সপ্তম তথা শেষ দফার ভোট আজকের রাত পেরোলেই। আর শেষ দফার ভোটে মিথ্যুক আর গদ্দারদের বাহিনী নেমে পড়েছে খেলা ঘোরানোর জন্য। টি অস্ত্র প্রয়োগ করে তারা শেষ দফায় কেল্লা ফতে করতে তৎপর।
তাদের প্রথম অস্ত্র চিরাচরিতভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সি।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে শেষ দফায় মরণকামড় দিতে ফের ‘কেন্দ্রীয় এজেন্সি’কে আসরে নামিয়েছে গেরুয়া শিবির। বেছে বেছে তৃণমূলের ‘ভোট ম্যানেজার’দের মাত্র একদিনের নোটিশে তলব শুরু করেছে এজেন্সিগুলো। কলকাতা লাগোয়া যাদবপুর, বারাসত ও বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল নেতাদের হাজিরার নোটিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভাঙড়ের নেতা শওকত মোল্লা, বারাসত আসনের তরুণ তুর্কি দেবরাজ চক্রবর্তী এবং বসিরহাটের অন্তর্গত সন্দেশখালি বিধানসভার কেন্দ্রের প্রথম সারির দিলীপ মল্লিক, কৃষ্ণেন্দু বিশ্বাস, গৌর রায়-সহ ছ’জনকে ডেকে পাঠিয়েছে সিবিআই।
এই মরিয়া চেষ্টা শুধু এ-রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। পাঞ্জাবেও শেষ দফার ভোটের আগে কৃষক আন্দোলনের ‘মুখ’ হিসেবে পরিচিত নেতাদের ‘গৃহবন্দি’ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এই বিষয়টি কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রের তরফে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
বাঘের বাচ্চার মতো লড়াই করছেন যাঁরা, তাঁরাই টার্গেট। রাতে নোটিশ পাঠিয়ে বলছে, সকালে দেখা করো! আসলে অবধারিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না গেরুয়া পার্টি। তাই হাতের অন্তিম অস্ত্র প্রয়োগ করছে তারা।
তাদের দুই নং অস্ত্র সত্যিটা ধামাচাপা দিয়ে রাখার মরিয়া প্রয়াস।
মানুষের কাছে ভোটের ইস্যু একটাই—মূল্যবৃদ্ধি। প্রতি ছ’মাসে বদলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের মাসের বাজেট। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় উপার্জন বাড়ছে না। আর এমন একটা জলজ্যান্ত সমস্যাকেই নিখুঁত কৌশলে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছে মোদি সরকার। কারণ, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) বা ক্রেতা মূল্যসূচকই প্রকাশ করেনি তারা। বেনজিরভাবে, ৬৪ বছর পর। এই সূচকের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ ঘোষিত হয়। যেহেতু ঘোষণা হয়নি, তাই নয়া হারে ডিএ পাবেন না লক্ষ লক্ষ কর্মী। ইতিমধ্যেই এই চাপ কেন্দ্রের মাথায় চেপে বসেছে। তার উপর নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে বাস্তব রূপ সামনে চলে আসে, ভোটবাজারে দর তলানিতে নামবে বিজেপির। তাই এই পন্থা অবলম্বন।
আরও পড়ুন: বাড়তি আরও ৪ শতাংশ ডিএ পেলেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা
যে পণ্যগুলিকে বাছাই করে জিনিসপত্রের দাম ওঠা-নামার হিসেব সরকার কষছে, শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা আদৌ সেসব পণ্য রোজ কেনেন কি? তা যদি না হয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির ওই সূচকের গুরুত্ব নেই। শিল্পমহলের বক্তব্য মেনে আলাদা সূচক প্রকাশ করে শ্রমমন্ত্রকের আওতায় থাকা লেবার ব্যুরো, যার নাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার সিপিআই। ১৯৬০ সালে সূচক নির্ধারণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, শেষবার তার মাপকাঠি স্থির হয়েছে ২০১৬ সালে। জিনিসপত্রের দামকে ‘১০০’ ধরে সূচকটি তৈরি হয়। জানুয়ারিতে সেই সূচক ছিল ১৩৮.৯। অর্থাৎ, যে জিনিসের দাম ২০১৬’তে ১০০ টাকা ছিল, মূল্যবৃদ্ধির জেরে এখন ১৩৮ টাকা ৯০ পয়সা।
তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসের সূচক ছিল যথাক্রমে ১৩৭.৫, ১৩৮.৪, ১৩৯.১ এবং ১৩৮.৮। জানুয়রিতে ১৩৮.৯। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম দেওয়া যায়নি। শিল্পক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে যে পণ্য বাছাই করা হয়, তার তালিকা সরকার নিজেই ঠিক করে। তার জন্য শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয় না। কোনও শিল্প সংগঠন বা বণিকসভারও মতামত নেওয়া হয় না। সরকার নিজের খেয়ালখুশি মতো পণ্য বাছাইয়ের ফলে মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত তথ্যও সামনে আসে না। ফলে আর্থিক বঞ্চনার আশঙ্কা সবসময়ই থেকে যায়। যেহেতু এই সূচকের সঙ্গে কর্মীদের প্রাপ্য জড়িত, তাই তাঁদের ন্যায্য পাওনায় সরকার ছেদ ফেলতে পারে না।
মোদির আমলে তো সব জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি কোথায় পৌঁছেছে, রান্নাঘরে বসেও তার আঁচ পাচ্ছে গৃহস্থরা। সংসার চালানোই দায়। কিন্তু মোদিজি তো কারও কথা কানে তোলেন না। নিজের মর্জিমাফিক চলেন। তাই সত্যিটা ঠেলে পাঠান কার্পেটের তলায়।
এদের তৃতীয় অস্ত্র মিথ্যা প্রচার করে আপন মহিমা বর্ধন এবং চির স্মরণীয় রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বদের প্রভাব লঘুকরণ।
এই তালিকায় প্রথম নামটি মহাত্মা গান্ধীর।
দেশবাসীকে খাদ্যসুরক্ষা তিনি দিয়েছেন, ব্যাঙ্কের সুবিধা আমজনতা পেয়েছে তাঁর আমলে, স্বনির্ভরতাও নাকি তাঁর দান। নরেন্দ্র মোদির এইসব অলীক দাবি সঠিক ধরে নিলে, ২০১৪ সালের আগে ভারত আদিম যুগে পড়েছিল। তিনিই উদ্ধার করেছেন। এসব চলছিলই। তারপর যাবতীয় সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, ১৯৮২ সালে গান্ধীজিকে নিয়ে সিনেমা তৈরির আগে তাঁকে বিশ্বের কেউ চিনতই না! অর্থাৎ, রিচার্ড অ্যাটেনবরোর অস্কারজয়ী সিনেমা ‘গান্ধী’ই জাতির জনককে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি দিয়েছে।
বারাণসী, দিল্লি, আমেদাবাদে গান্ধীবাদী প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করেছে এই মোদি সরকার। আরএসএস কর্মীরা গান্ধীর জাতীয়তাবাদকে গুরুত্ব দেন না। গেরুয়া পরিবারের নাথুরাম গডসে খুন করেছিল গান্ধীজিকে। আর, ২০২৪ সালের এই লোকসভা নির্বাচন গান্ধী অনুগামী বনাম গডসে অনুগামীদের লড়াই।
গুরুজনেরা বলেন, যখন কোনও ব্যক্তির উপর আমিত্ব চেপে বসে, তাঁর কপালে হরি বা জন, কেউই জোটে না। কতটা দুরবস্থা হলে উনি বলতে পারেন, একজন ইংরেজ একটা সিনেমা বানানোর আগে কেউ গান্ধীজিকে চিনত না! বাহ! দুর্ভাগ্যজনক, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এত কম জানেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বোধহয় গান্ধীজিও স্রেফ একটা পিআর স্টান্ট।
এসব করে মোদি ভাবছেন, এবারও নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবেন। কিন্তু আমরা, দেশের সাধারণ মানুষ জানি, ওদের নৌকো এবার ডুবছে। পদ্ম ফুটবে না আর এবার।