পিছু করা ডাইনি, তিন চোখের ডাইনি, ডাইনির কম্বল, কিংবা ডাইনির কবলে টোনাটুনির গল্প তো অনেক শুনেছি। কিন্তু ডাইনির খপ্পরে রিগেল— এ তো এক মহাজাগতিক ডাইনির গল্প, যেন রূপকথার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। ওরে বাপরে, লম্বা টুপি মাথায়, হাতে উড়ন্ত ঝাড়ু, দাঁড়িয়ে নাক বাঁকানো হ্যালোইন ডাইনি, যেন ল্যাজ উঁচিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিগেলের উপর— সুযোগ পেলেই আর কি!
আরও পড়ুন-দিনভর টালায় মেরামতি, আজ থেকে স্বাভাবিক জল সরবরাহ
অন্ধকার রাতের মহাকাশে নক্ষত্রের আলোয় ভেসে ওঠা বিদঘুটে একটি নির্গমন নীহারিকা, দেখতে একেবারে ডাইনির মতো, কিম্ভূতকিমাকার মাথাটা বার করে যেন অদ্ভুত লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপারজায়ান্ট স্টার রিগেলের উপর। রিগেলের উপর ডাইনির নজর! মহাকাশ চিত্রগ্রাহক জনাব সাইমন কার্জির লেন্সে এমন ছবিই ধরা পড়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মজা করে নাম রেখেছেন উইচ হেড নেবুলা বা ডাইনির মাথা নীহারিকা।
নিসর্গবিদেরা মজা করে বলেন, ম্যাকবেথের উচিত ছিল এই উইচ হেড নেবুলার সঙ্গে শলাপরামর্শ করার, কেননা গল্পের ডাইনির চেয়েও এই নীহারিকাটিকে অনেক বেশি রহস্যময়ী বলে মনে হয়। ইংরেজি সাহিত্যিক শেক্সপিয়ারের একটি শোকান্ত নাটকের নাম ম্যাকবেথ, এবং ম্যাকবেথ ওই গল্পের নায়ক, স্কটল্যান্ডের একজন বীর যোদ্ধা। একদিন তাঁর মতিভ্রম হয় এবং তিনজন ডাইনির কথা শোনেন, তিনি নাকি একদিন রাজা হবেন। কিন্তু তিনি সাতপাঁচ না ভেবে স্ত্রীর কথা শুনে রাজা ডানকানকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন, এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যান। ফলে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়; একদিন প্রতিশোধপরায়ণ ম্যাকডাফ তাঁকে হত্যা করেন এবং সিংহাসন দখল করেন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, তবে এবার ওই নিসর্গতটেও কি কোনওপ্রকার অনর্থ হতে চলেছে!
উইচ হেড নেবুলা
আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণার সমন্বয়ে সৃষ্ট, প্রায় পঞ্চাশ আলোকবর্ষ দূরত্ব জুড়ে বিস্তৃত, উজ্জ্বল নক্ষত্র রিগেলের আলোয় আলোকিত, অত্যন্ত ঝাপসা নির্গমন নীহারিকা এই উইচ হেড নেবুলা বা ডাইনির মাথা নীহারিকা। মনে করা হয় এটি কোনও এক প্রাচীন মহাজাগতিক ঝঞ্ঝা, সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ, কিংবা নক্ষত্রের আলোয় রঞ্জিত গ্যাসীয় মেঘপুঞ্জ। পৃথিবী থেকে প্রায় ৯০০ আলোকবর্ষ দূরে মহাশূন্যের এরিডানুস নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত এই নীহারিকাটি। দেখতে অদ্ভুত আকৃতির, তাই বিজ্ঞানীরা এর নাম রেখেছেন উইচ হেড নেবুলা। অনেক সময় একে আবার ‘আই সি ২১১৮’ রূপেও চিহ্নিত করা হয়। অন্তরীক্ষে এর অবস্থান দেখে মনে হয়, একটি ডাইনি যেন তাঁর রাক্ষুসি দৃষ্টি দিয়ে রিগেলের উপর নজর রেখেছে! সুযোগ পেলেই গিলে খাবে!
এই নির্গমন নীহারিকাটির বিচিত্র রঙের জন্য শুধুমাত্র রিগেলের আলোই দায়ী নয়, এর কারণ নীহারিকার মধ্যে উপস্থিত ধূলিকণা। রিগেল থেকে আগত তীব্র নীল আলো ধূলিকণার সংস্পর্শে বিচ্ছুরিত হয়ে যায়, যা উইচ হেড নেবুলাকে আরও রহস্যময়ী করে তোলে। ওই প্রকার ধূলিকণা অন্যান্য আলোর চেয়ে নীল রঙের আলোকে অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে বিচ্ছুরণ ঘটায়; ঠিক একই কারণে পৃথিবীর দিনের বেলার আকাশ নীল দেখায়। তবে এক্ষেত্রে আলোর বিচ্ছুরণের জন্য ধূলিকণা নয়, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন গ্যাসের মলিকিউলস দায়ী।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
রিগেল দ্যা সুপারজায়ান্ট স্টার
মায়াবী তারকাখচিত রাতের আকাশে, সপ্তম উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটিই হল রিগেল। সূর্য থেকে প্রায় ৮৬০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ওরিয়ন তারামণ্ডলের মধ্যবর্তী ন্যূনতম চারটি তারার সমন্বয়ে গঠিত ‘স্টার সিস্টেমে’র যে একাকী উজ্জ্বল নীল-সাদা ছাপার আলোক বিন্দু আমাদের চোখে পড়ে, সেটাই রিগেল। মেন সিকোয়েন্স স্টার রিগেল একটি নীল-অতিদানব-নক্ষত্র! জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহান বেয়ার ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে ইউরানোমেট্রিয়া নামে ১৫৬৪টি নক্ষত্রের যে স্টার অ্যাটলাস প্রকাশ করেন, তার অন্যতম নক্ষত্র হল রিগেল। এই তালিকায় উক্ত নক্ষত্রগুলোকে তাদের অবস্থান-তারামণ্ডলের নামের আগে একটি গ্রিক কিংবা ল্যাটিন অক্ষর জুড়ে চিহ্নিত করা হয়। এইপ্রকার নামকরণকে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘বেয়ার ডেস্টিনেশন’ বলা হয়ে থাকে। এই অনুযায়ী রিগেল ‘বিটা ওরিওনিস’ বা ‘বিটা ওরি’ রূপেও পরিচিত।
সৌর ভরের প্রায় ১৮–২৪ গুণ বেশি ভারী এই নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার গুণ বেশি উজ্জ্বল। রিগেলের ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের প্রায় ৭০ গুণ। এই গ্রহটির পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা প্রায় ১২১০০ কেলভিন। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই নক্ষত্রটির আনুমানিক বয়স ৭–৯ মিলিয়ন বছর। প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে এবং ২৪ জানুয়ারি রাত্রি ন’টার সময় রিগেল তার পূর্ণ উজ্জ্বলতম রূপ নিয়ে আকাশের বুকে ভেসে ওঠে। এই তারাটি শীতের সন্ধ্যায় উত্তর গোলার্ধে এবং গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দক্ষিণ গোলার্ধে দৃশ্যমান। তবে দক্ষিণ গোলার্ধে ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের এটিই প্রথম নক্ষত্র যাকে দেখা যায়, উত্তর গোলার্ধের ক্ষেত্রেও এটিই প্রথম। আকাশের বুকে এই নক্ষত্রটি অ্যালডেবারান, ক্যাপেলা, পোলাক্স, প্রোসিওন এবং সিরিয়াস নক্ষত্রের সঙ্গে একত্রে একটি ষড়ভুজের আকার ধারণ করে। বিষুব অঞ্চলের ৮২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ছেড়ে পৃথিবীর সমস্ত মহাসাগরের বুক থেকে এই নক্ষত্রটি অবলোকন করা সম্ভব, তাই অনেক সময় বিজ্ঞানীরা একে ‘ইক্যুইটোরিয়াল নেভিগেশন স্টার’ও বলে থাকেন।
আরও পড়ুন-২৪ ঘণ্টার মধ্যে চাই বাংলাদেশ নিয়ে বিবৃতি
রিগেলের ভবিতব্য
তারামণ্ডলের নাম ওরিয়ন, শব্দটি গ্রিক পুরাণের শিকারি ওরিয়নের নামানুসারে নেওয়া। রিগেল এই নামটিও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন বহু বোঝাপড়ার পরা গ্রহণ করেন। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের পৌরাণিক আ্যালফনসাইন তালিকায় আরবিতে এই নক্ষত্রটি ‘রিজল্ জওজাহ্ আল-য়্যুসরা’ নামে উল্লেখিত ছিল; আরবিতে রিজল্ শব্দের অর্থ পা এবং জওজাহ্ মানে ওরিয়ন তারাপুঞ্জ। অর্থাৎ এই নক্ষত্রটি হল ওরিয়ন তারা পুঞ্জের বাঁ পা। সেইসময় আব্দ-অল রহমান আল-সুফিও তাঁর ‘ফিক্সড স্টারস’ বইয়ে এই রূপেই রিগেলের বর্ণনা দিয়েছেন। আরবি থেকে উদ্ভূত শব্দানুযায়ী ইংরেজ পণ্ডিত এডমান্ড চিলমিড এর নাম রাখেন রিগেল অ্যালগিউজ বা আলজিব্বার, জার্মান জ্যোতির্বিদ উইলহেম শিকার্ড রাখেন রিগলন, সতেরো শতকে ইটালিয়ান জ্যোতির্বিদ জিওভানি বাতিস্তা রিসিওলি নাম দিয়েছিলেন রেগেল; অতঃপর আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় রিগেল।
এ ছাড়াও রিগেল আরও নানা রকম নাক্ষত্রিক পরিচয়ে অভিহিত। বিভিন্ন ক্যাটালগ অনুযায়ী কখনও এর নাম ফ্ল্যামসিড ১৯ ওরিওনিস, কখনও এইচআর১৭১৩, তো কখনও আবার এইচডি ৩৪০৮৫। যাইহোক এই নক্ষত্রটি ক্রমাগত তার কেন্দ্রীয় হাইড্রোজেন পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলছে, ক্রমশ শীতল হয়ে বিস্তার লাভ করছে, পরিণত হয়েছে সুপারজায়ান্টে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে, আর বেশি দেরি নেই এই সুপারজায়ান্ট স্টার মহাবিধ্বংসী সুপারনোভা ঘটাবে। ফেটে চৌচির হয়ে রেখে যাবে অগণিত মহাজাগতিক নুড়ি, সঙ্গে হয়তো একটি নিউট্রন স্টার, নয়তো একটি কৃষ্ণ গহ্বর!