অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রের উৎসবের দিকে চোখ রেখেছে গোটা বিশ্ব। আমরা যারা এদেশের নাগরিক, আমরা উদযাপন করেছি আমাদের এই উৎসবকে। কিচ্ছু না পাওয়া নাচার এদেশের কোটি কোটি জনতা প্রয়োগ করেছেন নিজেদের ‘সাংবিধানিক অধিকার’। এটাই তো এই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। যেখানে একজন কোটিপতি এবং একজন সহায় সম্বলহীন একই লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করেন৷ হাতের তর্জনীতে কালির দাগ প্রমাণ করে, আমরা ‘নাগরিক’। ভোটের ফল কী হবে তা জানা যাবে ৪ জুন। কিন্তু, এই নির্বাচন আসলে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেল, ‘ঘৃণা’ এদেশের অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। আরও স্পষ্ট করে বললে, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আসলে এদেশের রাজনীতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে। সৌজন্যে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (Shame On BJP)। এই ঘৃণাকে এড়িয়ে চলা মানে, আপনি দুর্বল। অনবরত ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা এবং ঘৃণার সম্ভাষণ এই অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনকে আলাদা এক তাৎপর্য দিয়ে গেল।
যেখানে আগামী প্রজন্মকে বার্তা দেওয়া গেল, ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াও! তবেই টিকে থাকবে! দেশের সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করো! বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সম্পর্কে ভদ্রসমাজে উচ্চারণের অযোগ্য শব্দে আক্রমণ করো। এটাই রাজনীতি। বিভ্রম হয়! যখন দেখি ক্রমাগত কুৎসা করে যাওয়া সেই ব্যক্তিই আবার গান্ধীজির পরিচিতি নিয়ে ভাবিত হন! যখন মনে পড়ে, আসলে এই পবিত্র মাটি বুদ্ধ-শঙ্করাচার্য-কবীরের মাটি। সেই মাটিতে স্রেফ ভোট প্রচারে কী পরিমাণে ঘৃণার উদগীরণ হল!
ক্ষমতার নেশা ভয়ংকর নেশা। তাই ক্ষমতার চেয়ারে বসে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে দেখানোটাই দস্তুর। বহির্বিশ্বের সামনে ‘শান্তির ললিত বাণী’ শোনানোই যায়। কিন্তু, সেই ক্ষমতা পুনরায় ফেরানোর জন্য দাঁত- নখ বের করে হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় আচরণ করতে হয়। যেন, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ঈপ্সা! আর সেই জ্বালামুখ থেকে গলন্ত লাভার মতো বেরিয়ে আসছে একের পর এক ঘৃণার সম্ভাষণ! কখনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হচ্ছে, ওরা জিতলে মুসলমানদের সুবিধা! মুসলমানদের গাদা গাদা বাচ্চা হয়! বিরোধীরা জিতলে ওরা দেশের সব সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেবে! ‘হিন্দু’ মা-বোনেদের ঘরের গয়নাও সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে বিরোধীরা! বিবাহিত নারীদের ‘মঙ্গলসূত্র’ও সুরক্ষিত থাকবে না!
মিথ্যা-সত্যের অপলাপ এবং গুজব! এটা একটা প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় ভারতের একটা বড় অংশের মানুষের মস্তিস্কে ঢোকানো হয়েছে ‘জে-এন-ইউ’-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আসলে দেশবিরোধীদের কারখানা। ওখানে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’এর সদস্যরা পড়ে!
আরও পড়ুন- অসমে বন্যায় ঘরছাড়া লক্ষাধিক, ক্ষতিগ্রস্ত চার লক্ষের বেশি
যে প্রক্রিয়া ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মধ্যের ঐক্যকে বিনষ্ট করে ‘৮০-২০’-এর ধারণাকে প্রবেশ করিয়েছে! যে প্রক্রিয়াতে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন, বিরোধীরা জিতলে তা হবে ‘তালিবানি’ শাসন! এই যে প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি ঘৃণা ছড়িয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন এই ঘৃণাই আসলে তাঁর রাজনৈতিক দলের প্রধান অস্ত্র। মুখে তিনি যতই গান্ধীর কথা বলুন, আদতে তাঁর দলের ডিএনএ-তে যে গান্ধী-বিরোধী এবং গান্ধী-হত্যাকারীরা রয়েছেন তা অস্বীকার করবেন কী করে? তাই হয়তো, একজন সদ্য প্রাক্তন বিচারপতি যখন বিজেপির প্রার্থী হন, আর তাঁকে যখন পরিচিত গণমাধ্যমের সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘‘গান্ধী না গডসে?’’ সেই বিজেপি প্রার্থীকে বলতে হয়, ‘এর উত্তর আমাকে ভেবে বলতে হবে!’
বিবমিষা হয় এসব দেখে! লজ্জা লাগে। বুঝতে হয়, এটাই তো এই অমৃতকালের স্বাভাবিক ঘটনা। এই সব ঘটনা দেখেও, আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। কারণ, ওই যে ক্ষমতার গদির সেই অদ্ভুত নেশা। যে নেশা উন্মাদ করে দেয়। সেই উন্মত্ততা, ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান ভুলিয়ে দেয়৷ সেখানে ‘হোয়াটস বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ছড়ানো হাজার একটা মিথ্যে অবলীলাক্রমে বলে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, বাংলা আসলে ‘রোহিঙ্গা’, ‘ঘুসপেটিয়া’য় ভরে গেছে। এখানে সবাই অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশি। লক্ষ্য করে দেখুন, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ-যোগী আদিত্যনাথেরা ঠিক এই কথাগুলোই বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভাগুলো থেকে বললেন। যেগুলো বললেন, সেগুলো গত কয়েক বছর ধরেই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে রটছে! পরিকল্পিতভাবে একটি রাজ্যের মানুষকে অপমান করতে রটানো হয়েছে। পার্থক্য এটাই যে, এতদিন যেসব মিথ্যে রটনা বিজেপি আইটি সেলের বেতনভুক কর্মচারীরা করতেন, নির্বাচনের মরশুমে সেই সব মিথ্যে রটনাই নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ’দের মুখে উঠে এসেছে!
এই যেমন ‘নবরাত্রি’র সময়ে কেউ আমিষ খেলে সে আর ‘সেহী হিন্দু’ থাকে না! এই নির্বাচনের মরশুমে এই আমিষ-নিরামিষ খাওয়া নিয়েও মঞ্চে বক্তব্য রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি। আসলে, নিশানা করতে চেয়েছেন দেশের সংখ্যালঘুদের! আসলে এর পিছনে তাঁর অজ্ঞতাই দায়ী। পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের একটা বৃহত্তর অংশের মানুষ নিরামিষাশী। এটা তাদের খাদ্যাভাস। তাই বলে গোটা দেশ নিশ্চয়ই নিরামিষ আহার খান না! নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা হয়তো নিরামিষ খান। কিন্তু বিরিয়ানি মোঘলদের খাদ্য, তাই বিরিয়ানি খেলেই আপনি আর ‘সেহী হিন্দু’ নন এমন অসংখ্য মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়ানো হয়। এই লোকসভা নির্বাচনের মরশুমে, সেই আমিষ-নিরামিষ দ্বন্দ্বও উঠে এল নরেন্দ্র মোদির (Shame On BJP) মুখে।
এছাড়াও বিজেপির ছোট-বড়-মেজো অসংখ্য নেতা তো তাঁদের বিভিন্ন ভাষণে ঘৃণার ফুলঝুরি ছোটালেনই! কেউ কেউ সরাসরি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হবে জানিয়ে দিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ বলে আসলে কিছু হয় না এমন একটা কথাকে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন বিভিন্ন বিজেপির মুখপাত্ররা! হিন্দি সংবাদমাধ্যমের সান্ধ্য আলোচনায় যে পরিমাণে বিদ্বেষ এবং বিভেদ ছড়ানো হল তা যে কোনও জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে এবং দেশের যাবতীয় বিরোধী দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে যে পরিমাণ মিথ্যে ছড়াল এদেশের সংবাদমাধ্যমগুলি, তা ভারতের গণতন্ত্রের একটি কালো অধ্যায় বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে কোনও এক রাজনীতির ছাত্র থিসিস লিখবে, এদেশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সার্বভৌমত্ব-ধর্মনিরপেক্ষতা, সর্বোপরি সংবিধানকে ধ্বংসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছিল ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলি। বরং সামাজিক মাধ্যমে ‘স্বাধীন’ভাবে যে ক’জন সাংবাদিক বা ইউটিউবার-রা বারবার প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে তাদের চরিত্র হনন করতে নেমে পড়েছে গোটা বিজেপি (Shame On BJP) আইটি সেল। আশ্চর্যজনকভাবে, সেখানেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে থেকেছে ‘গোদি’ মিডিয়ার কিছু সঞ্চালক!
এই মাটিতে বসে সন্ত কবীর লিখেছিলেন, ‘‘মিঠো ঘন রে, রাম রস… যোগিজি যো পিয়ে অমর হোই যায়…” সেই কবীরের মাটিতে, রামলালার মাটিতে দেশের তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, যে অবিরাম ঘৃণার বর্ষণ দেখল গোটা দেশ তথা গোটা পৃথিবী তা আসলে আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়। সংখ্যাগুরুর সংখ্যাধিকত্ববাদ কোনও সুস্থ গণতন্ত্রের পরিচায়ক নয়৷ বহুত্ববাদই আমাদের গণতন্ত্রের মূল নিউক্লিয়াস। সেকথা ভুলে যেভাবে ঘৃণার বেআব্রু প্রদর্শন হল তা ভবিষ্যতের জন্য এক অত্যন্ত নিন্দাজনক উদাহরণ হয়ে থাকল। নরেন্দ্র মোদি-যোগী আদিত্যনাথ-অমিত শাহেরা আসলে ঘৃণাটুকুই ছড়াতে পারেন (Shame On BJP)। এটুকুই তাঁদের সীমাবদ্ধতা। তাঁদের আস্ফালনের সীমারেখা ওই দানবিক ‘বুলডোজারে’ করাতেই সীমাবদ্ধ। কবীরের সুরে রামলালার ভজনার জন্য সাধনার প্রয়োজন হয়। সে-সাধনার পথ বড্ড কঠিন। একরাশ হিংসা-ক্লেশ-অসূয়া ছড়িয়ে সাধনমার্গের পথে পৌঁছনো যায় না…।