বাঙালিকে (Bengali) সংখ্যালঘু বানিয়ে রাখার পরিকল্পনাটা নতুন নয়, অনেক দিনের। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে সেই পরিকল্পনা চলছে।
চলবে নাই বা কেন?
বঙ্গদেশে কোনও সাভারকর ছিলেন না। ছিলেন ক্ষুদিরাম, ছিলেন সুভাষচন্দ্র। বাংলায় কোনও ডক্টরজি, কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, জন্ম নেননি। এই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
তাই বাঙালির (Bengali) বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজশক্তি ছিল মহাখাপ্পা। গোড়া থেকেই। এম এস গোলওয়াকারের জন্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ নয়। এখানে জন্মেছেন ‘৪২-এর মাতঙ্গিনী হাজরা, আজকের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই বাংলা সতত দিল্লির বিদেশি শাসকদের চক্ষুশূল ছিল।
সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
দেশ যখন ভাগ হল, দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিমরা, হিন্দুরা সংখ্যালঘু পাকিস্তানে। আর বাংলাভাষী বা বাঙালি জাতিকে নানাভাবে সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু’। এটা করে দিতে পেরেছিল ইংরেজ, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় ‘সাফল্য’! এটা সম্ভব হয়েছিল ব্রিটিশদের কারসাজিতে।
আর আজ, স্বাধীনতার ৭৮ বর্ষপূর্তি থেকে মাত্র ১৫ দিন দূরে দাঁড়িয়ে কী দেখছি আমরা? এপার বাংলায় নতুন করে ‘ভাষা আন্দোলনে’ নামতে হয়েছে বাঙালিকে। কারণ, কেন্দ্রীয় শাসকের পরোক্ষ মদতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত এবং বাঙালির সম্মান ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই অনাচার বিজেপি/এনডিএ-শাসিত রাজ্যগুলিতেই সর্বাধিক। সবচেয়ে বেড়ে খেলছে একদা ‘বঙ্গাল খেদা’-খ্যাত অসম, যে-রাজ্যের গেরুয়া কর্ণধার হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যাঁর একটি ডায়ালগ মারাত্মক ভাইরাল হয়েছে, ‘‘মাতৃভাষা ‘বাংলা’ লিখলে ‘বিদেশি’ (পড়ুন, বাংলাদেশি নাগরিক) চিনে নিতে আমাদের সুবিধা হবে!’’ ভারতের বহু স্থানে বাঙালি-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে রয়েছে গরিব শ্রমিক শ্রেণির মুসলিম বাঙালিদের বিপন্ন করে তোলার মতলব। নেপথ্যে ভোটের অঙ্ক কতখানি, সেটা বাচ্চাদেরও অজানা নয়।
পড়শি দেশে হিন্দু-সহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জিনা হারাম করে তোলা হচ্ছে। সেখানে হারাম গণ্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত এবং বিশ্বকবির যাবতীয় পুণ্যস্মৃতিও। অসংখ্য অমুসলিম মনীষীর কীর্তিগাথা মুছে ফেলার আয়োজন সেখানে সম্পূর্ণ হওয়ার পথে।
আর প্রায় একই লজ্জাজনক কায়দায়, রকমারি কায়দায় সংখ্যালঘু শ্রেণি তথা বাঙালিদের মানবাধিকারহরণ নিয়ে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। এ-নিয়ে আমেরিকা-সহ উন্নত গণতান্ত্রিক দুনিয়া বিরক্ত।
কিন্তু অভিযুক্তরা এসব আদৌ পাত্তা দেয় কি?
আজ ‘নিজভূমে পরবাসী’ বাঙালিদের নিয়ে এদেশের কেন্দ্রীয় শাসকদের কোনও মাথাব্যথা আদৌ আছে কি?
এই আবহে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করছেন? শুধু ভাষা আন্দোলন? শুধু বাঙালি নিগ্রহের প্রতিবাদ? এটুকুতেই আটকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ড?
না। মোটেই তেমনটা নয়।
মূলত অভাবের তাড়নায় স্কুলমুখী হচ্ছে না বহু ছেলেমেয়ে। অনেকে আবার স্কুলে ভর্তি হয়েও মাঝপথে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই ব্যাধি গত কয়েক দশক ধরে গোটা দেশেই জাঁকিয়ে বসেছে। একটা সময় এ রাজ্যের ছবিটাও ছিল তেমনই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে ধীরে ধীরে পরিস্থিতিটা যে বদলাতে শুরু করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যই তার প্রমাণ। গত সপ্তাহে এই সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছেন, ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে (প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি) বাংলায় কেউ স্কুলছুট নেই। অর্থাৎ স্কুলে ভর্তির পর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একজন পড়ুয়াও স্কুল ছেড়ে চলে যায়নি।
আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশে প্রতিদিন ধর্ষিতা ৭ তফসিলি মহিলা
এর পেছনে জননেত্রীর নেওয়া পদক্ষেপগুলোর তাৎপর্য ও গুরুত্ব সহজবোধ্য। এ-রাজ্যে ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করা এবং তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একাধিক প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য সরকার। যেমন, ছাত্রীদের জন্য কন্যাশ্রী, সকলের জন্য সবুজসাথী প্রকল্প ইত্যাদি। প্রথমটায় নগদ, দ্বিতীয়টিতে সাইকেল দেওয়া হয়। এছাড়া সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে ঐক্যশ্রী প্রকল্প। তফসিলি জাতির পড়ুয়াদের জন্য রয়েছে শিক্ষাশ্রী প্রকল্প। ওবিসির জন্য মেধাশ্রী প্রকল্প। প্রতি বছর রাজ্যের কয়েক কোটি পড়ুয়া এইসব প্রকল্প থেকে অর্থ সাহায্য পায়, যা গরিব, দুঃস্থ পরিবারগুলির কাছে শিক্ষায় আলোকিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চপ্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের বিনা পয়সায় বই, পোশাক, মিড ডে মিলের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। ‘শূন্য স্কুলছুট’ তারই আদর্শ ফল।
‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর ‘সুফল’ নিয়ে গোটা দেশে লম্বা-চওড়া ভাষণ শোনা গেলেও স্কুলছুট-এ এগিয়ে থাকার তালিকায় দেখা যাচ্ছে, সেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিরই জয়জয়কার।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুসারে প্রথম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুল শিক্ষার তিনটি স্তর মিলিয়ে স্কুলছুটের তালিকার প্রথম সারিতে রয়েছে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, আরএসএস-এর আশীর্বাদধন্য ডাবল ইঞ্জিনের বিজেপি সরকার। রাজ্যগুলির নাম রাজস্থান, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহার। এই হিসাব ২০২১-’২২ থেকে ২০২৩-’২৪— এই তিনটি অর্থবর্ষের। বাংলায় একমাত্র ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে নবম-দশম শ্রেণিতে স্কুলছুটের সংখ্যা ১৭.৮৫ শতাংশ। তবে এই তালিকাতেও পশ্চিমবঙ্গের আগে রয়েছে অসম, কর্নাটক, মেঘালয়, গুজরাত, লাদাখ, অরুণাচল, সিকিম, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মণিপুর, ঝাড়খণ্ড। আবার কেন্দ্রের দেওয়া অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শুধু ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সারা দেশে স্কুলছুটের সংখ্যা ১১.৭০ লক্ষের বেশি। প্রথম উত্তরপ্রদেশ, তারপর রয়েছে ঝাড়খণ্ড ও অসম।
এই আবহে পিছিয়ে পড়াদের বাংলা ও বাঙালির ওপর রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। সেটা ঈর্ষার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। তার ওপর ঘৃতাহুতি প্রদান করেছে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ।
তাই ব্রিটিশ জমানার উত্তরাধিকার বহন করে বাংলা ও বাঙালির (Bengali) ওপর আক্রমণ শানানো হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। এ এক বিরাট চক্রান্ত। সেই চক্রান্তের শিকার আমাদের জীবন-জীবিকা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভাষা আন্দোলন’ তাই কার্যত বাঙালির জীবন-জীবিকা বাঁচানোর আন্দোলন।
ভারতের শাসনদণ্ড ব্রিটিশের হাতছাড়া হয়ে গেল, তখন চার্চিল ভারত সম্পর্কে অত্যন্ত অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মোদ্দা বক্তব্য ছিল, এই অশিক্ষিত, বিশৃঙ্খল, ক্ষমতালোলুপ জাতি স্বাধীনতা বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেই একে ধ্বংস করে ফেলবে। বস্তুত ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি প্রাণপাত করে চলেছে চার্চিলের স্বপ্নপূরণ করার জন্যই। হাজার হোক, সাভারকর, হেডগেওয়ার, গোলওয়াকারের উত্তরাধিকারী বলে কথা! পরম্পরা যাবে কোথায়!