শনিবার লোকসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত দফার ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। আর তার পরেই প্রকাশ্যে এসেছে বুথফেরত সমীক্ষা। বুথফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত, শরিকদের নিয়ে তৃতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। সেক্ষেত্রে সবকিছু ঠিক থাকলে প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদিই। বুথফেরত সমীক্ষার সেই হিসাব দেখেই নতুন উচ্চতায় ভারতের শেয়ার বাজার। এক লাফে বৃদ্ধি সেনসেক্স এবং নিফটির।
আরও পড়ুন-শেষ ভোট, গণনার আগেই বাড়ছে জাতীয় সড়কের টোল ট্যাক্স
উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে আদানি পোর্টস, আদানি এন্টারপ্রাইজের মতো সংস্থাগুলির শেয়ারদর।
কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা অস্থিরতার পরে বুথ ফেরত সমীক্ষা সূচকের পালে হাওয়া জুগিয়েছে। এনডিএ-র ‘চারশো পার’ স্লোগানে কয়েকদিন আগেই ৭৫,০০০ পেরিয়ে নজির গড়েছিল সেনসেক্স। লেনদেন চলাকালীন একদিন সেনসেক্স ৭৬,০০০ পার করেছিল। তবে এর পরেই আশঙ্কা গ্রাস করে লগ্নিকারীদের। জল্পনা ছড়ায়, আশার তুলনায় কম আসন পেতে পারে বিজেপি। ফলে পতন শুরু হয়। গত সপ্তাহের প্রথম চারদিনে সেনসেক্স ১৫২৫ পয়েন্ট পড়ে গিয়েছিল। শেয়ার বাজারে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা। তবে বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ্যে আসতেই আবার গতি পেয়েছে ভারতের শেয়ার বাজার।
বোঝাই যাচ্ছে কেন এক্সিট পোলের হিসাব বিজেপির অনুকূলে প্রকাশের আবশ্যকতা পড়েছিল। গোপন কথাটি আর রইল না গোপনে।
শেয়ার বাজারের পাশাপাশি আর একটা বাজারেও এক্সিট পোলের হিসাব অনুকূল হাওয়া তুলেছে। ভারতের অন্যতম সাট্টা বাজার রাজস্থানের ফলোদী। ৫৪৩ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোন দল সরকার গড়বে? ভবিষ্যৎ আঁচ করে এই সাট্টা বাজারে বাজি ধরেন বুকিরা। বুথ ফেরত সমীক্ষার মতোই ফলোদীর সাট্টা বাজার এনডিএ-কে এগিয়ে রাখছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় আইনের চোখে সাট্টা বা বাজি ধরা বেআইনি। তাই ফলোদী বাজারের কারবার চলে অন্তরালে। সেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার কারবার চলে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে দেশ জুড়ে ৭০ আসনের গণ্ডি পেরোবে না কংগ্রেস— ফলোদীর সাট্টা বাজারের এই পূর্বাভাস মিলে গিয়েছিল। ২০২৪-এও সেই ধারা বজায় থাকছে, এই আশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এক্সিট পোলের নাটক।
আরও পড়ুন-স্বস্তির বার্তা রাজধানীতে
ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, বুথ ফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত যে সব সময় মেলে, এমন নয়। বুথফেরত সমীক্ষা একেবারে ভুল প্রমাণিত হওয়ার উদাহরণও অসংখ্য। বুথ ফেরত সমীক্ষার মতোই সাট্টা বাজারের পূর্বাভাস কখনও মেলে, আবার কখনও মেলে না।
এক-দেড় মাস আগেও জানছিলাম ধ্যানেন্দ্র মোদিজির কোনও বিকল্প নেই। বিকল্পহীন জনসমর্থন প্রাপ্ত পার্টির নাম হল বিজেপি। কিন্তু শেষ দেড় মাসে দেখলাম, সেই একক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় আরও কিছু কৃষ্ণ অশ্বের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, যিনি সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হতেই চাননি বিগত এক দশক ধরে, সেই মোদিজি ৮০-৮৫টা সাক্ষাৎকার দিলেন। বলা বাহুল্য, সবক’টাই স্ক্রিপ্টেড ইন্টারভিউ। কেন এমন ভোলবদল?
নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রকৃতির তাপপ্রবাহ ব্যতীত আর কোনও তরঙ্গ প্রবাহ নির্বাচনী পরিসরে অনুভূত হয়নি। ২০১৯-এর নির্বাচনে মোদি ঝড়ের আনুকূল্যে বিজেপি ২৭২টি আসন (মোট আসন সংখ্যার অর্ধেক) ছাড়িয়ে আরও ৩১টি আসন জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে, নিস্তরঙ্গ আবহে সেই সংখ্যার ধারেকাছে পৌঁছনো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় প্রকট হয়। এই সংকটের আবহ ঘনীভূত করে আরও দুটি অনুমান। এক, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বিহারে আগের বারের তুলনায় এবার কম আসন পাবে বিজেপি। এবং দুই, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও রাজস্থানে মুখ থুবড়ে পড়বে পদ্মপার্টি। এই সম্ভাবনা চিত্র সামনে আসামাত্র বিজেপি শিবির থেকে জোর দিয়ে বলা শুরু হল, ওই খামতি পুষিয়ে পদ্ম-ঝুলি উপচে দেওয়ার জন্য তৈরি পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ। নরকুলে ইন্দ্র করে পরমাত্মা যাঁকে পাঠিয়েছেন, সেই ব্যক্তিও বলতে শুরু করলেন, ওই চারটি রাজ্যে অপ্রত্যাশিত সাফল্যের উষ্ণীষ পরার জন্য অপেক্ষমাণ তিনি। সহজ অঙ্ক নাকি জটিল এক জিজ্ঞাসা?
এতদিন জানতাম জোটসঙ্গী বাছতে বিজেপি-র ভুল হয় না। কিন্তু এবারই দেখলাম, উল্টোটা ঘটছে। অকালি দল এবং উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার মতো পুরনো সঙ্গীরা সম্পর্কের তিক্ততার কারণে পদ্ম শিবির পরিত্যাগ করেছে। তার জায়গায় এসে জুটেছে শিন্ডে সেনা, অজিত পাওয়ারের এনসিপি। দুটো দলই যথাক্রমে বাল ঠাকরে ও শরদ পাওয়ারের উত্তরাধিকারের বৈধতা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে, এখনও পুরোদস্তুর সফল হয়নি। জুটেছেন পাল্টিকুমার শিরোপাপ্রাপ্ত নীতীশ কুমার, যাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। আর জুটেছে কেলেঙ্কারিতে মাখামাখি দেবেগৌড়া পরিবার। জোটসঙ্গী চয়নে এরকম ভ্রান্তি ইতিপূর্বে বিজেপি করেনি। সেসব সত্ত্বেও বিজেপির এমন জয়জয়কার! কীভাবে?
আরও পড়ুন-তাজ এক্সপ্রেসে ভয়াবহ আগুন, হতাহতের খবর নেই
১ জুন দিনভর পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলো হিংসা, ভুয়ো ভোটার, বিরোধী প্রার্থীদের শাসকদলের তরফে ব্যারাকিং, এসব নিয়ে গলা ফাটিয়ে গেল। অথচ দিনের শেষে, এক্সিট পোলের হিসাব অনুযায়ী বিজেপির ফল আশাতীত হয়ে গেল। কেমন করে? হিসাব মিলছিল না কিছুতেই। কিন্তু সোমবার শেয়ার বাজার খুলতেই আর বেআইনি সাট্টা বাজারের খবর সামনে আসতেই সব জলের মতো পরিষ্কার। কীসের জন্য এত মিথ্যার বেসাতি, তা নিয়ে আর ধন্দ নেই।