সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
কী অদ্ভুত সমাপতন! একটা কাজে, বিকেলের ধনধান্যে এক্সপ্রেসে বহরমপুর যাব, ঠিক তার আগে হাতে এল বইটা। ফলে পড়া শুরু হল ট্রেনেই। এবং বহরমপুর সফরের সঙ্গে জড়িয়ে রইল বইটা। আসলে বইটা জুড়েই আছে বহরমপুর শহর। বইয়ের লেখকের প্রাণের শহর। কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তে আসা কুমারপুর গ্রামের ছেলে মইনুল হাসানের কাছে বহরমপুর নিজের শহর— লেখকের ভাষায় : ‘আমার শহর— বহরমপুর’। এই অধ্যায় দিয়ে শেষ হচ্ছে বই। আর বই শুরু হচ্ছে লেখকের গ্রামের গল্প দিয়ে। এই বই এক পথ-পরিক্রমার কাহিনি। এই পরিক্রমা যার, তিনিই লিখেছেন তাঁর ‘ফেলে আসা দিনের কথা’। তাঁর এই পথ-পরিক্রমা চমকপ্রদ। গ্রামের পাঠশালায় পড়া শুরু করা এক ছেলের ভারতের সংসদের সদস্য হওয়ার যাত্রাপথ, অনেক অভিজ্ঞতায় মোড়া।
আরও পড়ুন-চিন্নাস্বামীতে আজ রোহিত-বিরাট ম্যাচ
পড়তে ভাল লাগে কীভাবে গোল্লাছুট আর টিপ্পি খেলার খেলুড়ে, স্কুল যাওয়ার বায়না করে, স্কুলে ভর্তি হল। আজ থেকে বছর ষাট আগে মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুমারপুর আর লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের বর্ণনায় উঠে আসে ধর্মের অমিল সত্ত্বেও মনের মিলের কথা। ‘প্রায় সবাই নমঃশূদ্র’ উদ্বাস্তু মানুষদের ‘সব সাফ করে দারুণ বসতি বানিয়ে’ ফেলা, কুমারপুর গ্রামের মানুষেরা শুধু অবাক চোখে দেখেছিল, তা নয়, তারা শেখার চেষ্টাও করেছিল এই বিপুল কর্মকুশলতা।
আরও পড়ুন-হ্যাঁ, এগিয়েই বাংলা
“শুভ কর্মপথে ধর’ নির্ভয় গান”— রবীন্দ্রনাথের এই গানের কথা মনে পড়ে মইনুলের ছাত্রজীবনের নানান কথা পড়তে পড়তে। ছাত্রজীবনকে দু’ভাগে মেলে ধরেছেন লেখক। একভাগে রয়েছে ‘আমার স্কুল’ আর অন্যভাগে রয়েছে ‘আমার কলেজ’। তিনটি স্কুলে পড়েছেন মইনুল; কুমারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষ্মীনারায়ণ হাইস্কুল আর সাদি খাঁর দিয়াড় বিদ্যানিকেতন। সাদি খাঁর স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। স্কুলের কথায় বারবার উঠে আসে এই দিয়াড় বিদ্যানিকেতনের কথা; আক্ষরিক অর্থেই যে স্কুলের মাস্টারমশাইরা ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু, দার্শনিক আর দিশারি। ফলে শুধু বিষয়ের পাঠ নয়, তাঁদের কাছ থেকে মূল্যবোধের শিক্ষাও লাভ করেছিলেন লেখক।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
স্কুলে সরস্বতী পুজো হত না। স্কুলের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ শিশির মুখার্জি বলেছিলেন, ‘হিন্দুর জন্য পুজো, মুসলমানের জন্য মিলাদ, খ্রিস্টানের জন্য চার্চের ব্যবস্থা— এসব এখানে চলবে না। স্কুলটা ধর্মশালা নয়। ধর্মপালন বাইরে করবে। এটা পড়ালেখার জায়গা।’ ‘একজন ধর্মপ্রাণ সামন্তপ্রভুর কণ্ঠ থেকে এমন কথা উচ্চারিত হওয়া কতখানি সাহসের ব্যাপার সেটা এখন বেশি করে বোঝা যাচ্ছে।’ সত্যি কথা বলতে কী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধর্ম তো শিক্ষাগ্রহণ। আর তাই সে-স্কুলের এক হেডস্যার পুস্তক তালিকায় সরস্বতীর ছবি ছাপা হয়ে যাওয়ায় তা ছাত্রদের মধ্যে বিলি না করে নতুন করে তালিকা ছাপিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রদানের এই প্রাঙ্গণ পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেও শিখিয়েছিল। স্কুলের প্রধান ফটকের মাথায় লেখা ছিল কামিনী রায়ের কবিতা— ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
লেখকের কলেজজীবন জরুরি অবস্থার সময়কার। সেই সময় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে ব্রতী হয়েছেন। আক্ষরিক অর্থে মার খেয়েছেন। কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময়েই তাঁর বহরমপুর শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হওয়া। স্কুলের শিক্ষকদের মতো, কলেজের শিক্ষকদের প্রতিও তাঁর অপার শ্রদ্ধার প্রকাশ বই জুড়ে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় শিশু কমিশনের অসভ্যতা-গুন্ডামি, সঙ্গে বিজেপি নেতা, গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ
লেখক বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন চার দশকের বেশি সময়। তার মধ্যে একটা বড় সময় তাঁরাই ছিলেন রাজ্যের শাসনক্ষমতায়। এই সময় তাঁদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ ছিল, সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন পরিসর দখল করে নেওয়ার। সেরকমই একটা ঘটনার উল্লেখ বইয়ে রয়েছে। বিশিষ্ট র্যা ডিকাল বামপন্থী এবং অধিকার আন্দোলনের কর্মী, অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর শুরু করা বহরমপুর বইমেলা, এক অরাজনৈতিক মুখকে সামনে রেখে ক্ষমতার লোকদের ‘দখল’ করে নেওয়ার বৃত্তান্ত বইতে রয়েছে। তাঁরই ডাকা এক সভায় দীপঙ্কর চক্রবর্তীর সংখ্যালঘু হয়ে বইমেলার দায়িত্ব হারানোর ঘটনা পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ ছবির কথা, যেখানে ডাক্তার অশোক গুপ্তের ডাকা সভা দখল করে নেন স্থানীয় রাজনীতিক পুর-প্রশাসক।
আরও পড়ুন-অভিনেত্রী পল্লবীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লোপাট
জন্মসূত্রে মুসলমান লেখকের ভাইফোঁটা নেওয়ার আর বড়দিন উদযাপন করার অভিজ্ঞতা মন ছুঁয়ে যায়। বইটিতে ফল্গুধারার মতো যে সম্প্রীতির সুর বয়ে চলেছে তা পাঠকের মন ভাল করে দেয়।
ফেলে আসা দিনের কথা
মইনুল হাসান ।। সূত্রধর
১১০ টাকা