আসল নাটকের শুরু হয় সকালে। নিত্যদিনের পালাগান। মূল চরিত্রের নাম ধরা যাক অদিতি। সাড়ে পাঁচটা বাজতেই মোবাইল জানান দেয় প্রভাত হইল। দ্রুত হাতে আওয়াজ থামিয়ে দেয় না হলে অমিতের ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্ত হয়। দশ মিনিটে নিজেকে হালকা করেই রান্না ঘরে। দুটো ওভেনের একটাতে ডাল আর একটাতে ভাতের জল। ভাত একফুট দিতে দিতেই ছ’টা রুটি বেলা হতে হবে। নিজেই বলে নেয় আপনার সময় শুরু হচ্ছে এখন। রুটির হল শুরু, ডালের হল সিটি। ডাল নামিয়ে তুলিকে ঘুম থেকে তুলে পটিতে পাঠানোর মতো কঠিন কাজটা করেই অদিতি তুলির খাবার রেডি করে, টিফিন প্যাক করে। তুলিকে খাইয়ে ড্রেস পরিয়ে বাসে তুলে মিনিট পনেরো হেঁটেও নেয়। সঙ্গে টুকটাক সবজি, মাছ নিয়ে সাড়ে সাতটায় না ফিরলে আবার কাজের দিদি টুম্পা পালাবে। বাকি রান্না দ্রুত সেরে অদিতি স্নান করে একটু পুজো করে নেয়। তার পর কোনওরকমে একটু সাজগোজ করে, খাওয়া সেরে একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে আসে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে। অমিত তখন সোফায় পেপার পড়ছে। হাতটা সামান্য ছুঁয়ে বেরোতেই বলে— রোজ এভাবে হুটোপুটি করলে হার্টের রোগ হবে, একটু আগে তৈরি হতে পারো না! টোটো থেকে নেমে দ্রুত ওভারব্রিজে ওঠে, এসকালেটারটা আজও বন্ধ। ন’টা পঞ্চাশ, তিন নম্বরে ট্রেন ঢুকছে। লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে, একটা সিট পেলে আজকের মতো প্রথম পর্বের লড়াই শেষ। ক্লাসের মাঝে হোমওয়ার্ক চেক, আড্ডা, তুলির ফেরার, মায়ের রুটিন খোঁজ নেওয়া। বাড়ির থেকে আনা দুটো রুটির সদগতি হয় সরকারি তরকারিতে। ভালবেসে খায় ওরা সবাই মিলে একসাথে। ফেরার ট্রেনে বড় ভিড়। বুকে চাপ আর পিছনে খোঁচা খাওয়া এড়াতে লেডিসেই উঠতে হয়। তুলির কিছু supw-র কাজের জিনিস নিয়ে ফিরে আসতে আসতেই সন্ধ্যার আলো জ্বলে যায় পাড়ায়। একটু চা আর সামান্য টিফিন সারে মা-মেয়ে মিলে। তুলি ক্যারাটে শিখে একাই উপরে উঠে আসে। এবার লড়াইয়ের দ্বিতীয় অংশ— পড়ানো। সঙ্গে চলে কাচা কাপড় গোছানো, টুকটাক কাজ। রাতে রুটিটা অমিত নিয়েই ফেরে। একটু চা, সামান্য কিছু কথা, কমবেশি একটা তরকারি বা চিকেনের সহজ প্রিপারেশন হয়ে ওঠে এর মাঝেই। সাড়ে দশটায় খাওয়ার পাট সেরে তুলিকে নিয়ে দিদিমা শুতে যায়। রান্নাঘর কালকের জন্য রেডি করে, নিজে একটু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আসে অদিতি। তখন বারান্দার শূন্য চেয়ার, শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদের আলো কোনও প্রেম আনে না। ক্লিভেজ প্রকট রাতপোশাক লজ্জা পায়। ল্যাপটপে মুখ গোঁজা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির টার্গেট মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়া কিছু মানুষের সময় অন্য দেশের দ্রাঘিমা রেখায় ঘোরে। বেশিরভাগই রাতের খিদে হার মানে ক্লান্তির কাছে।
টুম্পার পাঁচবাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। বাজারের মধ্যে দিয়ে যায়, ঝড়তি-পড়তি আনাজপাতি, নেতিয়ে যাওয়া কুঁচো মাছ বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। বাবলি বউদি পায়েস দিয়েছে একটু। কালকের ভাত আছে অনেকটা। বুড়ি শাশুড়ি আর ছেলের ও তার নিজের জন্য পেয়াঁজ দিয়ে কুঁচো মাছ ভাজলেই চমৎকার খাওয়া হবে। নিত্যদিনের মারধর, পয়সা কেড়ে নেওয়া, অশান্তি নেই ঠিকই তবুও প্রকাশের জন্য কখনও মনটা মুচড়ে ওঠে। বাংলা ঠেকটা রেললাইনের ওপারে না হলেই হয়তো ভাল হত। কিংবা ঠেকটা না হলেই হয়তো ভাল হত!
বাবলির দুপুরটা খুব একা লাগে। সকালটা কাজের মাসি, রান্নার দিদির তদারকি করতে করতে কাটে। দিব্য বেরিয়ে গেলে ম্যাগাজিন পড়া, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে কিছুটা সময় কাটে। জিম, সুইমিং কখনও ব্যোরিং হয়ে ওঠে। শনি সন্ধ্যার মধু আয়োজন একঘেয়ে হয়ে যায়। মনে হয় কারও হাত ধরে ভিজে ঘাসের উপর হাঁটা হয়নি কতকাল। দিব্যেন্দু বলে দুঃখবিলাস। রোজগার তো করতে হয় না কষ্ট করে, তাহলে বুঝতে। আট বছরে এসরাজে ধুলো জমে, সম্পর্কেও। ঘুঙুরটা নিখোঁজ ওডিসি নাচের তালিম-নেওয়া ছাত্রীর। আচ্ছা, সব বিলাসিতা ঝেড়ে একবার নিজের পরিচয় তৈরি করা যায় না? কালই একবার নিয়তিদির কাছে যেতে হবে। সন্ধ্যায় নিয়তি ব্যস্ত নাচের ক্লাসে, সামনেই মেয়েদের বড় কম্পিটিশন। প্রথম হওয়ার চেয়েও প্রথম হওয়া ধরে রাখার লড়াই বেশি। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই নিয়তির এখনও নাচই প্রথম প্রেম। কোনও ভাবেই নাচ বজায় রেখে সন্দীপনকে সে ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিটা প্রোগ্রামের পর বাড়ি ফিরে শুনতে হয়েছে অন্যরকম কটাক্ষ। বড়দি সুপর্ণার মতো একটা নিটোল সংসারের সাধে নিয়তি বারবার চেষ্টা করেছে। ছেলের কথা ভেবে অনেক প্রোগ্রাম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তবু ভাঙন আটকাতে পারেনি। দুঃখ পেয়েছে কিন্তু নাচ ছাড়েনি।
সুপর্ণা একজন সুখী গৃহবধূ। স্বামীর ছায়ায়, শ্বশুর, শাশুড়ির হুকুম পালন করে ছেলে-মেয়ে মানুষ করে কাটায় দিন। সন্ধ্যায় মেয়েকে টিউশনি দিতে দৌড়য়, দুপুরে ব্যাঙ্কে কিংবা অন্য কোনও কাজে, আর সকালে দৌড়ায় এতগুলো মানুষের হুকুম পালনে। সব কাজ সুপর্ণা সবসময় পরিপাটি করেই করে। আসলে দীপ্ত খুব খুঁতখুঁতে। ভুল হলেই বলে, ‘‘বাড়িতে সারাদিন বসে আছো এটুকু করে রাখতে পারো না?’’ চাকরিবাকরি করার বড় হ্যাপা, এই তো ননদ নীপা নিত্যদিন অফিসের ঝামেলার গল্প বলে। তার চেয়ে ঘর সামলানো সহজ। ভয়ে ভক্তিতে ভালবাসায় সুপর্ণা সারাদিন ছুটে বেড়ায়। নীপার অফিসে খুব চাপ। আটটায় ওকে অফিসে পৌঁছতেই হয়। জিন্স টপে খোলা স্ট্রেট চুলের ঝকঝকে নীপা একটা প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করে। স্যালারি খুব ভাল, অফিস স্টাফরা হাসিখুশি। বসও খুবই অমায়িক। চেখে দেখার মতো সাহস নেই ঠিকই শুধু চোখে দেখার নেশা প্রবল। মাঝে-মাঝেই চিয়ার আপ করেন পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে। শাড়ি পরার সাহস পায় না কোনওদিনও। তিতকুটে মনটাকে নীপা বোঝায়, চাকরিটা রাখতেই হবে সায়নের অপারেশনটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল।
এটা কোনও গল্প না। কিংবা নয় কোনও কল্পনা। মেয়েদের ব্রতকথা আর যুদ্ধের পাঁচালি। মেয়েরা সবাই কেউ না কেউ অদিতি, টুম্পা, বাবলি, নিয়তি কিংবা সুপর্ণা অথবা নীপা। এরা নিত্যদিন দৌড়াচ্ছে— সকাল থেকে রাত। কখনও স্লিম থাকতে, কখনও ট্রেন ধরতে, কখনও ঘরে ফিরতে, কখনও ছেলে-মেয়ের জন্য। কেউ অর্থের প্রয়োজনে, কেউ নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে, কেউ-বা নিরাপত্তার প্রয়োজনে। দিন পেরিয়ে আরেকটা দিন আসে, এই দৌড় থামে না। হঠাৎ বাথরুমে লাল দাগ দেখে খেয়াল হয় একটা মাস পেরিয়ে গেছে কখন। গাছের ঝরা পাতা, বাতাসে হিমেল হাওয়া জানান দেয় ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ। নতুন একটা বছর আসছে। নতুন একটা বছর শুধু সংখ্যার পরিবর্তন নাকি আর কোনও বদল আসতে পারে অদিতি থেকে নীপার দৌড়ে? যদি একটু ভাল থাকা চায় বাবলিরা তাহলে কি খুব কিছু বেশি চাওয়া হবে?
সকাল ছ’টায় উঠে যখন ভাতটা বসায় একটি মেয়ে, সে-সময় তার স্বামী যদি বাচ্চাটিকে তুলে বাথরুমে পাঠায়? যদি দ্রুত রুটি বেলে বউ অপেক্ষা করে স্বামীর বানানো কফিটা একসাথে খাবে? পাঁচটা মিনিটের একসঙ্গে বসা সব লড়াইয়ে দেবে বাড়তি অক্সিজেন।
যে অভাবী মা দিন-রাত এক করে ছেলের জন্য পরিশ্রম করে— ধরা যাক ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। পড়াশোনা শেষ করে একটা যদি একটা খাবারের দোকান খোলে? কষ্টটা অনেক লাঘব হবে সেদিন সেই একা মায়ের। এই বছর না হোক, কয়েক বছর পরেও তো হবে।
যে-মেয়ে বিয়ের পর নিজের শখের নাচ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল সে আবার নাচ শুরু করে যদি? হয়তো পুরনো টিচার ওকে সাহায্য করছে খুব? ধরে নেওয়া যাক ছোটদের একটা নাচের স্কুল খুলে ফেলল একদিন বাড়িতেই। একটা স্টেজ পারফর্ম করার পর বর যদি সঙ্গে গাড়িতে নিয়ে ফেরে তার শিল্পী বউকে, তবে সেই ভাললাগার রেশ উছলে ওঠে মুখের রেখায়। হয়তো এবছর নয়, কোনও একদিন ঠিক।
ভেঙে যাওয়া ভালবাসার সঙ্গে একটা প্রোগ্রামে মুখোমুখি হয়ে যদি আবার ভালবাসা ফিরে আসে কখনও? কখনও গল্পে নিয়তি নাচে, আসলে নিয়তি নাচায়। হয়তো একটু হেরে ভালবাসার মানুষের দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিতে একটু লজ্জা আসে, তবু যদি আবার নতুন করে শুরু করা যায়? এই নতুন বছরে নতুন করে?
দৌড়ে বেড়ানো কোনও বউকে যদি তার স্বামী একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে সকালে টিউশনটা আমি দিয়ে আসব, তুমি এত লোড নিও না? যদি ভালবেসে কোনও শাশুড়ি বিকালের চা-টা বানিয়ে আনে বউমার সঙ্গে বসে খাবে বলে? এ-বদল ক্যালেন্ডারের পাতার সঙ্গে আসে যদি মন্দ কী!
বস আজ অফিসে যদি পিঠে হাত বুলিয়ে দাদার নিরাপত্তা দেয় কোনও মহিলা কর্মীকে তাহলে কি খুব বেশি চাওয়া হবে? নতুন বছরে নতুন ভাবে স্বপ্ন দেখবে না মেয়েরা?
নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন দেখুক মেয়েরা। বদল আসবেই। বদল আনবই আমরা। সতীদাহ আমাদের সবাইকে পোড়াতে পারেনি, পণের চাহিদায় নিরুপমার সঙ্গে আমরা মরিনি। একটা চাকরি, একটু শিক্ষা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো আমাদের জোর দিয়েছে লড়াইয়ে টিকে থাকার। ফুল্লরার বারোমাস্যার দিন বদলের পালা ঠিক লিখবেনই একদিন নতুন কোনও মুকুন্দরাম।
আরও পড়ুন- আটপৌরে সহজিয়া কথাপূর্ণা