এক অক্লান্ত শিল্পী

হিম্মত শাহ ছিলেন একজন মৌলিক ভাস্কর। অক্লান্ত শিল্পী। অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত তাঁর কাজ ছিল আপসহীন। অবিস্মরণীয়। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। ভবিষ্যতের শিল্প ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব, তাঁর শৈল্পিক কাজের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তবেই থেকে যাবে এই কিংবদন্তি শিল্পীর কাজের অনন্য ধারা। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

জীবনের পাঠ
সাহসিকতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জীবন। কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তবেই সাফল্য আসবে। এই উপলব্ধি হয়েছিল কাঁচা বয়সেই। যে গ্রামে থাকতেন, সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যেত। ভরে যেত পাতকুয়ো। উপর থেকে থাকত না বোঝার উপায়। বন্ধুরা সাঁতার কাটতেন। পাতকুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে দেখতেন তিনি। কারণ সাঁতারের পাঠ ছিল তাঁর অধরা। একদিন হঠাৎ পাতকুয়োর মধ্যে পড়ে যান। কোনওরকমে নিজের জীবন বাঁচান। তখনই বুঝতে পারেন— এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই তো সাঁতার কাটা সম্ভব। এইভাবেই জলের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা হয়ে যায়। উপলব্ধি করেন— জীবন লুকিয়ে রয়েছে অসীম সাহসিকতার মধ্যেই। সাফল্য আসে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই। তিনি হিম্মত শাহ। অনন্য মৌলিক ভাস্কর হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি।

আরও পড়ুন-ধোনি-গড়ে জয়ের হ্যাটট্রিক দিল্লির

বাড়ি থেকে পালিয়ে
১৯৩৩ সালে, গুজরাতের লোথালে এক জৈন বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি ইতিহাস, মৃৎশিল্প এবং প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। অল্প বয়সেই চলে আসেন ভাবনগরে। ঘুরে বেড়াতেন কুমোর পাড়ায়, ছোট ছোট পাহাড়ে, জঙ্গলে। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও আঁকতেন ছবি। আঁকার কাগজ, রং-তুলি নিয়ে একদিন তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। একা একা চেপে পড়েন ট্রেনে। নামেন এক অচেনা অজানা জায়গায়। জঙ্গলের মধ্যে। তাঁকে আশ্রয় দেন সাধুরা। সেখানে পুজোর প্রসাদ খেয়ে তিনি পেট ভরান। গভীর রাতে দরজা খুলে তাকান প্রকৃতির দিকে। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। জেগে ওঠে তাঁর মনের শিল্পীসত্তা। আঁকতে শুরু করেন ল্যান্ডস্কেপ। একটার পর একটা। দিনের পর দিন। সেইসময় তিনি নজরে পড়েন এক বিত্তশালী শিল্প রসিকের। ভদ্রলোক ৬০০ টাকায় হিম্মতের ছবিগুলো কিনে নেন। সেই টাকায় হিম্মত আসেন আমেদাবাদ। একটি স্কুলে ভর্তি হন। নিতে থাকেন চিত্রকলার পাঠ। ঘড়শালা স্কুলে জগুভাই শাহের কাছেও তিনি চিত্রকলার পাঠ নেন। পরবর্তীতে, ১৯৫৫ সালে বরোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে যোগ দেন। মুম্বইয়ের জেজে স্কুল অফ আর্ট থেকে আঁকার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর হিম্মত ১৯৫৬ সালে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে যোগদান করেন। এনএস বেন্দ্রে, কেজি সুব্রহ্মণ্যম এবং শঙ্খ চৌধুরীর মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে আসেন। জ্যোতি ভট্ট, রাঘব কানেরিয়া, গুলাম মোহাম্মদ শেখ, ফিরোজ কাটপিটিয়া, নাগজি প্যাটেল, রজনীকান্ত পাঞ্চাল, শৈলেশ দাভে প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে তাঁদের সঙ্গে তিনি বরোদা গ্রুপ অফ আর্টিস্টের সদস্য হিসেবে প্রদর্শনীতে অংশ নেন।
অনন্য শৈল্পিক ভাষা
তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একগুঁয়ে। অদ্ভুত জীবনদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ। জীবনকে নিজস্ব শর্তে সাবলীলভাবে পরিচালনা করতেন। শিল্পের প্রতি নিজের হৃদয় ও আত্মা উৎসর্গ করেছিলেন। কাদামাটি, ব্রোঞ্জ, কংক্রিট, পুড়ে যাওয়া কাগজ, ফেলে দেওয়া বোতল এবং দড়ির মতো উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকর্ম তৈরি করতেন। এক অনন্য শৈল্পিক ভাষা গড়ে তুলেছিলেন, যা ক্রমাগত উদ্ভাবনের অদম্য প্ররোচনার ফলে উদ্ভূত হয়েছিল, যার ফলে সৃজনশীল অনুসন্ধানের অপ্রত্যাশিত ক্ষেত্রগুলো উন্মোচিত হয়েছিল। প্রতিটি উপাদানকে এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যেন তার মধ্যে প্রাণ আছে।
বিস্মিত হয়েছিলেন নেহরু
ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে হিম্মত স্বল্পস্থায়ী কিন্তু কিংবদন্তি দল ‘গ্রুপ ১৮৯০’-এর অংশ হয়ে ওঠেন। এটা এমন একটা শিল্পী সমষ্টি যাঁদের মাধ্যমে আধুনিক শিল্প নিয়েছিল নতুন বাঁক। ১৯৬৩ সালে নয়াদিল্লির রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের একমাত্র প্রদর্শনী। উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। পোড়া কোলাজের একটি সেট প্রদর্শন করেছিলেন হিম্মত। তাঁর কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। করেছিলেন ভূয়সী প্রশংসা। মেক্সিকান কবি এবং ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত অক্টাভিও পাজ তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, যিনি একটি প্রবন্ধে হিম্মতের আঁকা ছবি এবং পোড়া কাগজের কোলাজের উল্লেখ করেছিলেন। শিল্পী জে স্বামীনাথন এবং আম্বাদাস খোবরাগাড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলার পর হিম্মত ১৯৬৪ সালে নয়াদিল্লির ত্রিবেণী কলাসঙ্গমে তাঁদের সঙ্গে মিলিতভাবে প্রদর্শনী করেন। একই বছর এবং একই জায়গায় তিনি তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী করেছিলেন, যেখানে কাগজের উপর কলি দিয়ে আঁকা বেশকিছু ছবি ছিল। এমন এক শৈলীতে পরিবেশিত হয়েছিল, যা তাঁর ক্রোধ এবং পুরুষতন্ত্রকে ফুটিয়ে তুলেছিল।
বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে
১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে, হিম্মত ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে যান। সেখানে তিনি অ্যাটেলিয়ার ১৭-তে কৃষ্ণা রেড্ডি এবং স্ট্যানলি হেইটারের পরামর্শে এচিং অধ্যয়ন করেন। ঘুরে দেখেন বিভিন্ন মিউজিয়াম। জানতে পারেন কাজের স্বাধীনতা সম্পর্কে। এই সফরেই তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদে নিজেকে নিমজ্জিত করেন। প্রসঙ্গত, তাঁকে ফরাসি বৃত্তির জন্য সুপারিশ করেছিলেন পাজ। মূলত ডিজাইন শেখার জন্য। এই প্রবাস হিম্মতের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্যারিসের আগে তিনি মূলত চিত্রকলা এবং কোলাজ নিয়ে কাজ করেছিলেন। অ্যাটেলিয়ার ১৭-তে, তিনি লিথোগ্রাফি এবং এচিংয়ের মতো মুদ্রণ কৌশলগুলিতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যা তাঁর শৈল্পিক ভাষাকে বিশেষ রূপ দিয়েছিল। এটা মনে রাখা উচিত যে, তিনি সর্বদা রূপক নিয়ে কাজ করতেন। শিল্পের নিম্ন বা জাগতিককে উচ্চ নান্দনিকতায় রূপান্তরিত করার অসীম ক্ষমতা তাঁর ছিল। ওই পর্বে, ১৯৬৭ সালে প্যারিস বিয়েনালে দুটি ছবির প্রদর্শনী করেন। ভারতে ফিরে আসার পর, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে একটি যুগান্তকারী প্রকল্প শুরু করেন, যেখানে তিনি আমেদাবাদের সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ইট, সিমেন্ট এবং কংক্রিট ব্যবহার করে একটি স্মারক উচ্চ রিলিফ ম্যুরাল ডিজাইন এবং নির্মাণ করেন। হিম্মতের স্থপতি বন্ধু হাসমুখ প্যাটেলের আমন্ত্রণেই এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল।
অতিরিক্ত টিকিটে দিল্লি
১৯৬২ সালে। হিম্মত দিল্লিতে যান। এক বন্ধুর সঙ্গে, যাঁর কাছে অতিরিক্ত ট্রেনের টিকিট ছিল। হিম্মত সেখানেই থেকে যান। কে জি সুব্রহ্মণ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি তাঁকে গড়ি ললিত কলা শিল্পী স্টুডিওতে শিল্পচর্চা করার এবং থাকার জন্য জায়গা দিয়েছিলেন। হিম্মত সেখানে আনন্দের সঙ্গে থাকতেন এবং আপনমনে কাজ করতেন। ভাস্কর্য শেখাতেন। এইভাবেই তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে ক্রমাগত আত্ম-প্রকাশের নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। একাধিক পুরস্কার এবং বহু প্রদর্শনী সত্ত্বেও, ওই সময়কালে তিনি ভাল বিক্রি করতে পারেননি। যদিও সেটাই ছিল সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তাঁর সোনালি অধ্যায়। তখনই তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলেন। বলা যায়, শিল্পকে তিনি কেবল একটি পণ্য হিসেবে দেখেননি। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। হিম্মতের একটি ট্রেডমার্ক রূপ হল ‘মাথা’। প্রতীকী এবং দৈনন্দিন জীবনের এক অলৌকিক মিশ্রণের সমন্বয়ে গঠিত। এই রূপ কিন্তু প্রচলিত অর্থে রূপক বা সম্পূর্ণ বিমূর্ত নয়। তবে সহজবোধ্যও বলা যায় না। মাথাগুলো যথেষ্ট সময় দিয়েই তৈরি করতেন। কখনও কখনও পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তারপর তিসির তেলে ডুবিয়ে শক্ত করা হত এবং রূপালি ফয়েল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত, যাতে মাথাগুলোকে অকাল দেবতার মতো দেখায়।

আরও পড়ুন-প্রথম বাঙালি-মহিলা হিসেবে ইন্ডিয়ান আইডল কি মানসীই

বিশ্বব্যাপী প্রদর্শনী
তাঁর কাছে কেউ গেলে শিল্প, দর্শন, সঙ্গীত জীবন এবং জীবনের সারাংশ সম্পর্কে অনর্গল কথা বলতেন। কেবল পাঠ থেকে নয়, তিনি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন অভিজ্ঞতা থেকে। তরুণদের মধ্যে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আট এবং নয়ের দশকে হিম্মত দিল্লির রবীন্দ্রনগর এলাকায় থাকতেন। পরবর্তী সময়ে জয়পুরে চলে যান। সেখানে তিনি রাজস্থানের বিখ্যাত সাদা এবং কালো মার্বেল পাথর নিয়ে কাজ করেন। ২০০০ সালের মধ্যে, হিম্মত জয়পুরে তাঁর নিজস্ব স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। কেএনএমএ তাঁর কাজে বিনিয়োগ করেছিল। ২০১৬ সালে আয়োজিত হয় প্রদর্শনী। পরবর্তীতে তাঁর ভাস্কর্যগুলো বিশ্বব্যাপী প্রদর্শিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লুভর, রয়েল অ্যাকাডেমি অফ আর্টস, প্যারিস বিয়েনাল, মিউজিয়াম লুডভিগ, মিউজিও দে লা ন্যাসিওন, লিমা এবং দিল্লি ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট। তাঁর জয়পুরের স্টুডিওয় সবার জন্য ছিল অবারিত দ্বার। স্বপ্ন দেখেছিলেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি আর্ট স্কুল তৈরি করার। কিন্তু তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। বিভিন্ন সময় মুখোমুখি হয়েছেন অভাব, অনটনের। নানা কারণে হয়েছেন সমালোচিতও। তবে কোনওদিনই বিচলিত হননি হিম্মত। আপনমনে করে গেছেন কাজ। শিল্পের প্রতি থেকেছেন সৎ। পেয়েছেন সমঝদারদের ভালবাসা, প্রশ্রয়।

আরও পড়ুন-সেরা থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাঁওতালডিহি

অপরিসীম অবদানের জন্য
ধ্রুপদী সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। শুনতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আপনভোলা মানুষ। সংসারী হননি। মাঝে মাঝে নিজের হাতে রান্না করতেন। দিন থেকে রাত, করতেন অক্লান্ত পরিশ্রম। শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর প্রশংসনীয় অনুশীলন এবং অপরিসীম অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে সাহিত্য কলা পরিষদ সম্মান এবং ২০০৪ সালে কালিদাস সম্মান পেয়েছিলেন। পেয়েছেন আরও কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর জীবনকর্ম নয়াদিল্লির রুবিনা কারোড, কিরণ নাদার মিউজিয়াম অফ আর্টের ‘হ্যামার অন দ্য স্কয়ার’-এ সংরক্ষিত করা হয়েছে। এই বছর ২ মার্চ, জয়পুর শালবি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯২ বছর বয়সে হিম্মত শাহ প্রয়াত হন। দিকে দিকে চলছে তাঁর স্মরণসভা। এই সময় ভবিষ্যতের শিল্প ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব, তাঁর শৈল্পিক কাজের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তবেই থেকে যাবে কিংবদন্তি শিল্পীর কাজের অনন্য ধারা।

Latest article