‘রবিকাকা’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই অবনীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন লেখালেখি। চিত্রশিল্পী হিসাবে যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, সে–সময়ই রবীন্দ্র–নির্দেশ বা অনুরোধে লিখতে শুরু করলেও নিজের কিছুটা দ্বিধা ও সংশয় ছিলই। কিন্তু জহুরি রবীন্দ্রনাথ সঠিক ভাবেই চিনেছিলেন তাঁকে। আশ্চর্য ও অনবদ্য সাহিত্যকর্মে অবনীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন শিশুসাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট।
এই লেখক–অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘অবনীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’ গ্রন্থটি। অবনীন্দ্রনাথ বিষয়ক সাতটি প্রবন্ধ এবং অন্যান্য কয়েকজন শিশুসাহিত্যিক সম্পর্কীয় আলোচনা এখানে সঙ্কলিত হয়েছে।
আরও পড়ুন-লাল-গেরুয়া ভাই ভাই, স্ক্যামে ওরা জগাই-মাধাই
গ্রন্থটির মূল বিষয় অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর রচিত সাহিত্যের সার্বিক পরিচয় এখানে বিস্তারিত বর্ণিত। সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকজন লেখকের শিশুসাহিত্য সম্পর্কীয় মূল্যবান আলোচনা, যাঁদের কেউ কেউ এখন প্রায় বিস্মৃত।
অবনীন্দ্রনাথের রচনার সিংহভাগই ছোটদের জন্য। ছোটদের মনের গভীরে তাঁর শুধু নিত্য যাতায়াতই ছিল না, সবসময় জাগ্রত থাকত নিজের আশ্চর্য শিশুমনটিও। আমৃত্যু তিনি ছিলেন যেন স্বপ্ন দেখা এক ছোট্ট বালক। তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যের বেশির ভাগই ছিল দেশি–বিদেশি কোনও কাহিনি অবলম্বন বা অনুসরণ করে। কিন্তু তাঁর অনবদ্য কথন, বর্ণনাভঙ্গি, চিত্রময়তা প্রভৃতির নিজস্বতা ও নৈপুণ্যে সেগুলি মৌলিক রচনায় পরিণত হয়েছে।
পার্থজিৎ সুন্দর ও সঠিক ভাবেই অবনীন্দ্রনাথের রচনা–ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন: (১) প্রথমে রং–তুলিতে, পরে শব্দে শব্দে চলেছে ছবি আঁকা। অবনীন্দ্রনাথের গদ্যভাষার বড় গুণ চিত্রধর্মিতা। তাঁর ক্যানভাসের ছবি গদ্যভাষাতেও সঞ্চারিত। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তৈরি হয়েছে চিত্রমালা। অবনীন্দ্রনাথের গদ্যভাষা জীবনানন্দের কবিতার মতোই ‘চিত্ররূপময়’।
আরও পড়ুন-বইপাড়ার বনস্পতি
(২) অবনীন্দ্রনাথের গদ্যভাষা শুধু ছন্দবদ্ধ নয়, প্রভূত কাব্যময়, কবিতার কাছাকাছি। কখনও বা বিশুদ্ধ কবিতা। ভাষার দ্যুতি, ছন্দের টুংটাং, মজলিশি ভঙ্গি আর সুগভীর কাব্যময়তার আলোকিত গদ্য ও পদ্যের দূরত্ব–ব্যবধান ধুয়েমুছে যায়।
অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘বালক’, ‘ভূতপতরীর দেশ’, ‘শকুন্তলা’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘রাজকাহিনি’ প্রভৃতির পাশাপাশি ‘ঘরোয়া’, ‘আপনকথা’, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ প্রকৃতই অনবদ্য সৃষ্টি। ‘বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ তাঁর চিত্রচর্চার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প–মনীষার এক মহান পরিচয়। এখানে সঙ্কলিত রচনাগুলি শিল্পতত্ত্ব বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতামালা।
বাস্তবিকই গ্রন্থটিতে অবনীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। তাঁর প্রায় সমগ্র জীবন ও সাধনার একটি রূপরেখা পাঠক বিস্তারিত পেয়ে যান এখানে। পার্থজিৎ লেখক অবনীন্দ্রনাথকেই মূলত বিস্তারিত বিশ্লেষণে এখানে আলোকিত করতে চেয়েছেন। চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ এখানে তাই প্রায় অনুপস্থিত। শিশু সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এ গ্রন্থে পাঠকের অতিরিক্ত প্রাপ্তি তাঁর জীবনের শেষ দশটি বছর নিয়ে একটি স্বতন্ত্র এবং হৃদয়স্পর্শী রচনা।
আরও পড়ুন-কাবুলে বিস্ফোরণ
‘অবনীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’ শীর্ষক এই গ্রন্থটিতে অবনীন্দ্র বিষয়ক সাতটি প্রবন্ধের পরে এসেছেন প্রমদাচরণ সেন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, বুদ্ধদেব বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। রয়েছে এই ‘অন্যান্য’দের শিশুসাহিত্যে অবদানের মূল্যায়ন। অনেক অজানা ও বিস্মৃতপ্রায় তথ্যে এঁদের নিয়ে রচিত প্রতিটি রচনাই মূল্যবান হয়ে উঠেছে। শিশুসাহিত্য বিষয়ক গবেষকদের জন্য এগুলিতে অনেক মণিমুক্তা ছড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন-বাংলার উন্নয়ন রুখে দিতে চাইছেন বিরোধী দলনেতা
গ্রন্থটির সর্বশেষ প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে বার্ষিকী প্রকাশের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে। বাংলা সাহিত্যে উৎসবের সময় বার্ষিকী প্রকাশের সূচনা–সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত এখানে সযত্নে আলোচিত। উল্লেখ্য, রবীন্দ্র–জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বাংলাভাষায় প্রথম ‘বার্ষিকী’ গ্রন্থ ‘পার্বণী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে।
শিশুসাহিত্য আলোচনার অঙ্গনে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই গ্রন্থটি অবশ্যই একটি মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় সংযোজন।