অটল অহমিকা কীভাবে গণতন্ত্রের ভিতটিকে নষ্ট করে দিতে পারে, এক দশক ধরে সেটা দেখিয়েছে মোদি জমানা। রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন, ‘অহংকার থেকেই নিজের সামর্থ সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়, সেই অহংকারের মধ্যেই নিহিত থাকে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মধ্বংসের বীজ।’ মোদি সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করেছেন বিগত এক দশক ধরে। যে কোনও ধর্মেই ধার্মিক অপেক্ষা ধর্মভীরু মানুষ বেশি। এই সংখ্যাধিক্যের মনকে লক্ষ্য করে যে দল রাজনৈতিক কর্মসূচি নেয়, তার এক প্রচ্ছন্ন গ্রাহ্যতা, মান্যতা থাকে। বিজেপি সেটা ভালমতোই জানে। তাই মন্দিরকে কেন্দ্র করে ‘হিন্দুরাজ’-এর ধ্বনি তোলা জাতীয়তাবাদী মেরুকরণের রাজনীতি বিধ্বস্ত জনসাধারণের দাবির অভিমুখকে বিজেপি ঘুরিয়ে দেয় সহজেই। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থানের অব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, এমন সমস্ত মৌলিক সমস্যা হারিয়ে যায় ধর্মভিত্তিক বিভাজনকারী রাজনীতির অন্ধকারে! আর নেপথ্যে জেগে থাকে আমাদের বিবেকের মতো আমাদের রবীন্দ্রনাথ, যিনি বলে চলেন, ‘যে-রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে, সে-রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে-ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে।… ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল।’
আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশে আবারও তাপপ্রবাহের জেরেই কি মৃত্যু ১৩ ভোটকর্মীর?
আমাদের দেশে ১০০০ মানুষ পিছু ০.৫টি হাসপাতালের বেড আছে। ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আমাদের গ্রামীণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নেই। ২০২৩ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের গ্রামাঞ্চলের ১৪-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের ২৫ শতাংশ নিজের মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যবই পড়তে হোঁচট খায়। গ্রামের এই বয়সের ৫০ শতাংশ ছেলেমেয়ে সাধারণ ভাগের অঙ্ক করতে গিয়ে আটকে যায়। অথচ, আমাদের দেশে হাজার হাজার সরকারি বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের এই বেহাল অবস্থার পরিবর্তন করার পরিবর্তে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে ভোটের তাস খেলা হচ্ছে। ভারত বলতে যাঁরা শুধু বোঝেন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান, বাঙালির আদর্শের সর্বাঙ্গে সাম্প্রতিক এই আঘাতগুলি দেখেও যাঁরা আশ্রয় খোঁজেন মিথ্যে প্রতিশ্রুতির কাছে, তাঁদের উদ্দেশ্যে আজও বাজে সেই অমোঘ উচ্চারণ, ‘মিথ্যারে রাখিয়া দিই মন্দিরের মাঝে বহু যত্নে, তবু সে থেকেও থাকে না। সত্যেরে তাড়ায়ে দিই মন্দির বাহিরে অনাদরে, তবুও সে ফিরে ফিরে আসে।’
পুরাণে দেখি অসুররা নিজেদের ভগবানের থেকেও বড় বলে মনে করতেন। মধ্যযুগের ইতিহাসে এমন অনেক রাজার নাম পাওয়া যায়। এই পরম্পরার নতুনতম রূপ মোদি। ওড়িশার বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র তাই বলতে পারেন, প্রভু জগন্নাথ হলেন মোদিজির ভক্ত। আমরা বেশ বুঝতে পারি, নিও নাৎসিজমই আজ নিও হিন্দুইজমের ভেক ধরে এসেছে।
আরও পড়ুন-ওভারহেড তার ছিঁড়ে পুরীগামি নীলাচল এক্সপ্রেসে রক্তাক্ত যাত্রী
এবারের নির্বাচনে মোদি কতটা সফল হতে পারবেন, বোঝা যাবে ৪ জুন। তবে অনেকেই বলছেন, ওটাই বিজেপি সরকারের এক্সপায়ারি ডেট। এই পৃথিবীতে এখন মোদিকে রামচন্দ্র, হনুমান, শিবজি, গোমাতা বাঁচাবেন কি? একমাত্র বাঁচাতে পারে ইভিএমের কারসাজি। এছাড়া নেই কোনও পরিত্রাণ!
কী না বলেছেন মোদি এই নির্বাচনে খড় কুটো ধরে বাঁচার জন্য!
১) বিরোধীরা জয়ী হলে হিন্দু নারীর মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে। ২) হিন্দুদের দুটো মহিষ থাকলে একটি মহিষ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দেওয়া হবে। ৩) আমি জৈবিকভাবে জন্মগ্রহণ করিনি। আমাকে ঈশ্বর মানুষের সেবার জন্য পাঠিয়েছেন। ৪) ১৯৮২ সালে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর সিনেমার আগে গান্ধীজিকে বিশ্বের কেউ চিনত না। ওই গান্ধী নামক সিনেমাই তাঁকে চিনিয়েছে। ৫) বিরোধীরা যতই মুজরা করুক, আমার সিদ্ধান্তকে বদল করতে পারবে না।
এ-সবই মোদি উবাচ। এই বুজরুকি বাবার জমানায় কী কী ঘটেছে একবার রোমন্থন করে নেওয়া যাক।
১) ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মোট স্থায়ী কর্মী ছিলেন যথাক্রমে ১৭.৩ লক্ষ ও ১৬.৯ লক্ষ। মোদি জমানায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে ১৪.৭ লক্ষ ও ১৩.৭ লক্ষ। অর্থাৎ, প্রায় ৩ লক্ষ কর্মী কমেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে সরকারি নিয়োগের হারও আগের জমানার ৪২.৮ শতাংশ থেকে কমে এই জমানায় হয়েছে ৩৭.৪ শতাংশ। এর উল্টোদিকে মোদি জমানায় চুক্তি শ্রমিক বেড়েছে হু হু করে।
২) এই জমানায় সিবিআই, ইডি, আইটি’র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি যথারীতি সক্রিয়। বলা বাহুল্য, তাদের এই অতিসক্রিয়তার এক ও একমাত্র লক্ষ্য তৃণমূল কংগ্রেস সহ একাধিক বিরোধী দল এবং রাজ্য সরকার। অনেক ক্ষেত্রে আদালতকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যে পার্টি ৫৪৩-এ ৪০০+ পাওয়ার হকদার বলে মনে করে তার মনে ভয় কি দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছে? ৪০০ দূর, যেমন-তেমন গরিষ্ঠতা লাভ নিয়েও নিশ্চয় ভীষণ সংশয়ে এখন মোদি-শাহরা? কারণটা তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানেন— উনিশের ‘অভাবনীয়’ সাফল্যের অন্দরের চেহারা মোটেই স্বস্তিদায়ক ছিল না। বিজেপি এককভাবে পেয়েছিল মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ। সংখ্যাটি এনডিএ’র ক্ষেত্রে ছিল ৪৫। অর্থাৎ দল এবং জোট— দু’ভাবেই গেরুয়া শিবিরের প্রতি মানুষের সমর্থন ছিল ৫০ শতাংশের অনেক নিচে বা ভারতের বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের চায়নি। তবু তাঁরা ক্ষমতায় ফিরেছিলেন, সে নিতান্তই ছিল সংখ্যার মাহাত্ম্য এবং ভাগ্যের পক্ষপাত। এবার আর সেটা হবে না। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-ট্রফি হাতছাড়া, কান্না রোনাল্ডোর
৩) মোদি অহরহ এমন কিছু ‘সংকল্প’ করেন এবং ‘গ্যারান্টি’ দেন, সর্বোপরি ‘সরকারি তথ্যের’ নামে যেসব পরিসংখ্যান পরিবেশন করেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! তাঁর এমন কীর্তিগাথায় সর্বশেষ সংযোজন— ‘দেশে দৈনিক দুটি করে কলেজ স্থাপন!’ তাঁর এক দশকের ‘অত্যাশ্চর্য উন্নয়নমুখী’ শাসনকালের ফিরিস্তি দিতে গিয়েই তিনি এই কাণ্ড করে বসেছেন। বলা বাহুল্য, এই প্রসঙ্গে তাঁর দেওয়া তথ্যের সঙ্গে তাঁরই সরকারের তরফে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের ফারাক বিস্তর! রাজনীতি কিংবা সরকারের শীর্ষ পদে তিনি আনকোরা নন, যথেষ্ট অভিজ্ঞ বা পোড়-খাওয়া এক ব্যক্তিত্ব। তাই এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই যে, তিনি এসব মুখ ফসকে বলে ফেলেন। বরং এটাই আসল কথা যে, তিনি সবই বলে চলেছেন রীতিমতো অঙ্ক কষে। কিন্তু এমন অবান্তর তথ্য, পরিসংখ্যান, দাবি, গ্যারান্টি প্রভৃতি তাঁকেই পরিবেশন করতে হতে পারে, যাঁর সত্যের ঝুলিটা একেবারেই ফাঁকা! যাঁর হাঁড়ির হাল বাস্তবে বড়ই করুণ। এমন মিথ্যুক মোদিকে এবার বিদায় করা দরকার।
আজ আসুন, দিকে দিকে ইভিএম-এ বোতাম টিপে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত করি। জয়তু জোড়া ফুল।