প্রতিবেদন : এনএফএইচএস-৫ বা জানুয়ারি ২০২০ থেকে, এপ্রিল ২০২১-এর চালানো সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে শিশুমৃত্যুর হার, শিক্ষায় যোগদান, টিকাকরণ-সহ নানা বিষয়ে পূর্ববর্তী সমীক্ষার ফলাফলের (২০১৫-’১৬) তুলনায় বেশ খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে মোট জিডিপি-র যে সামান্য অগ্রগতি বিশেষভাবে উল্লিখিত হওয়ার দাবিদার।
এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত আর-একটি বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক হইচই লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সমীক্ষার ফলে প্রকাশ, দেশে এখন ১০০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার সংখ্যা বেশি, ১০২০ জন। মহিলার সংখ্যাধিক্যের ঘটনা এর আগে কোনওদিনই ঘটেনি। তাই, এ নিয়ে মাতামাতি অনেকটা বেশি, খানিকটা মাত্রাতিরিক্ত। মাত্রাছাড়া বলার কারণ একটাই। জন্মের সময় নারী-পুরুষের অনুপাত দেখলে তবেই ঠিকঠাক ভাবে বোঝা সম্ভব যে, দেশে সত্যিই ‘বেটি বাঁচাও’ আহ্বানের সুফল দেখা যাচ্ছে। জাতীয় স্তরে জন্মের সময় ছেলে-মেয়ের অনুপাত (জন্মহারের নিরিখে) এদেশে ২০১৫-’১৬-তে ছিল ১০০০ জন ছেলেপিছু মেয়ের সংখ্যা ছিল ৯১৯ জন। ২০১৯-’২১-এ তা বেড়ে হয় ৯২৯।
এ-পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এতেই যে ছবিটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তা নয়— পিকচার আভি বাকি হ্যায়!
এই সমীক্ষার ফলাফল জানাচ্ছে, পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ এখন রক্তাল্পতায় ভুগছে। আগে এই হার ছিল ৫৮.৬ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ এখন রক্তাল্পতার শিকার। আগে কিন্তু ৫৩.১ শতাংশ এতে ভুগতেন। দেশের ২৫ শতাংশ পুরুষও এখন রক্তাল্পতায় ভোগেন। আগে এটা ছিল ২২ শতাংশ পুরুষের মধ্যে। তার চেয়েও বড় কথা, রক্তাল্পতার এই ছবিটা কমবেশি দেশের সব ক’টি রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যে-রাজ্যে জনগণের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি রক্তাল্পতার শিকার, সেই রাজ্যটি হল বিজেপিশাসিত গুজরাত। সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে ৭৯.৭ শতাংশ মানুষ রক্তল্পতায় ভোগেন। স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোট জনসংখ্যার কিছু লোক রক্তাল্পতায় ভুগতে পারেন, ভুগতেই পারেন। তবে সেটা ২০-৪০ শতাংশের মধ্যে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।
দেশে যে-রাজ্যে সবচেয়ে কমসংখ্যক ব্যক্তি রক্তাল্পতার শিকার, সেটা হল অবিজেপিশাসিত রাজ্য কেরল। সেখানে ৩৯.৪ শতাংশ মানুষ রক্তাল্পতায় ভোগেন।
এর থেকে একটা কথা পরিষ্কার, সমগ্র দেশ আজ রক্তাল্পতায় ভুগছে। আর সেটা জানা যাচ্ছে সরকারি সমীক্ষা থেকেই। সেজন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু রক্তাল্পতাকে জনস্বাস্থ্যের একটি উদ্বেগপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছে।
এনএফএইচএস-এর সমীক্ষা চালানোর সময় সমীক্ষাকারীরা একটা প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটা এরকম : আপনি কি মনে করেন পত্নীর ওপর পতির শারীরিক নির্যাতন চালানো উচিত? স্বামীর কি উচিত স্ত্রীকে ধরে পেটানো? এই প্রশ্নের উত্তরে ১৮টি রাজ্যের মানুষ যা বলেছেন তা এককথায় গভীর উদ্বেগের বিষয়।
বিজেপিশাসিত কর্নাটকের ৮১.৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন স্ত্রীকে পেটানোটা স্বামীর পক্ষে অতি-সঙ্গতকর্ম। এহ বাহ্য! সে-রাজ্যের ৭৬.৯ শতাংশ মহিলাও এ-কথা মনে করেন। বিগ ফ্লপ দেব শাসিত ত্রিপুরা রাজ্যে ও ২৯.৫ শতাংশ মহিলা এবং ২১.৩ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রহার কার্যত স্বামীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশেও প্রায় ৮৪ শতাংশ মহিলা এবং প্রায় ৬৭-৭০ শতাংশ পুরুষও পত্নীনির্যাতনের পক্ষে নিজেদের অভিমত জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন : নন্দীগ্রামে কেন্দ্রের কৃষকবঞ্চনা, বিজেপির গুন্ডামি জমি অধিগ্রহণে বঞ্চনার অভিযোগ
এই সমীক্ষার সূত্রে জানা যাচ্ছে, মোটামুটি সাতটি কারণে পত্নীপ্রহার বৈধ বলে বিবেচনা করছেন মানুষজন। এই সাতটি কারণের মধ্যে আছে— ১. স্বামীকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখা। ২. ঘর-গৃহস্থালি ও বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজে অবহেলা। ৩. স্বামীর মুখে-মুখে কথা বলা, তার সঙ্গে তর্ক করা। ৪. ঠিকমতো রান্না না-করা। ৫. শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের মান্য না করা ইত্যাদি।
একুশ শতকের ভারতেও যখন এ-সব কারণে বধূনির্যাতন বৈধতা পায়, তখন দুটো জিনিস বুঝতে অসুবিধা হয় না। এক, দেশে মহিলাদের ক্ষমতায়নের চিত্রটা কতখানি উজ্জ্বল এবং দুই, দেশ মধ্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিকতার দশা কতখানি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সে-সঙ্গে এটাও বোঝা যায়, পারিবারিক হিংসার কুৎসিত শিকড় এদেশের কতটা গভীরে ছড়িয়েছে।
এর পরেও কি বলা যাবে, ভাল আছে আমার দেশ? ভাল আছে আমার দেশের মহিলারা?
রবিঠাকুর ‘ল্যাবরেটারি’তে লিখে গিয়েছেন, ‘স্বামী হবে এঞ্জিনিয়র আর স্ত্রী হবে কোটনা-কুটনি, এটা মানবধর্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ।’
মানবধর্মশাস্ত্রে কোনটা নিষিদ্ধ আর কোনটা সিদ্ধ প্রথা, তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার।
আজকের ভারতে বাস্তবের শাস্ত্রে মানুষ রক্তাল্পতায় ভুগবে আর পত্নীরা পতিদের দ্বারা প্রহৃত হবেন— এগুলোই অনুমোদিত বিষয়।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!