আধার আমাদের দাবি, আধার ভোটারের অধিকার

ভাবুন, বিহারে মাত্র দেড় বছরে অর্থাৎ ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে গৃহীত নির্বাচকদের তালিকা প্রকাশ থেকে ২০২৫-এর SIR প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মধ্যে ২২ লক্ষ লোক মৃত! তার মানে একটি রাজ্যে দেড় বছরে এত মৃত্যু! এ তো অতিমারির থেকেও ভয়াবহ! নাকি ২০২৪-এর তালিকা ভুল? তবে তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ঠিক বলেছেন। আসলে SIR-এর সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্ত হলে মানুষকে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না, সহজেই তারা সংশোধনী প্রক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। তাই ভয় দেখানোর রাজনীতি জরুরি। বিজেপির খেলাটা ধরে ফেলেছি আমরা। লিখছেন অধ্যাপক ড. প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

Must read

১৫ আগস্ট ২০১৯, লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জানালেন আধার (Aadhaar) এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে Last Man Delivery সম্ভব হয়েছে। তিনি নানান সময় বলেছেন আধার কার্ডের সঙ্গে ব্যাংকের লিংকের মাধ্যমে যেভাবে মানুষের কাছে সরাসরি সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে তা মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য অনন্য প্রয়াস। আগের সরকারের সময় তিনি প্রায় ৮ কোটির বেশি এমন সরকারি উপভোক্তা পেয়েছিলেন যারা আজ অবধি জন্মাননি! কাগজে অস্তিত্বসম্পন্ন হয়ে স্কলারশিপ থেকে শুরু করে গ্যাস ভর্তুকি কিংবা বিধবা ভাতা পেয়েছেন। এমনকী এদের মধ্যে অনেকে সরকারি চাকরিও করতেন। উনি ক্ষমতায় তিনি একা কুম্ভ হয়ে কাগজের অদৃশ্য মানুষদের চিহ্নিত করে আধার কার্ডের মাধ্যমে একদিকে সরকারি অর্থ বাঁচিয়েছেন, যার পরিমাণ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা, এবং অন্যদিকে প্রকৃত উপভোক্তাদের সরকারি সুবিধা পৌঁছে দিয়েছেন।

একই সময়ে এক বেসরকারি চ্যানেলের কমক্লেভে আধারের গুণগান করতে গিয়ে তিনি বলেন বিশ্বের এমন কোনও রাষ্ট্র নেতা নেই যারা আধার (Aadhaar) কার্ড ব্যবস্থা সম্পর্কে অবাক হয়ে উনিজিকে জিজ্ঞেস করেননি যে তিনি কীভাবে এমন অসাধ্য সাধন করলেন; যেখানে প্রত্যেক ভারতের তথ্য তাঁর হাতে রয়েছে। গর্বিত রক্ষাকর্তার মতো উনিজির এহেন কথা আজও তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৬ সালে আধার আইন নিয়ে আসার পর থেকে উনিজির সদর্প ঘোষণা— আধার ব্যবস্থা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ যার মাধ্যমে ‘‘উপভোক্তারা” সরাসরি সরকারি সুবিধা পাবেন। এখানে উপভোক্তা শব্দটির গুরুত্ব অনুধাবন জরুরি। মাথায় রাখতে হবে যে কোনও সরকারি এহেন কল্যাণকামী সুবিধা শুধু ভারতীয়দের জন্যই বরাদ্দ, বিদেশিদের জন্য নয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অধিকারগুলি ভারতীয়দের জন্য ভারত সরকার সরবরাহ করে থাকে।
তাহলে প্রশ্ন, যে সরকারের প্রধান বারংবার আধারের এত গুণগান করলেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নানান সংস্থাকে যুক্ত করে মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে, ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করে সকল দেশবাসীর চোখের হাতের ছাপ নিয়ে সুসংহত আধার ব্যবস্থা করলেন; সেই তিনি কেন ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের জন্য চিহ্নিত ১১টি নথির থেকে আধারকে বাদ করলেন? সাংবিধানিক সংস্থার রক্ষাকর্তা দেশের প্রধান কেন নির্বাচন কমিশনকে SIR-এর জন্য আধার সংযুক্তির নির্দেশ দিলেন না? বরং বারবার বলা হল আধার নাগরিকতার প্রমাণ নয় এবং তাকে নকল করা সহজ! আরও প্রশ্ন হল, যে আধারের নামে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি গোরিলার মতন বুক বাজিয়ে হুংকার দিয়ে ভারতীয়দের পরিষেবা পৌঁছে দিতে বিরোধীদের এক হাত নিয়েছিলেন, তা ভুল ছিল? ব্যবস্থার মধ্যে কি আজও কোটি কোটি ভুয়ো উপভোক্তা আছে?

আবার, আধার (Aadhaar) যদি নাগরিকতার প্রমাণ না হয় তাহলে যে ১১টি কাগজের কথা বলা হয়েছে তার সব ক’টি নাগরিকতার প্রমাণ তো? এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের শংসাপত্রও সেখানে রয়েছে! আধার যদি নকল করা যায় তবে বাকি ১১টি নথি নকল করা যাবে না এই গ্যারান্টি স্বয়ং উনিজিও দিতে পারবেন না! এমন অনেক বিতর্কের মধ্যেই আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই শুরু হয়। যাকে যোগ্য সহযোগিতা করেন আমাদের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরো ভারত জুড়ে বিরোধী দলগুলি INDIA-র মঞ্চে নেত্রীর চিন্তায় ঐক্যবদ্ধ হয়। বিষয়টি আদালতে গড়ায় এবং শেষমেশ মানুষের দাবি জয়ী হয়। SIR-এর প্রয়োজনীয় ১১টি নথির সঙ্গে ১২ নম্বর নথি হিসেবে আধারকে যুক্ত করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

তবে একথা মনে রাখতে হবে দিদি SIR-এ এপিক কার্ডকেও যুক্ত করতে বলেছেন এবং একই সঙ্গে তার সোজাসাপটা বক্তব্য তিনি এহেনও ত্রুটিযুক্ত SIR প্রক্রিয়া মানেন না। কোনও বৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়লে প্রতিবাদের আঁচ দিল্লি পৌঁছাবে। আমাদের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তিপূর্ণ দাবি করেন, যদি ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে গৃহীত নির্বাচকদের তালিকায় ২০২৫-এর মাঝে এসে কোটি কোটি অবৈধ ভোটারের নাম পাওয়া যায় তবে বর্তমান সরকার তো অবৈধ! নরেন্দ্র মোদি সরকারের উচিত দ্রুত পদত্যাগ করে প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা চালু করে SIR-এর প্রক্রিয়া চালানো। কারণ ওই কোটি কোটি অবৈধ ভোটারের ভোটেই তো সাংসদগণ নির্বাচিত। প্রয়োজনে তিনি নিজেও পদত্যাগে রাজি। কিন্তু এই সৎ সাহস এবং গণতান্ত্রিক চেতনা মোদির দলের নেই!

কিন্তু প্রশ্ন হল, আধারে উনিজির সমস্যা কোথায়? তিনি তো আধার ব্যবস্থার অন্যতম রক্ষাকর্তা ও প্রচারক! আসলে SIR-এ আধার যুক্ত হলে তাদের বিভাজনের রাজনীতি থমকে যাবে। বিজেপি ‘সাফাই কর্মসূচি’র নামে যেভাবে মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, তা টিকবে না। নয়তো ভাবুন বিহারে মাত্র দেড় বছরে অর্থাৎ ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে গৃহীত নির্বাচকদের তালিকা প্রকাশ থেকে ২০২৫-এর SIR প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মধ্যে ২২ লক্ষ লোক মৃত! তার মানে একটি রাজ্যে দেড় বছরে এত মৃত্যু! এ তো অতিমারির থেকেও ভয়াবহ! নাকি ২০২৪-এর তালিকা ভুল? তবে তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ঠিক বলেছেন। আসলে SIR- র সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্ত হলে মানুষকে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না, সহজেই তারা সংশোধনী প্রক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। তাই ভয় দেখানোর রাজনীতি জরুরি। এ যেন সুকুমার রায়ের সেই দৈত্যের মতো, যে মানুষকে বলে, ‘ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারবো না। … অভয় দিচ্ছি, শুনছো না যে। …সবাই মিলে কামড়ে দেবো মিথ্যে অমন ভয় পেলে।’ এখানে ‘সবাই’ শব্দটি বিজেপি-সহ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতীক বলাই যায়। তবে এখনও সংবিধান আছে, সংবিধানের রক্ষাকর্তা আদালত আছে এবং আছে মানুষের ভরসার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। SIR-এ আধার কার্ড গ্রহণ করার সুপ্রিম নির্দেশ সেই কথা আরও একবার মনে করিয়ে দিল।

আরও পড়ুন-এক বছর বাড়ল এলটিসির মেয়াদ, রাজ্যের সরকারি কর্মীদের জন্য বড় সিদ্ধান্ত নবান্নের

Latest article