আশিস গুপ্ত, দিল্লি: গত কয়েকবছর ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে বিজেপির ব্লক স্তরের নেতারা পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতিকে বিশ্বের প্রথম তিনটি স্থানে পৌঁছে দেবার অঙ্গীকার করছেন। আর এই সম্ভাব্য উত্থানের জন্য নরেন্দ্র মোদির জয়ধ্বনি দিচ্ছে তাঁর ভক্তকুল। অথচ গেরুয়া শিবিরের এই প্রচারের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। কারণ, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রায় এক দশক আগেই বিশ্বদরবারে ভারতের অর্থনীতির বিজয়ডঙ্কা বাজিয়ে দিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং।
আরও পড়ুন-বছরের শুরুতে দিঘায় ৩ দিনের মিষ্টি উৎসব
২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরের বছরেই ২০০৫ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে ওয়াশিংটন ডিসিতে এক যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় অর্থনীতিবিদ মনমোহন বলেছিলেন, বিশ্বের এক প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থান একটি ধারণা, যার সময় এসে গিয়েছে। এই বক্তব্য সেদিন ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার, উদারীকরণ এবং বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের ক্রমবর্ধমান অবস্থানকে তুলে ধরেছিল। এর মাধ্যমে মনমোহন সিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল যে ভারত একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং উপযুক্ত সময়ে তা সম্ভব হবে।
নিজের দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও বাস্তবতা নিখুঁতভাবে ব্যক্ত করতে যে আত্মপ্রত্যয় ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন, তা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের ক্ষমতায় তুলে ধরেছিলেন ড. মনমোহন সিং। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে। ১৯৯১ সালে যখন ভারত এক গভীর আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, তখন তাঁর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব ভারতকে সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মনমোহন সিংয়ের ভূমিকা ভারতের অর্থনীতিকে উদারীকরণের পথে নিয়ে গিয়েছিল এবং অর্থনৈতিক বিশ্বে প্রকৃতই এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।১৯৯১ সালে ভারত তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার এতটাই শূন্য হয়ে পড়েছিল যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা ছিল দেশের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য ভারতকে স্বর্ণভাণ্ডার বন্ধক রাখতে হয়েছিল। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক চাপে দেশ কার্যত অর্থনৈতিক স্থবিরতায় পড়ে যায়। আর সেইসময় ড. মনমোহন সিং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও-এর নেতৃত্বে ভারতকে এক মুক্ত অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক নীতিমালায় বিরাট ও মৌলিক পরিবর্তন আনেন। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতা কমিয়ে বেসরকারি খাতের বিকাশে সুযোগ দেওয়া, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভারতের বাজার খুলে দেওয়া। টাকার অবমূল্যায়নে রপ্তানিমুখী শিল্পকে উৎসাহিত করা। আর সেইসঙ্গে শিল্পখাতে উৎপাদন এবং ব্যবসার জন্য অনুমতির প্রক্রিয়া সহজ করা। ভারতের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন ছিল যুগান্তকারী।
আরও পড়ুন-যশস্বীর রান আউটে হতবাক স্মিথরাও
মনমোহন সিং বলেছিলেন, সংস্কারের কার্যক্রম দৃঢ়তার সঙ্গে চালাতে হবে, যাতে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মনমোহন সিংয়ের আর্থিক সংস্কারের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে উন্নত হয়। বিদেশি বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশ বড় সাফল্য অর্জন করে। সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকাগুলি যুগোপযোগী তো বটেই, সেইসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমদানি-রফতানি নীতির উন্নতির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। কর্পোরেট খাত এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। সেদিন মনমোহন সিংয়ের উদ্যোগের ফলেই ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি, উৎপাদন, এবং পরিষেবা খাতে দেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করেছে। তার উদার নীতিমালা শুধুমাত্র সংকট মোকাবিলায় সফল হয়নি, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। মনমোহন সিং নিজে কেবল একজন সুদক্ষ ও দূরদর্শী অর্থনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার অন্যতম স্থপতি। তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত এবং অগ্রগামী চিন্তাধারা ভারতকে আর্থিক সংকট থেকে বের করে এনে একটি উদার অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ড. মনমোহন সিং-এর এই অবদান ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মনে রাখবেন বিশ্ব অর্থনৈতিক বৃত্তের গবেষকরাও।