দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবন তারিণী তরল তরঙ্গে,
শংকর মৌলি বিহারিণী বিমলে
মম মতি আস্তাং তব পদ কমলে।
হে দেবী গঙ্গা, দেবগণের ঈশ্বরী, ভগবতী, ত্রিভুবনের ত্রাণকর্ত্রী, চঞ্চলা শিবের মস্তিষ্কে বিচরণকারিণী হে নির্মলা, আমার মন থাকুক তোমার পদকমলে।
পতিতপাবনী গঙ্গা আমাদের মনমানসে এই ভাবেই প্রোথিত।
আরও পড়ুন-গঙ্গা আমার মা
গঙ্গা কলুষনাশিনী। তিনি শান্তিদায়িনী।
বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে গঙ্গা একটি। আমাদের হিন্দু ধর্মে গঙ্গার অপরিসীম ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মানবজাতির পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য গঙ্গা স্বর্গ থেকে অবতরণ করেন বলে জানা যায়। বেশিরভাগ হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানে পবিত্র গঙ্গাজলের ব্যবহার জড়িত।
এই পবিত্র নদীর উল্লেখ পুরাণে বারবার রয়েছে।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল— এই তিন লোকেই পবিত্র নদী প্রবাহিত বলে গঙ্গার আপন নাম ত্রিলোকপথগামিনী।
আবার জীবিত অমৃত সব জীবেরই যাত্রাপথে অবস্থিত বলে এর অন্য নাম তীর্থ।
পদ্মপুরাণ অনুসারে, গঙ্গা সুরূপা, অপরূপা লাবণ্যময়ী। দেহবর্ণ কুন্দকুসুমের মতো শ্বেতশুভ্র। শুভ্রবসনা দেবীর কণ্ঠে মুক্তমালা। নানা অলংকার ও আভরণে দেবী ভূষিতা, তিনি দ্বিভুজা। তাঁর এক হাতে সুধা ও জ্ঞানের প্রতীক অক্ষসূত্র অন্য হাতে শ্বেতপদ্ম।
সুদণ্ডী, সুবদনী, সুপ্রসন্না ও করুণাময়ী। মস্তকে শ্বেতছত্র, চন্দ্রপ্রভার ন্যায় জ্যোতির্ময়ী। দেবীর বাহন মকর।
মহাভারতের বনপর্বে বলা হয়েছে, সত্য যুগে সকল স্থানই তীর্থ। ত্রেতায় পুষ্করের শ্রেষ্ঠত্ব, দ্বাপরের শ্রেষ্ঠতীর্থ কুরুক্ষেত্র। কলি যুগের শ্রেষ্ঠ তীর্থ হল গঙ্গা।
‘সর্বং কৃতযুগে পুণ্যাং ত্রেতায়াং পুষ্করং স্মৃতম্
দ্বাপরে তু কুরুক্ষেত্রং গঙ্গা কলিযুগে স্মৃতা।’
আরও পড়ুন-যোদ্ধা মায়ের অভিযান
গঙ্গাকে তিনভাবে দেখা যেতে পারে। এক, আর্যাবর্ত্তাস্থিত পবিত্র নদী বিশেষ। দুই, তিনি হ্লাদিনী প্রভৃতি সপ্তগঙ্গা। স্মৃতি পুরাণেও গঙ্গার কথা রয়েছে। ঋগ্বেদে দশম মণ্ডলে পঁচাত্তর (৭৫) সুক্তে উনিশটি নদীর স্তুতি আছে। স্তুতি করেছেন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি সিন্ধুজিৎ। সিন্ধু নদীর পর গঙ্গার উল্লেখ রয়েছে সেখানে। পুরাণে যে নদীর এত মাহাত্ম্য সেই দেবী গঙ্গাকে নিয়ে নানা ধরনের উৎসব উদযাপন থাকবে এ-কথা বলাই বাহুল্য। গঙ্গাকে নিয়ে সেইরকমই এক উল্লেখযোগ্য রীতি ও উদযাপন হল ‘গঙ্গা দশেরা’।
ভারতবর্ষ উদযাপনের দেশ। মা গঙ্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করাকে বলা হয় গঙ্গাবতারণ। এই ঘটনাকে স্মরণ করতেই পালন করা হয় গঙ্গা দশেরা। মূলত গঙ্গা তীরবর্তী রাজ্যগুলোতে এই গঙ্গা দশহরা মহাসমারোহে পালিত হলেও সারা দেশ জুড়েই চলে এই উৎসব।
গঙ্গা দশেরার পেছনে রয়েছে এক চমৎকার পৌরাণিক কাহিনি। কী সেই কাহিনি? আসুন দেখে নেওয়া যাক।
রামায়ণে সাগর রাজার কাহিনি আছে। রাজা ভগীরথ পৃথিবীতে দেবী গঙ্গার উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভগীরথের প্রপিতামহ ছিলেন রাজা সাগর। মহারাজা সাগরের কেশনী ও সুমতি নামে দুই রানি ছিলেন। কেশিনীর অংশুমান নামে এক পুত্র এবং সুমতির ষাট হাজার পুত্র ছিলেন। সাগর রাজা একবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন।
আরও পড়ুন-পরিস্থিতি অনুকূল মঙ্গলেই বর্ষার প্রবেশ দক্ষিণে
সেই সময় ইন্দ্র রাজা সাগরের ঘোড়া অপহরণ করেন। এবং কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়াটিকে বেঁধে রাখেন। সাংখ্যদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিলমুনি এসবের কিছুই জানতেন না।
এই ঘটনার পর রাজার ষাট হাজার ছেলে ঘোড়ার খোঁজ শুরু করে দেয়। সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও ঘোড়াটি পাওয়া যায় না।
পরে দেখা যায় কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়া চরছে, এই দেখে ষাট হাজার ছেলে চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকে। সমবেত চিৎকারে কপিলমুনির ধ্যান ভেঙে যায়। তিনি চোখ খুলতেই তাঁর জ্বলন্ত ক্রোধী দৃষ্টিতে সাগর রাজার ষাট হাজার পুত্র এবং সমস্ত প্রজা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সেই সময় ঋষি অগস্ত্যর জন্য পৃথিবীতে এক ফোঁটাও জল অবশিষ্ট ছিল না।
ভগীরথ ব্রহ্মাকে খুশি করার জন্য তপস্যা করেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বর চাইতে বললে ভগীরথ পৃথিবীতে মা গঙ্গাকে আনার জন্য বলেন।
ব্রহ্মা বলেন, পৃথিবী গঙ্গার ওজন সামলাতে পারবে না। গঙ্গার গতির নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একমাত্র ভগবান শঙ্করেরই আছে।
আরও পড়ুন-পর্যটকদের উদ্ধারে সেনা তলব সিকিমে
এরপর শিবের কাছ থেকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা ভগীরথ কঠোর তপস্যা করেছিলেন। ভগবান শিব মা গঙ্গাকে তাঁর জটায় স্থান দিয়েছিলেন। এরপর মা গঙ্গাকে পৃথিবীতে তিনি নিজের ইচ্ছায় একটু একটু প্রবাহিত করেছিলেন। মহারাজা সাগরের ষাট হাজার পুত্রের মোক্ষ লাভ হয় পরবর্তী সময়ে। দেবী গঙ্গার সঙ্গে নিবিড়ভাবে দীপ্ত ও যুক্ত জটাধারী দেবাদিদেব মহাদেব।
সেই সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের তিনটি ধারা সাংখ্য, ন্যায় ও অদ্বৈত। সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিল মুনির ধ্যান ভঙ্গ করেছিলেন ষাট হাজার পুত্র।
সাগর রাজার উত্তর পুরুষ ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গা
এনে পূর্বপুরুষদের সৎকার করেন।
ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম গঙ্গাদ্বারের নিম্ন ভাগে রচনা করেন কুশাবর্ত তীর্থ।
আচার্য শঙ্কর যে অমর গঙ্গার স্তোত্র রচনা করেছিলেন তাতে অদ্বৈতর মূল তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
আচার্য মনু গঙ্গার মাহাত্ম্য করেছেন এই বলে, যে মূর্খদের রাজত্বেও গঙ্গা প্রবাহিত তা পবিত্র হয়ে যায়।
অত্রি সংহিতাতেও গঙ্গার কথা বলা হয়েছে।
গঙ্গার আরেক নাম বিষ্ণুপদী। শ্রীকৃষ্ণের নখাগ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পরে সেখান থেকেই বেরিয়েছিলেন। তাই তিনি বিষ্ণুপদী।
শিবের জটা থেকে মা গঙ্গার থেকে মর্ত্যে অবতরণ করাকে বলা হয় গঙ্গাবতারণ। এই ঘটনাকে স্মরণ করার জন্যই পালন করা হয় গঙ্গা দশেরা।
দশহরা, শাস্ত্র অনুযায়ী অত্যন্ত পূর্ণ ও পুণ্য তিথি। জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লা পক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গা দশেরা পালিত হয়।
আরও পড়ুন-পরিস্থিতি অনুকূল মঙ্গলেই বর্ষার প্রবেশ দক্ষিণে
গঙ্গা দশেরার উৎসব উদযাপন শুধু একদিনই নয়, এই পবিত্র দিনের আগে ন’দিন ধরে চলে এই উৎসব। দশহরা পবিত্র দিনে যাঁরা নদীতে ডুব দেন, তাঁরা মোক্ষ লাভ করেন— এমনটাই আবহমান কালের বিশ্বাস।
স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, এই পুণ্যদিনে গঙ্গাপুজো আর ধ্যানের কথা। এ-ও বলা হয়েছে গঙ্গা না পেলেও অন্যথায় যেকোনও নদীতে ধ্যান এবং দানের কথা।
গঙ্গা দশেরা পালনের কী কী বিধি রয়েছে দেখে নিই।
দশরকম ফল, দশরকম ফুল, দশটি পান ও দশটি প্রদীপ সহযোগে গঙ্গার পুজো ও আরতির বিধি।
পাশাপাশি গঙ্গাচালিশা পাঠ, দশবার ডুব দেওয়া।
দশটি ব্রাহ্মণ এবং সম্ভব হলে নিরন্ন মানুষকে অন্ন দান।
গঙ্গানদীকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান জানাতে গঙ্গা দশেরার দিন দশটা করে সবকিছু নিবেদনের নিয়ম। সংস্কৃতে দশের অর্থ দশ এবং হর অর্থাৎ ধ্বংস। অর্থাৎ মনুষ্যকৃত দশটি পাপ ধ্বংস হওয়া।
গোটা দেশ জুড়ে ধুমধাম সহকারে দশদিন ধরে গঙ্গা দশেরা পালিত হয়। সারাদিন ধরে কাশী, বেনারস, হরিদ্বারের ঘাটগুলিতে শ্লোক, ভজন, কীর্তন চলে।
নদীতে ফুল, প্রদীপ ভাসিয়ে মনোমুগ্ধকর আরতির অতি-পরিচিত দৃশ্য দেখা যায়।
আবহমান কাল থেকে এই বিশ্বাস যে, গঙ্গা দশেরার দিনে পবিত্র নদীতে স্নান করলে মনুষ্য জন্মের কৃত দশটি পাপ থেকে মুক্তি মেলে।
এখন দেখা যাক এই দশটি পাপ কী কী? শাস্ত্রে কী বলা হয়েছে?
প্রথম তিনটি পাপ হল কায়িক অর্থাৎ শারীরিক, বাকি চারটি পাপ হল বাচিক অর্থাৎ মৌখিক।
আরও বাকি তিনটি পাপ হল মানসিক।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে খেজুরিতে এবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল
কায়িক পাপের মধ্যে ধরা হয় কারও অজান্তে তার জিনিসপত্র নেওয়া, ধর্মীয় হিংস্রতা ইত্যাদি।
বাহ্যিক পাপের মধ্যে ধরা হয় কাউকে অভিশাপ দেওয়া, মিথ্যা বিবৃতি দেওয়া ইত্যাদি।
মানসিক পাপ হল অনৈতিক জীবনযাপন, মনে মনে কাউকে আঘাত করা ও মিথ্যা বলা।
তা হলে দেখা গেল পরদ্রব্য হরণ, অহংকার, মিথ্যাভাষণ, পরনিন্দা, অসামাজিক কাজকর্ম, চুরি, ব্যভিচার, বাক্যগত পাপ, কামনা, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা— এই দশরকম পাপ থেকেই গঙ্গা দশেরার দিন কলুষনাশিনী গঙ্গায় অবগাহন করে ইষ্টচিন্তা করলে মর্ত্যের মানুষের অক্ষয় পুণ্য লাভ সম্ভব। মুক্তিও মেলে।
বলা হয় এদিন পুজোপাঠ করলে দেবাদিদেবের আশীর্বাদও পাওয়া যায়।
হিন্দু ধর্মে নানা উৎসবের মধ্যে গঙ্গা দশেরা গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়।
কেননা, গঙ্গা স্বর্গলোক থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ফলে রুক্ষ পৃথিবী হয়ে উঠেছিল শস্য-শ্যামলা।
পতিত পাবনী গঙ্গে
শান্তিদায়িনী গঙ্গে
পুণ্যবাহিনী গঙ্গে
সুরভিত সুরলোকে ধ্বনিত হোক এই পবিত্র নদীর গৌরব গাথার মাহাত্ম্য।