অনিতা চক্রবর্তী
জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi 2024) আমার কাছে খুব ভাল লাগার একটা দিন। গতবছর তো বিশ্বনাথ কলকাতায় ছিল না ফলে জামাইষষ্ঠীটা করতে পারিনি কারণ ওর সময়টা ম্যাটার করে। কিন্তু কলকাতায় থাকলে প্রতিবছর জামাইষষ্ঠী করিই। এবছর আছে বিশ্বনাথ তাই এবারটা হবে। হাওড়ার সালকিয়াতে আমার বাড়ি। পাশেই গঙ্গা। সকালে উঠে আগে গঙ্গায় যাই ওখানে ষষ্ঠীতলায় পুজো করিয়ে নিয়ে আসি। ওখান থেকেই ষাটগাছের ডালা সাজিয়ে আনি পাখাও থাকে আর থাকে হলুদমাখা সুতো। ফিরে এসে ষাটগাছে জল ছিটে দিয়ে পাখার বাতাস দিয়ে মেয়ে এবং জামাইকে তারপর হলুদ সুতোটা পরিয়ে দিই। ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করি। চিঁড়ে দই, খইমাখা মুখে দিতে হয়, তার সঙ্গে পাঁচফল, খেজুর, মিষ্টি দিতে হয়। জামাই বরণটা এভাবেই করতে হয় আমাদের। এরপর দুপুরে ও খাওয়াদাওয়া করে। দুপুরে আসতে না পারলে রাতেও এসছে কখনও কখনও। বিশ্বনাথের বাঙালি খাবারই পছন্দ। আমি সাদাভাত, পাঁচরকম ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, চিংড়িমাছের মালাইকারি, পটলের দোরমা, ভেটকিমাছ, পাঁঠার মাংস করি সঙ্গে চাটনি, মিষ্টি থাকে। পটলের দোরমা খুব ভালবাসে বিশ্বনাথ। জামাইষষ্ঠীর আগে ওদের জিজ্ঞেস করি কী নেবে, সেটাই ওদের কিনে দিই। এবছর মেয়েকে শাড়ি আর জামাইকে পাঞ্জাবি দেব ঠিক করেছি। আমি নিজেই এখনও পর্যন্ত সব রান্নাবান্না করি। বিশ্বনাথ আমাকে শাড়িই দেয় বেশিরভাগ সময়।
বন্দনা চট্টরাজ
আমার দুই মেয়ে, তার মধ্যে শ্রীময়ী ছোট। বড় মেয়ের বিয়ে অনেক আগে হয়েছে ফলে অনেক বছর ধরেই ওদের জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi 2024) করেছি। এ-বছর যোগ হয়েছে আমার ছোট মেয়ে। ওদের বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠী। আমরা ঘটি আমার শাশুড়ি যখন বেঁচে ছিলেন অনেক কিছু নিয়ম করতেন এই দিনটায়। কিন্তু আমি অত নিয়ম করি না। তবে ষষ্ঠীপুজো করি, আমাকে সেদিন ফলার খেতে হয়। দই, চিঁড়ে, আম, মিষ্টি মেখে ওটাই আমি খাই। কাঞ্চনকেও ফলার দেব কারণ এটা জামাইকেও দিতে হয়। হাতে হলুদ সুতো বেঁধে দেওয়াটা এই বংশের রীতি তবে পাখার বাতাস দেওয়ার রীতিটা আমাদের নেই। এতদিন ধরে সব রান্না আমি নিজে করতাম। এলাহি আয়োজন হত। এখন আমার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না তাই অতটা আর পারছি না। কাঞ্চন খুব খেতে ভালবাসে। বাঙালি খাবারই ওর পছন্দ। মাটন আর ইলিশ মাছ ফেভারিট। ওই দুটো পদ করবই। সঙ্গে ভাত, পাঁচরকম ভাজা, ডাল, চাটনি, মিষ্টি। আর রাতে রেস্তোরাঁয় খেতে যাবার প্ল্যান আছে। আমি ওদের দু’জনের জন্য শাড়ি আর ধুতি-পাঞ্জাবি কিনে দিয়ে দিয়েছি। কাঞ্চনের শ্যুটিং রয়েছে তাই ও কীভাবে আসবে সেটা জানি না। তবে ষষ্ঠীর সুতোটা সকালেই বাঁধতে হয় ফলে ওকে তো একবার আসতেই হবে তখন জানব ও কী করবে।
দেবযানী কুমার
জামাইষষ্ঠীটা খুব বড় করেই হয় আমার বাড়িতে। আমরা যেমন মেয়ে জামাইকে নিয়ে জামাইষষ্ঠী করি ঠিক তেমনই এখনও আমার বর দেবাশিস কুমারেরও জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi 2024) হয়। আমার মা করেন। সেখানেও আমার জামাই গৌরবের নিমন্ত্রণ থাকে। নাতজামাইকে ছাড়া আমার মা জামাইষষ্ঠী পালন করবেনই না। আমার মেয়েও ছোটবেলা থেকে দেখেছে যে বাবার জামাইষষ্ঠীটা বড় করে হয়। ওর মধ্যেও বিষয়টা ঢুকে গেছে। ও খুব পছন্দ করে এইদিনটা আর গৌরবও। এই বছরও হবে জামাইষষ্ঠী তবে মায়ের বাড়িরটা দিনের দিন হবে না কারণ লন্ডন থেকে আমার বোনের বর আসছে ঠিক তার দু’দিন পরেই। তো আমি মাকে বললাম ওর তো আসা হয় না এবার যখন জামাইষষ্ঠীর পরেই আসছে তাহলে ও এলে একসঙ্গে কোরো। তাই মায়ের বাড়িরটা দুদিন পরে হবে। আমার বাড়িতে দেবলীনা আর গৌরব সকালেই চলে আসে। আমি ষাটগাছ আর প্রদীপের ডালা সাজিয়ে বরণ করি। ছ’টা গাছ দিয়ে হয় ষাটগাছ। ওটা কিনতেই পাওয়া যায়। আমার বাপের বাড়িতে যে কোনও শুভদিনে কলার বড়া করতে হয় সেই নিয়মটা আমিও এখানে করি। কলার বড়া তৈরি করি। সেই বড়া আর পায়েস দিয়ে মিষ্টিমুখ করাই সঙ্গে পাঁচটা ফল আর মিষ্টি দিই। জামাইষষ্ঠীতে আমি সাতরকম মাছ করি। কারণ গৌরব ভীষণ মাছ ভালবাসে ইলিশ, পাবদা, পমফ্রেট, চিংড়ি, কাতলা, তপসে, মৌরলা। মৌরলা মাছ ওরা ভাজাই খায়। পাঁচরকম ভাজা করি যার মধ্যে আলুভাজা, কাঁচকলা ভাজা আর শাকভাজাটা মাস্ট। শুক্তো, ডাল থাকে। গৌরব একদম চাটনি খায় না। দই আর মিষ্টি রাখি শেষপাতে। মাংস করি না কারণ মাটন আর ফিশফ্রাইটা আমার মা করে বরাবর জামাইষষ্ঠীতে। এর সঙ্গে মা করে লুচি, ছোলার ডাল। দেবাশীষ আর গৌরব দুজনেই হাঁসের ডিম খেতে ভালবাসে তাই ওটা মা করেই। প্রথম বছর জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব করেছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে আমি ওদের টাকা দিয়ে দিই। আমার মাও টাকা দেয় সবাইকে। ওইদিন আমার ষষ্ঠী থাকে। আমার শ্বশুরবাড়িতে সব ষষ্ঠী রয়েছে আমি সব করি। তাই সব মিটে গেলে আমরা নিরামিষই খাই।
আরও পড়ুন- লক্ষ্মীবাহিনীর গর্জন, নারী-বিরোধীদের বিসর্জন
কৃষ্ণা বসু
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি মানুষের সবচেয়ে জরুরি স্পন্দন হল সম্পর্কের স্পন্দন। আর শাশুড়ি-জামাই সম্পর্কের মধ্যে যে একটা স্নেহকাতর ব্যাকুলতা রয়েছে এটাকে উপলব্ধি করেছি মেয়ের বিয়ের পর থেকেই। ওরা বর্তমানে পাঞ্জাবের অমৃতসরে থাকে। জামাই নারায়ণ সরকার সেখানকার এক নামী কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। প্রতিবছর ওরা এই সময়টা আসার চেষ্টা করে। কয়েক বছর আসতে পারেনি কিন্তু এই বছর আসার কথা রয়েছে। ওরা আসা মানেই আমার আনন্দের পরিসীমা নেই। যেহেতু একদমই পাই না দু’জনকে। জামাইষষ্ঠীর দিনটা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া গানশোনা, কবিতা পড়া— এইসব করতে করতে কোথা থেকে পেরিয়ে যায় বুঝতেই পারি না। ওদের জন্য জামাকাপড় কিনে রাখি আগে থাকতেই। শাড়ি, পাঞ্জাবি অথবা শার্ট-প্যান্ট যেটা জামাইয়ের পছন্দ। পাঁচরকম ফল, মিষ্টি দিয়ে জামাইকে বরণ করি। জামাইষষ্ঠী নিয়ে কোনও সংস্কার আমার মধ্যে একেবারেই নেই। ফলে নিয়ম কখনও করিনি। নিজের হাতে রান্না করি এইদিনটায়। আমার খুব ভাল লাগে। নারায়ণ খুব ইলিশভাপা খেতে ভালবাসে তাই ইলিশভাপা করতেই হবে আমাকে। ফ্রায়েড রাইস ওর ফেভারিট, চিকেন- মাটন দুটোই প্রিয়, আমের চাটনি ভীষণ পছন্দ করে। আসলে ও খুব খাদ্যরসিক আর আমিও খাওয়াতে পছন্দ করি। ও আমার জন্য উপহার নিয়ে আসে সবসময়।
দীপা মল্লিক
আমি আমার বড় ননদের কাছে শুনেছি। তারা যখন জামাইষষ্ঠীতে (Jamai Sasthi 2024) আসত তখন মল্লিক বাড়ির অন্নপূর্ণা দালানে জামাইষষ্ঠীর আয়োজন হত। একসঙ্গে সবাই বসত। ওইসময় শ্বশুরবাড়িতে প্রায় ২৫০ জন লোক। সেই আয়োজনটা করতেন প্রমিতা মল্লিকের শ্বশুরমশাই বিমলচন্দ্র মল্লিক। কাঁসার থালাতে সবরকমের ফল দিয়ে সাজিয়ে একসঙ্গে জামাইবরণ করা হত। বাড়ির ছোটদের ষাটগাছের জল ছিটে দিতেন আমার শাশুড়িমা। পাখার বাতাস দিতেন। হরেক মেনু তো হতই কিন্তু মাংসটি হত না। জামাইষষ্ঠীতে শুধু মাছই হত। শাশুড়ি মায়েরা সবাই সেদিন নিরামিষ খেতেন। যদিও আমি সেই সব নিয়ম করিনি কোনওদিন। আমার জামাই খুব আধুনিক মনের মানুষ। আমারও মনে হয় আনন্দ আর আন্তরিকতাই আসল। তবে ওর মাথায় ষাটগাছের জলের ছিটে দিই। ওই নিয়মটুকুই করি। রানে বাঙালি খাবার খাওয়া একটু-আধটু শিখেছে। বাঙালি খাবারে ধাতস্থ হয়েছে এখন। আগে তো খেতেই পারত না। ভীষণ ভাল ছেলে। আমার খুব শখ ওকে রুপোর থালায় সবরকম খাবার বেড়ে খাওয়াই। কিন্তু ও একটু নিরামিষ-ঘেঁষা মানুষ ফলে খুব ইলাবরেটলি প্রাণভরে যে ওর জন্য রাঁধব সেটা করতে পারি না। সবকিছু খায় না। ফিশফ্রাই ওর খুব ফেভারিট একটা আইটেম। দইমাছটা খুব ভালবেসে খায়, প্রনটাও ভাল খায়। ফল খেতে সাংঘাতিক ভালবাসে। লিচু আম, আপেল, কলা, জাম সবই ওর পছন্দ। আমি জামাইষষ্ঠীতে ফিশফ্রাই, চিংড়িমাছ, পোলাও আর ফ্রায়েড রাইস দুটোই করি, পোস্তর বড়া খুব ভালবাসে, ওটা করি। এগুলোই খায়, সঙ্গে দই-মিষ্টি থাকে। রানে মিষ্টি খেতেও ভীষণ ভালবাসে কিন্তু কোয়েলের পাল্লায় পড়ে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করেছে তবে জামাইষষ্ঠীর দিন খায়। উপহার আমাদের মধ্যে সারাবছর দেওয়া চলতেই। ওই দিনটা টাকাই দিয়ে দিই বেশিরভাগ সময়।
রীতা দাস
আমরা ঘটি আর মেয়ে মৌমার শ্বশুরবাড়ি বাঙাল। ওরা ব্রাহ্মণ। যদি কোনও ব্যস্ততা না থাকে তাহলে ওরা জামাইষষ্ঠীর দিন সকালেই চলে আসে। মৌমার শিডিউল অনুযায়ী আমাকে যে কোনও প্রোগ্রাম করতে হয়। ওইদিন হাতে করে ওরা আমার জন্য কিছু না কিছু উপহার আনবেই। আমিও কিনে রাখি। আসলে কাঞ্চন দু-সেট করে জামাকাপড় পায় কারণ আমার দুই বোনের সঙ্গে মৌমার দুই কাকার বিয়ে হয়েছে। ফলে মৌমার মাসিরাই ওর কাকিমা। আদরটাও তাই তিনগুণ। আর আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাড়িতে আসার পর পাঁচরকম ফল দিয়ে মিষ্টি, লুচি-তরকারি দিয়ে সাজিয়ে প্রদীপ দিয়ে বরণ করি। এছাড়া আর কোনও নিয়ম নেই। আগে সারাদিন উপোস করেই থাকতাম এখন আর পারি না। কাঞ্চনের হাতে খাবারটা তুলে দিয়ে আমি খেয়ে নিই। নিজে হাতে সব রান্না করি। সাদা ভাত, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, মুরগির মাংস, পাঁচরকম ভাজা, যেকোনও দু’রকম মাছ, চাটনি, দই, মিষ্টি। আমার জামাই মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসে। ওইদিনটা রাতে ওরা খাওয়াদাওয়া করেই বাড়ি যায়। এটাই বরাবর হয়ে আসছে। রাতে ছিমছাম মাটন আর বাসন্তী পোলাও, সঙ্গে আইসক্রিম।