ে পড়া রয়েছে। তিনি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন ৭০টি মুসলিম জনজাতিকে তিনি ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় এনেছিলেন। মনে রাখা জরুরি ওবিসি কিন্তু কাস্ট বা জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ নয় বরং ক্লাস বা শ্রেণিভিত্তিক সংরক্ষণ। এই সংরক্ষণ সংবিধানের, ‘‘equality of status and of opportunity” আদর্শ অনুসরণ করেই তৈরি। তারপরেও যখন তার সহযোগী মোটাভাই অমিত শাহ একথা বলেন যে তিনি এসসি, এসটি, ওবিসিদের সংরক্ষণ কিছুতেই মুসলিমদের হাতে যেতে দেবেন না তখন তাঁদের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য ও ভোজবাজি ধরা পড়ে যায়। যদিও বিজেপি-শাসিত অধিকাংশ রাজ্যেই মুসলিমদের জন্য ওবিসি কোটায় সংরক্ষণ রয়েছে।
দশ বছর যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিলেন তিনি যখন কদর্য ভাষায় একটা সম্প্রদায়কে ক্রমাগত নেতিবাচকভাবে আক্রমণ করেন বা তার উপস্থাপনায় সেই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়; তখন সংবিধানের মূল ভাবনা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং সকলকে ভারতীয় ব্যবস্থায় সংযুক্তীকরণ-এর মধ্যে নিয়ে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য। মোশা জুটিকে অনুসরণ করেই এ-মাসের শুরুতে কর্নাটক বিজেপি মুসলিমদের সম্পর্কে এমন ভিডিও তাদের এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে যাতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়ে এক্স কর্তা এবং বিজেপিকে বলে ওই পোস্ট মুছে দিতে। ঠিক এমন ভাবেই আমাদের বাংলায় নারী-বিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য প্রাক্তন বিচারপতি অভিষেক গঙ্গোপাধ্যায়কে একদিনের প্রচার থেকে বিরত রেখে শাস্তি দেয় এবং বলে তাঁর ভাষা বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী।
আরও পড়ুন-আজীবন এই দল ধরে রাখতে চাই : শাহরুখ
ব্যক্তিগত আক্রমণ, প্ররোচনামূলক-সাম্প্রদায়িক ও বিভেদমূলক প্রচার, নারী- বিদ্বেষ প্রভৃতির মাধ্যমে বিজেপি ভারতের জৈবিক তথা স্বাভাবিক সংস্কৃতিকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। তাদের প্রচার ভীষণভাবে মানসিক যন্ত্রণাদায়ক। মোদি যখন ইন্ডিয়াকে ‘দুষ্টদের ধর্মসভা’ বলেন বা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী কোনও বিরোধী নেতাকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল হিন্দু’ কিংবা কঙ্গনা রানাওয়াত ঊর্মিলা মাতণ্ডকার সম্পর্কে নিম্নরুচির যৌনতামূলক মন্তব্য করেন তখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ‘দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি’ শুধু ব্যাহত হয় না উল্টে দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দেয়। এহেনও কদর্য ভাষার ব্যবহার একদিকে যেমন হিংসাকে উসকানি দেয় আবার আমাদের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে, অন্যদিকে অসহনশীল সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আসলে বিজেপি ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং মানবতাবাদ বিরোধী। তাই মহিষাসুরকে আশীর্বাদ করার পরেও ভগবান যেমন মা দুর্গাকে শক্তি দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করার তেমনই শেষ দফা ভোটে মোদি জমানার পতনকে আরও নিশ্চিত করতে আমাদের মমতাদির হাতকে শক্ত করতে হবে। মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা থেকেই ইন্ডিয়া তথা ভারতকে পথ দেখাবে।