পূর্ণেন্দু বসু: মোদিতন্ত্র! কথাটার মধ্যেই একটা স্বৈরতান্ত্রিক গন্ধ। ক্ষমতার সিংহাসনে বসার সময় নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ‘গুড গভর্ন্যান্স’ বা সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সংসদের প্রবেশদ্বারে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হয়ে, সংসদ-মন্দিরের মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কোথায় কী! সবই কথার কথা! সংসদকে এড়িয়েই তাঁর সবকিছু।
আমরা দেখলাম সাত বছরে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এবং তাঁর শাগরেদ অমিত শাহের পূর্ণ সহযোগিতায়, কীভাবে সংবিধানিক সংস্থাগুলিকে শাসকের অধীনস্ত করা হয়েছে। চরম অপব্যবহারে দীর্ণ করা হয়েছে আইন বলবৎ করার সাংবিধানিক শক্তি তথা পুলিশি ব্যবস্থাকে। বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা করার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর রাজনীতিকরণ ঘটেছে ব্যাপক হারে। এই সময়ে আমরা দেখেছি অসহ্য ঔদ্ধত্য ও অনুভূতিহীনভাবে জনমতকে উপেক্ষা করার শাসকীয় কর্মপদ্ধতি। ভিন্নমতকে প্রবল পরাক্রমে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে মোদি-শাসন অতি-তৎপর। মিথ্যা প্রচার ও শাসকের ভাবমূর্তি নির্মাণে মোদিতন্ত্র গোয়েবেলসকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আরও পড়ুন : এফবি–র নাম বদল
এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নরেন্দ্র মোদি সুশাসনের সমস্ত ব্যবস্থাটিকে সুচারুভাবে ভোঁতা করে দিয়েছেন। এর জন্য তিনি এবং তাঁর অদম্য ক্ষমতার ক্ষুধাকেই দায়ী করা যায়। মানুষের পক্ষে অমঙ্গলকারী, অনিষ্টকারী, বিদ্বেষপরায়ণ ও এক হিংসুটে শাসনব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন এই মহাবলী শাসক। সাত বছর ধরে ধর্মের ভিত্তিতে দেশে বিভাজনের রাজনীতিকে সামনে আনা হয়েছে। জাত-পাত ও আঞ্চলিকতাকে প্রধান্য দিয়ে আরও-আরও রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার জাল বিছানো হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। তাঁর সরকার সমাজের সব স্তরের মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। ছাত্র হোক, কৃষক হোক কিংবা বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-বিজ্ঞানী বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে শিক্ষাঙ্গন— এমনকী সমাজ-কর্মীরাও মোদির দুঃশাসনের হাত থেকে রেহাই পাননি।
মোদির শাসনে বিরোধী দলগুলির নেতাদের টার্গেট করা হচ্ছে। এর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সিবিআই, ইডি, এনআইএ, আয়কর বিভাগ এবং শাসক-ঘনিষ্ঠ পুলিশ বাহিনীকে। এ-ছাড়া নির্বাচনী বন্ডের হাজার-হাজার কোটি টাকা ব্যবহার করে মোদি-জমানায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অন্তত ৯টি রাজ্য সরকারকে উল্টে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে এই আমলে উপনিবেশসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর অফিস (পিএমও)-ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। মন্ত্রীদের কোনও গুরুত্ব নেই। করোনাকালে কোনও মন্ত্রীর কিছুমাত্র ভূমিকা দেখা যায়নি। সরকারের সচিবেরা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও কিছু ভূমিকা নিতে পারেন, মোদিতন্ত্রে এমন ভাবনার কোনও জায়গা নেই। পিএমও-র অর্ডার মানাটাই তাঁদের কাজ। তাই উন্নত মেধার মানুষেরা এই সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চান না। অনুগত আমলাদের নিয়েই কাজ করতে অভ্যস্ত মোদি। তাঁর কথাই শেষ কথা।
বর্তমান শাসনব্যবস্থায় কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কোনও ব্যবস্থা নেই। সে সংসদ বা মন্ত্রিসভা যা-ই হোক না কেন। জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াটাই মোদিতন্ত্রের দস্তুর। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নোটবন্দি, জিএসটি, লকডাউন, নির্বাচনী তহবিল, সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া, জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থান বদলে দেওয়া, সিএএ— এনআরসি, ইউএপি আইনের সংশোধন-সহ কৃষি আইন ও শ্রমকোড পাস করানো ইত্যাদি যেটাই হোক না কেন। এ-সব কিছুই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের ওপর। সাধারণ মানুষ বারবার বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদির ‘সুশাসন’-এ আমরা কেমন আছি? কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে—
• স্বাধীনতার মানদণ্ডে ১৬২টি দেশের মধ্যে আমরা আছি ১১১ নম্বরে। ২০১৪ থেকে ১৭টি দেশের পিছনে চলে এসেছি। ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর্থিক স্বাধীনতা এবং মানবিক স্বাধীনতার বিচারে আমারা পিছিয়ে পড়েছি।
• সম্মিলিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবোন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতে ১৮৯টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৩১-এ। এক্ষেত্রেও আমরা নিচে নেমেছি।
• বিশ্বক্ষুধার নিরিখে ১১৬টি দেশের মধ্যে আমরা আছি ১০১তম স্থানে। ক্ষুধার্তের সংখ্যা বাড়ছে।
• আর্থিক স্বাধীনতার বিচারে আমরা ৭৯তম স্থান থেকে নেমে এসেছি ১০৫ নম্বর স্থানে।
• পরিবেশ সংরক্ষণের মানদণ্ডে ১৭৩টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান হল ১৬৮-তে। কী ভয়াবহ চিত্র!
• বিশ্ব সংবাদমাধ্যম (প্রেস)-এর স্বাধীনতার নিরিখে আমরা ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম স্থানে অবস্থান করছি।
• ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের পঞ্চম রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে অপুষ্টি বেড়ে চলেছে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে।
• আমাদের দেশে জনসংখ্যার এক শতাংশ ধনী ৪৫.৪ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। ওপরের ১০ শতাংশ ধনী নিয়ন্ত্রণ করছে ৭৪.৩ শতাংশ সম্পদ। আর দেশে বাড়ছে ক্ষুধা ও অপুষ্টি। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে মানুষের ওষ্ঠাগত প্রাণ।
উপরের তথ্যগুলি মোদি-জামানার প্রকৃত চেহারাটা তুলে ধরছে। এ-সব তথ্য সরবরাহেও মোদিতন্ত্রের ঘোর আপত্তি। এ-সব অপশাসনের লক্ষণ। সমস্যা আরও আছে। মোদি-জামানায় (৭ বছরে) দেশে বেকারের সংখ্যা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ। রেকর্ড বইকী! সামগ্রিক অর্থনীতি ভয়ঙ্কররূপে বিপর্যস্ত। জিডিপির পতনেও রেকর্ড। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই আম-পাবলিকের জীবনে সবথেকে বড় সমস্যা। পেট্রোপণ্যের আকাশ-ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
মোদিতন্ত্রে যে দুঃশাসনের প্রতিষ্ঠা আমাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ, তার মূলে আছে মোদি-প্রশাসনের নৈতিকতা বোধের লুপ্তপ্রায় দশা। উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে তা কি শুধু আদিত্যনাথের হিতাহিত জ্ঞানের অভাব? নাকি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধিতার পরিসর সম্বন্ধে দিল্লির অধিশ্বরদের চরম অশ্রদ্ধা? আসলে সমস্ত বিরোধিতাকেই এঁরা যেভাবে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত— সেই মানসিকতাই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় শাসকেরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তাতে বিজেপির নেতা-মন্ত্রী-বাহুবলীরা নিদারুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রতিবাদী মানুষের ওপর।
এদের দুঃশাসনে ক্ষতি হচ্ছে দেশের। ক্ষতি হচ্ছে মানুষের। দলের সরকার সাময়িক। কিন্তু দেশ বা রাষ্ট্র থাকছে। থাকবে আরও অনেকদিন।