এক আদিম অরণ্য

ডুয়ার্সের চিলাপাতা। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের কাছে অবস্থিত এক গভীর বনাঞ্চল। আছে নদী, চা-বাগান। চরে বেড়ায় বন্যপশু। উড়ে বেড়ায় নানারকমের পাখি। প্রকৃতিপ্রেমীদের বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। কয়েকদিনের জন্য সদলবলে ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

অরণ্য অনেকের মন বিষণ্ন করে তোলে। চেপে বসে মনখারাপ। তবে বহু মানুষ সবুজের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেন না। ছুটে যান। সারিবদ্ধ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেন প্রাণভরে। তাঁদের জন্য পরামর্শ, ঘুরে আসুন ডুয়ার্স। উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে আছে বেশকিছু মন ভাল করা বেড়ানোর জায়গা। তার মধ্যে আলিপুরদুয়ার জেলার চিলাপাতার জঙ্গল অন্যতম। এই জঙ্গল মনের মধ্যে তুমুল আনন্দের জন্ম দেবে। বনাঞ্চলটি অবস্থিত জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের কাছেই। এটা আসলে জলদাপাড়া ও বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যবর্তী হাতি করিডোর। রাভা উপজাতির মানুষেরা এই জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আরও পড়ুন-বেলজিয়ামের দৌড় থামানোই আজ চ্যালেঞ্জ হরমনপ্রীতদের

যাঁরা জলদাপাড়া ঘুরতে যান, তাঁদের অনেকেই চিলাপাতা ঘুরে আসেন। আবার ঘটে উল্টোটাও। চিলাপাতা ঘুরতে গিয়ে বহু মানুষ জলদাপাড়ায় যান। সবুজের হাত ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় আর এক সবুজের রাজ্যে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন লেখকের রচনায় উঠে এসেছে চিলাপাতার জঙ্গলের কথা। এই অরণ্য যথেষ্ট গভীর। দাপিয়ে বেড়ায় হিংস্র পশুর দল। যেমন বাঘ, চিতাবাঘ। কেউ কেউ দেখা পেয়ে যান। এছাড়াও গণ্ডার, গাউরের মতো একাধিক বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে। হরিণ, বাইসন তো আছেই। আছে অজগর। পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য চিলাপাতা অন্যতম প্রিয় গন্তব্য। গাছে গাছে উড়ে বেড়ায় নানারকমের পাখি। যেমন ঈগল, শিকারা, ক্রেস্টেড ঈগল, জঙ্গল ফাউল, তিতির, বেঙ্গল ফ্লোরিকান, প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচারস, র্যা কেট টেইলড ড্রংগো, পাইড হর্নবিল ইত্যাদি। চিলাপাতা বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির জন্যও পরিচিত।
একটা ইতিহাস আছে এই অরণ্য ভূমির। জনশ্রুতি, এটা ছিল কোচ রাজাদের মৃগয়াক্ষেত্র। কোচ রাজবংশের আদি পুরুষ বিশ্ব সিংহের তৃতীয় পুত্র ছিলেন চিলা রায়। ডুয়ার্সের সীমানায় আলিপুরদুয়ারের কাছে গভীর অরণ্যে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই দুর্গ রাজা নরনারায়ণের নামে পরবর্তী কালে নল রাজার গড় নামে পরিচিত হয়। চিলা রায় চিলের মতো ছোঁ মেরে শত্রু নিধন করতে পারতেন। তাঁর নামেই এই অরণ্যের নাম রাখা হয়েছিল চিলাপাতা। জঙ্গলের মধ্যে নল রাজাদের গড়টি আজও আছে। তবে ভগ্নপ্রায় দশা। গাইডদের কাছেও এই গড়ের গল্প শুনতে পাওয়া যায়। আলোকালো জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই কাহিনি শুনলে বড় রোমাঞ্চ জাগে।

আরও পড়ুন-অভিষেকের প্রশ্নের চাপে স্বীকার কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর, অতিরিক্ত মাশুলের বোঝা ৯০ শতাংশ মোবাইল গ্রাহকের

তোর্সা নদীর পাড়ে ডুয়ার্সের অন্যতম বড় বনাঞ্চল এই চিলাপাতা। দীর্ঘ তার পরিসর। জঙ্গলটি এতটাই বড় যে, গাইডরাও একদিনে সব জায়গা ঘুরিয়ে শেষ করতে পারেন না। পর্যটকদের সংখ্যাও ছিল তুলনায় অনেকটাই কম। তবে সরকারি উদ্যোগে ধীরে ধীরে বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। যাঁরা জঙ্গল সাফারি বলতেই ডুয়ার্সের জলদাপাড়া, গরুমারা বোঝেন তাঁরা একবার চিলাপাতা ভ্রমণে বেরিয়ে দেখতে পারেন। এই জঙ্গলে আছে হাতি সাফারির ব্যবস্থা। রেঞ্জ অফিস থেকে পারমিট করিয়ে তবে এই জঙ্গলে প্রবেশ করা যায়। সকাল ৫টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে জঙ্গল সাফারি।
তোর্সা ছাড়াও অনেক ছোট-বড় নদী প্রবাহিত হয়েছে চিলাপাতা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। যেমন কালাচিনি, বুড়িবসরা ও বেনিয়া। এমনিতে বেশ শান্ত। তবে ভরা বর্ষায় নদীগুলোর অন্যরকম রূপ দেখতে পাওয়া যায়। চিলাপাতায় আছে চা-বাগান। একটু দূরে পাটকাপাড়া চা-বাগান ও নিমতি অঞ্চল। এ-ছাড়াও আছে মথুরা চা-বাগান।

আরও পড়ুন-ভুল প্রেসক্রিপশন লিখছেন ৪৫ শতাংশ চিকিৎসক

নির্জন নিরিবিলি এই জঙ্গলে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে সহজে আলো পৌঁছায় না। তফাত করা যায় না দিন-রাতের। সঙ্গে গাইড না নিয়ে গেলে পথ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। চিলাপাতা জঙ্গলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল বিখ্যাত রামগুয়া গাছ। এই গাছ এখন বিপন্ন প্রায়। আর একটা কথা জেনে রাখুন, চিলাপাতা জঙ্গল কিং কোবরা সাপের আঁতুড়ঘর। সেই কারণে গাইডরা পর্যটকদের সবসময় সন্তর্পণে পা ফেলতে পরামর্শ দেন। ডুয়ার্সের যে কোনও জঙ্গলের তুলনায় অনেক বেশি আদিম চিলাপাতার অরণ্য। অল্প দূরে রয়েছে হাসিমারা, মেন্দাবাড়ি, কোদালবস্তি প্রভৃতি বেড়ানোর জায়গা। বিখ্যাত সোনাপুর চৌপথী আছে কাছেই। চিলাপাতাকে কেন্দ্র করে কয়েকদিনের জন্য দলবেঁধে জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারেন। এই অরণ্যে মন বিষণ্ন হবে বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন-উত্তর দেওয়ার সাহস নেই সীতারামণের

কীভাবে যাবেন?

আকাশপথে যেতে গেলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামতে হবে। সেখান থেকে চিলাপাতা পৌঁছতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। রেলপথে হাসিমারা থেকে চিলাপাতার জঙ্গলের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে ২৩ কিলোমিটার। নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে ২০ কিলোমিটার। সড়কপথে গেলে আগে আলিপুরদুয়ার পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে চিলাপাতার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন?

থাকার জন্য প্রচুর মনোরম রিসর্ট, আবাসন আছে, যেখান থেকে দারুণ জঙ্গল-ভিউ পাওয়া যায়। চিলাপাতা ফরেস্ট রেঞ্জের অধীনেই একটি সুসজ্জিত কাঠের প্রাচীন বনবাংলো রয়েছে। যাওয়ার আগে একটু গবেষণা করে, কোনও একটা বুক করে নেবেন। তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। মনে রাখবেন, বৃষ্টির মরশুমে কিছুদিনের জন্য জঙ্গল বন্ধ থাকে। বিস্তারিত জেনে তারপর যাবেন।

Latest article