সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
মহানায়ক উত্তমকুমার রীতিমতো সমীহ করতেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তিনি কোন মাপের অভিনেত্রী ছিলেন। সেই অর্থে চেহারায় গ্ল্যামার ছিল না। চাপা রং, আটপৌরে রূপ। যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। শুধুমাত্র অভিনয়ের গুণে তিনি পাকা জায়গা করে নিয়েছিলেন দর্শকদের মনে। সিরিয়াস, কমেডি যে-কোনও চরিত্রেই তিনি অপ্রতিরোধ্য। পর্দায় পাঁচ জনের ভিড়ে খুব সহজেই কেড়ে নিতে পারতেন দর্শকদের নজর। তাঁর অভিনীত নিশিপদ্ম, দুই ভাই, শেষ অঙ্ক, মরুতীর্থ হিংলাজ, মৌচাক, ধন্যিমেয়ে— আজও দর্শকদের পছন্দের তালিকায়। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, বঙ্গবিভূষণ-সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান। সিনেমা, থিয়েটারের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন টেলিভিশনে। বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজও তিনি করে চলেছেন কাজ।
আরও পড়ুন-নিবেদিতার কালীচর্চা
স্মিতা পাতিল
অকালে ঝরে গেছেন স্মিতা পাতিল। ছিলেন অসাধারণ অভিনেত্রী। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ছবি। কিছু বাণিজ্যিক মশালা ছবিতে তাঁকে দেখা গেলেও, তিনি অভিনয় করতেন মূলত অন্যধারার ছবিতে। আর্থ, শক্তি, চক্র, নমকহালাল, অর্ধ সত্য ইত্যাদি ছবিতে স্মিতার অভিনয় দেখে বারবার মনে হয়েছে, চরিত্রগুলো শুধুমাত্র তাঁর জন্যেই বোনা হয়েছে। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। কাজ করেছেন মঞ্চেও। স্মিতা ছিলেন শ্যামাসুন্দরী। তাঁর কালো হরিণ দুই চোখে লেগে থাকত মায়া। নিজের গায়ের রং নিয়ে ছিল না কোনও হীনমন্যতা। অভিনয় দক্ষতায় তিনি পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন সাদা চামড়ার বহু অভিনেত্রীকে। সৌন্দর্যের কপিরাইট শুধুমাত্র ফর্সাদের— এই বদ্ধমূল ধারণাকে তিনি রীতিমতো ভুল প্রমাণ করেছিলেন। ‘কালো জগতের আলো’ কথাটি যে কতবড় সত্য, সেটা পর্দায় তাঁকে দেখলেই বোঝা যায়। অভিনয় দিয়ে তিনি নিজের চারপাশে তৈরি করতে পেরেছিলেন আশ্চর্য আলোকবলয়। যে-ক্ষমতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
রেখা
আটের দশকে বলিউডের রানি ছিলেন রেখা। উমরাওজান, সিলসিলা, মুকদ্দর কা সিকান্দার— ইত্যাদি ছবির সৌজন্যে এই এভারগ্রিন নায়িকা জিতে নিয়েছিলেন আসমুদ্রহিমাচলের মন। তবে খুব সহজে আসেনি সাফল্য। জন্ম থেকেই তাঁর গায়ের রং ছিল কালো। যখন তিনি অভিনয় জগতে প্রথম পা রাখেন, তখন অনেকেই তাঁকে ‘কালী’ বলে ডাকতেন। সেই সম্বোধন যে প্রশংসাসূচক ছিল না, সেটা সহজেই অনুমেয়। তবে কিছু মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে দমে যাননি রেখা। কাজ করে গেছেন মন দিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে। একটা সময় যাঁরা তাঁকে ফেলে দিয়েছিলেন বাতিলের তালিকায়, পরবর্তী সময়ে তাঁরাই তাঁকে কাজের প্রস্তাব দিয়েছেন। এইভাবে ধীরে ধীরে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। যে-সমস্ত ফর্সা নায়িকারা সেইসময় রেখার গায়ের রং নিয়ে অপমানজনক কথা বলতেন, আজ তাঁরা কালের অতলে তলিয়ে গেছেন। অথচ রেখা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। খবরের শিরোনামে। জাতীয় পুরস্কার-সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এ-সবকিছুই সম্ভব হয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতার গুণে।
শ্রীদেবী
দক্ষিণ ভারত থেকে শ্রীদেবী প্রথম যখন বলিউডে এসেছিলেন, তখন তাঁর গায়ের রং ছিল ময়লা। কুচকুচে কালো না হলেও যথেষ্ট চাপা। অনেক প্রযোজক, পরিচালক তাঁকে বলেছিলেন, এমন গায়ের রং নিয়ে নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন না দেখাই ভাল। তবে তাঁদের কথায় দমে যাননি মিষ্টি মুখের শ্রী। লড়াই চালিয়ে গেছেন। কঠিন লড়াই। ততক্ষণ, যতক্ষণ না সাফল্য ধরা দেয়। অভিনয় এবং নৃত্যের মাধ্যমে তিনি অল্প দিনের মধ্যেই জিতে নিয়েছিলেন দর্শকদের মন। উপহার দিয়েছেন চাঁদনী, সদমার মতো জনপ্রিয় ছবি। এই ছবিগুলোয় তাঁর অভিনয় দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। কয়েক বছর আগে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন।
কাজল
প্রথম ছবি বেখুদি। তবে কাজল দর্শকদের নজরে আসেন বাজিগর ছবির মাধ্যমে। তথাকথিত সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, কাজল তা ছিলেন না। তাঁর শরীরের রংয়ে যেন মিশে ছিল কাজলকালো মেঘ। তাতে কী? নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি দর্শকদের বাধ্য করেছিলেন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ গুণটি যুক্ত হয়েছে তাঁর অভিনয় ক্ষমতার সঙ্গে। সবমিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন আশ্চর্য সুন্দরী। তাঁকে নিয়ে আলোচনায় তাঁর শরীরের রঙের প্রসঙ্গ কবেই যেন উধাও হয়ে গেছে। ঔজ্জ্বল্য এসেছে তাঁর চেহারায়। সাম্প্রতিক কিছু ছবি দেখলেই বোঝা যায়। অনেকেই বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। কাজল অবশ্য সেই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে মেক আপকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন। নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আটকে থাকেনি তাঁর অভিনয়। বারবার নিজেকে ভেঙেছেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিরতি নিয়েছেন। ফিরে এসেছেন স্বমহিমায়। পর্দায় তিনি হয়ে উঠেছেন এক ঝলমলে আলো।
বিপাশা বসু
বঙ্গতনয়া বিপাশা বসু। মডেলিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এই সুন্দরী। তারপর গিয়েছিলেন বলিউডে। রাজ, আজনবি, ফুটপাথ, নো এন্ট্রি তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি। হিন্দির পাশাপাশি অভিনয় করেছেন বাংলা, ইংরেজি, তামিল, তেলুগু ছবিতে। শুরু থেকেই তিনি আছেন দর্শকদের সুনজরে। তাঁর গায়ের রং কালো। তবে সেটা নিয়ে তাঁর কোনওদিনই আক্ষেপ ছিল না। অভিনয়, নাচ, বডি ফিটনেস ইত্যাদি দিয়ে তিনি নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। একটা সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়েছিলেন সমসাময়িক নায়িকাদের। হয়েছিলেন অনেকের ঈর্ষার কারণ। তাঁর গায়ের রঙের জন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘কালি বিল্লি’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। তবে এতে বিন্দুমাত্র দমে যাননি বিপস। সাফল্যকে পাখির চোখ করে এগিয়ে গেছেন। তিনি যে নিজের লক্ষ্যপূরণ করেছেন, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলিউডের প্রথম সারির নায়ক, পরিচালক, প্রযোজকদের সঙ্গে তিনি করেছেন কাজ। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তাঁর সাফল্যের ধারা আজও অব্যাহত।
নন্দিতা দাস
চাপা গায়ের রং জীবনের চলার পথে কোনোরকম বাধা হতে পারে না, প্রমাণ করেছেন নন্দিতা দাস। বলিউডের এই শ্যামাসুন্দরী অন্য ভাষার ছবিতেও অভিনয় করেছেন। অসামান্য অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি দর্শকদের মন জিতে নিয়েছিলেন। বিনোদন জগতে যখন তিনি নতুন, তখন গায়ের রঙের জন্য তাঁকে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। তবে নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলেন নন্দিতা। কালোর মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সৌন্দর্য, তিনি সেটার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। নিজেকে মেলে ধরেছিলেন ফায়ার, আর্থ, কামলি, বিফোর দ্য রেনস ইত্যাদি ছবির মাধ্যমে। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনা করেছেন। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মতো আন্তর্জাতিক আসরে তিনি পালন করেছেন জুরির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অসাধারণ এই ব্যক্তিত্বময়ীকে আজ বিনোদন জগতের প্রত্যেকেই সম্ভ্রমের চোখে দেখেন।
লারা দত্ত
বিউটি কনটেস্টে ফর্সা মেয়েদের একাধিপত্যকে মনে মনে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন লারা দত্ত। ভারতের এই কালো মেয়ে ২০০০ সালে জিতে নিয়েছিলেন মিস ইউনিভার্স খেতাব। মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিয়েছিলেন সৌন্দর্যের সমীকরণ। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মডেলিংয়ের দুনিয়ায়। বলিউডের ডাক পেতে বেশিদিন সময় লাগেনি। চাবুকের মতো শরীর, দুর্দান্ত নাচেন, মন্দ করেন না অভিনয়, সবমিলিয়ে প্রথম থেকেই পেয়েছেন দর্শকদের প্রশংসা। আন্দাজ, পার্টনার, বিল্লু, ডন টু, হাউসফুল ইত্যাদি ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। অভিনয়ের জন্যে কিছু পুরস্কার উঠেছে তাঁর হাতে। সিনেমার পাশাপাশি তিনি অভিনয় করছেন ওয়েব সিরিজে। এই ক্ষেত্রেও সাফল্য তাঁর হাত ধরেছে। আশা করা যায়, আগামী দিনে তাঁকে দেখা যাবে নতুন নতুন ভূমিকায়।
কঙ্কনা সেন শর্মা
বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ভাষার ছবিতে অভিনয় করেছেন কঙ্কনা সেন শর্মা। তাঁর অভিনয়ে দেখা যায় মেধার ঝলকানি। ছবি নির্বাচনের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। তাই তাঁর ছবির সংখ্যা খুব কম। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য তিতলি, লাইফ ইন এ মেট্রো, ওমকারা, পেজ থ্রি। কঙ্কনার গায়ের রং অনেকের তুলনায় চাপা। তবে সেটাকে মাইনাস পয়েন্ট বলে কখনও মনে করেননি। তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন। তুলে ধরেছেন অনন্যসাধারণ উচ্চতায়। যেখানে তাঁর নাগাল পাওয়া কঠিন। অনেকেই যা ছুঁতে পারেননি, তিনি অবলীলায় সেইসব জয় করে নিয়েছেন। দুবার পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। যে পুরস্কার বহু সমসাময়িক সুন্দরীর কাছে আজও অধরা। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনা করেছেন। সেখানেও তিনি সফল।
পাওলি দাম
বঙ্গতনয়া পাওলি দাম। বাংলার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন হিন্দি ছবিতেও। কালোর মধ্যেও অপূর্ব আলো আছে, সেটা তাঁর রূপ দেখলেই বোঝা যায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতায়। রসায়নে স্নাতোকোত্তর। অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা কম বয়স থেকেই। কালবেলা ছবিটি তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। অভিনয় করেছেন মনের মানুষ, জুলফিকার, সাঁঝবাতি প্রভৃতি ছবিতে। জড়িয়েছেন বিতর্কে। তবে কোনও কিছুকেই পাত্তা দেননি এই শ্যামাসুন্দরী। আপনমনে করে গেছেন নিজের কাজ। সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে পেয়েছেন সাফল্য।
এষা গুপ্তা
বলিউডের নতুন প্রজন্মের নামী অভিনেত্রী এষা গুপ্তা। গায়ের রং কালো হওয়া সত্ত্বেও ২০০৭ সালে তিনি জিতেছিলেন মিস ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল খেতাব। পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন বহু সাদা চামড়ার মেয়েদের। তারপর মডেলিং। সেখান থেকে অভিনয় জগতে। জন্নত টু, টোটাল ধামাল, রুস্তম তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি। গায়ের রং চাপা হওয়ার কারণে কাজের জগতে তাঁকে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। তবে তিনি কোনও কিছুকেই গুরুত্ব দেননি। চুপচাপ করে গেছেন নিজের কাজ। সেই কারণে চুমুক দিয়েছেন সাফল্যের কাপে।
আরও পড়ুন-কাটাকুটির ক্যাকটাস
ফ্রিডা পিন্টো
ভারতের এই মেয়ে আজ আন্তর্জাতিক তারকা। ফ্রিডা পিন্টো অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি হলিউডের ছবিতে। তাঁর অভিনীত ‘স্ল্যামডগ মিলিওনিয়ার’ পেয়েছে একাধিক অস্কার। এই ছবিই তাঁকে সারা পৃথিবীর দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিল। ফ্রিডা সেই অর্থে সুন্দরী নন। গায়ের রং কালো। তবু তিনি নিজের যোগ্যতায় সাফল্যকে করেছেন তালুবন্দি। বয়স কম। আগামী দিনে এই শ্যামাসুন্দরী আরও সফল হবেন, এই আশা প্রত্যেক দেশবাসীর।