বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

ভারতের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাকে সচল রাখতে প্রতি বছর ১৩ মিলিয়নের বেশি ইউনিট রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিমাণ রক্তের জোগান কখনওই হয় না। সচেতনতার অভাবই এর অন্যতম কারণ। সেই কারণেই ভারত তথা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করতে এবং রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে প্রতিবছর ১৪ জুন পালিত হয় ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ১ শতাংশ মানুষও যদি নিয়মিত রক্ত দান করেন, তা হলে সে দেশের ন্যূনতম রক্তের চাহিদা মেটে। ১৪ জুন হল বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যাঁরা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাঁদের-সহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এই দিনটির উদ্দেশ্য। ২০০৪ সাল থেকে এইদিনটি পালিত হয়ে আসছে। ২০২৪-এ বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের ২০ বছর পূর্তি। সেই উপলক্ষে বিশ্বের সব রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হবে। যার ক্যাচ লাইন হল— ‘thank you blood donors’ স্বেচ্ছায় রক্তদান এক মহৎ কাজ। রক্তের গ্রুপ পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। ১৯০০ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনাতে চারটে ব্লাড গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। এ, বি, ও, এবি। এই অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ১৯৩০ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশ্ব রক্তদাতা দিবসটিকে সেই বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারকেও উৎসর্গ করা হয়েছে। যদিও এই ব্লাড গ্রুপের নেগেটিভ এবং পজিটিভ এই ক্লাসিফিকেশনটা করেছিলেন রোনাল্ড ফিশার এবং আর আর রেজ।

আরও পড়ুন-৬ ঘণ্টায় ৮ প্রবীণের অস্থি-সন্ধি অপারেশন

রক্ত কী
রক্ত মানুষের দেহের তরল যোজক কলা, যা মূলত পরিবহণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রক্তে থাকে রক্তকণিকা, প্লেটলেট ও প্লাজ়মা। এক ইউনিট রক্ত থেকে এই তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা যায়, অর্থাৎ বলা চলে এক ইউনিট রক্ত কম করে তিনজন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে। একজন ব্লাড ডোনার ইচ্ছে করলে সমগ্র রক্ত বা হোল ব্লাডও দিতে পারেন, অথবা রক্তের বিশেষ উপাদান যথা প্লেটলেটও দান করতে পারেন। মানবদেহের মোট ওজনের শতকরা সাত ভাগ রক্ত থাকে। সাধারণত, একজনের দেহ থেকে একবারে এক ইউনিট রক্ত নেওয়া হয়। সেই রক্ত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় শরীরে তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে দাতার কোনও ক্ষতিও হয় না।

আরও পড়ুন-সপ্তাহশেষে বৃষ্টির সম্ভাবনা দক্ষিণে

কেন জরুরি ব্লাড গ্রুপ
আমাদের শরীরের বিভিন্ন অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে ব্লাড গ্রুপ ভাগ করা হয়েছে। এগুলো আমরা জন্মগতভাবে পাই। যার ব্লাড গ্রুপ ‘এ’ হয়, তার লোহিত কণিকায় ‘এ’ অ্যান্টিজেন থাকে এবং প্লাজমায় থাকে অ্যান্টি ‘বি’ অ্যান্টিবডি। যার ব্লাড গ্রুপ ‘বি’ তার লোহিতকণিকায় থাকবে ‘বি’ অ্যান্টিজেন এবং প্লাজমায় থাকবে অ্যান্টি ‘এ’। কাজেই এদের মধ্যে ব্লাড দেওয়া-নেওয়া হলে ক্রস রি-অ্যাকশন হওয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
যেহেতু ‘ও’ ব্লাড গ্রুপের রোগীদের রক্তে কোনও অ্যান্টিজেন থাকে না লোহিতকণিকাতে তাই ‘ও’ নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তি সবাইকে রক্ত দিতে পারে এবং এবি নেগেটিভ সবার রক্ত নিতে পারে। কিন্তু জরুরি অবস্থা ছাড়া এমনটা করা হয় না।
ভয় পাবেন না রক্ত দিতে
রক্তদানের আগে
রক্তদানের অন্তত চারঘণ্টা আগে খাবার এবং অন্তত ৫০০ মিলিলিটার জল খান। রক্তদানের অন্তত দু’দিন আগে থেকে আপনার শরীর সম্পূর্ণ অ্যাসপিরিন ফ্রি রাখতে হবে। আর যদি নিয়মিত কোনও ওষুধ চলে সেই কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে যান।

আরও পড়ুন-৩০ বছরের জন্য নিশ্চিত বোলপুরের ২২ ওয়ার্ডের পানীয় জল

রক্তদানের পরে
রক্তদান করতে সময় লাগে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। একজন ব্যক্তির থেকে মোটামুটি ৪৫০-৫০০ এমএল রক্ত নেওয়া হয় একবারে। রক্ত দেওয়ার পর পরিমাণমতো জল এবং হাল্কা খাবার খেতে হবে।
রক্ত দেওয়ার পর মাথা ঘুরতে পারে। তাই এই সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত আধঘণ্টা বিশ্রাম নিন।
রক্ত দেওয়া হয়ে গেলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ গ্লাস জল বেশি খান।
ওই দিন ভারী কিছু তুলবেন না বা এক্সারসাইজ করবেন না।
রক্তদাতা যে পরিমাণ রক্ত দিলেন তাঁর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই পরিমাণ প্লাজমা যা রক্তেরই একটা অংশ তা তৈরি হয়ে যায়। রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি হতে সময় লাগে মোটামুটি তিন সপ্তাহ মতো এবং আয়রন তৈরি হতে সময় লাগে ছ-সপ্তাহ মতো। তার মধ্যেই কিন্তু যে রক্তটুকু দান করা হয়েছে আবার সেটা তৈরি হয়ে যায়।
রক্তদানের পরে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ রক্ত সংগ্রহকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।

আরও পড়ুন-কাপ না এলে দায়িত্ব ছাড়বেন সাউথগেট

মহিলাদের ক্ষেত্রে
গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী বা গর্ভপাতের পর ছয়মাস পর্যন্ত রক্ত দান করা যাবে না।
মায়েরা যতদিন পর্যন্ত শিশুকে ব্রেস্টফিড করাচ্ছেন ততদিন রক্তদান থেকে বিরত থাকুন।
কতদিন পরপর রক্ত দেবেন
একজন সুস্থ, সবল মানুষ চারমাস পরপর রক্ত দিতে পারবেন।
মেয়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত ছয়মাস পর রক্ত দিতে বলা হয়।
কারা রক্ত দিতে পারবেন / পারবেন না
অসুস্থ বা জ্বর অবস্থায় রক্ত দেওয়া যাবে না।
এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি বা সি আক্রান্ত রোগীদের এবং শিরায় মাদক সেবনকারীদেরও উচিত রক্তদান না করা।
রক্তদানের পরে প্রতিটি ব্লাড ব্যাগেই হেপাটাইটিস বি, সি, এইচ আইভি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা হয়। যদি সেই পরীক্ষার পর কোনও একটির রিপোর্ট পজিটিভ আসে তবে সেই রক্ত ব্যবহার করা হয় না।
সুস্থ প্রেশার বা ডায়াবেটিস রোগীরা রক্ত দিতে পারেন।
মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড চলাকালীন রক্ত দেওয়া সম্ভব।
সাধারণত হিমোগ্লোবিন ১২.৫ হলে তবেই তার রক্ত দানের জন্য নেওয়া হয়।
রক্তদানে দাতারও উপকার
রক্তদাতার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়। এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। দ্রুত রক্তস্বল্পতা পূরণ হয়।
রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায়।
রক্তদান করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই সময় যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয় তা থেকে কোনও ব্যক্তির শারীরিক অসুবিধা যেমন, হিমোগ্লোবিন কম আছে কি না, পালস রেটে বা প্রেশারের কোনও সমস্যা আছে কি না, তা ধরা পড়ে যায়। এছাড়া রক্তে কোনও সংক্রমণ রয়েছে কি না সেগুলোও জানা যায় এবং রক্তদাতার ব্লাড গ্রুপও জানা যায় নিখরচায়।

Latest article