মণিকোঠায় দিয়ে চাবি,
মনের সুখে নিদ্রা যাবি
রবেনা ছয় ডাকাতে
ভয় ভাবনা
সুখে রবি মনকানা
এমন অপূর্ব ভাবনা, এমন সুমিষ্ট শব্দচয়ন বাউল সংগীত ছাড়া আর কীসেই বা মিলবে। মনের মণিকোঠায় দিয়ে চাবি, ছয় ডাকাত রূপী আমাদের ষড়রিপুকে জয় করে দেহ এবং মনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়েই সুখলাভ অর্থাৎ খুব সহজ করে বললে লোভ, কাম ক্রোধ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ছ’টি রিপু ত্যাগেই প্রকৃত শান্তি এ যেন চিরন্তন বার্তা বাউল সংগীতে উঠে আসে।
আরও পড়ুন-সৌন্দর্যতৃষ্ণা মেটাতে গঙ্গাবক্ষে বিলাসভ্রমণ
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বের মাধ্যমেই বাউল গান সমৃদ্ধ হয়। বাউল শব্দটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে নানামত। কারও মতে, বাউল শব্দটি সংস্কৃত ব্যাকুল বা বাতুল থেকে এসছে আবার কেউ মনে করে আরবির আউল থেকে বা হিন্দির বাউল শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সহজ ভাষায় ঈশ্বর প্রেমে পাগল বা ঈশ্বরের একান্ত সেবক। বাউল সাধকরা অবশ্য অন্য কথা বলেন। বাউল ধর্ম বা বাউল জীবনাচরণে কোনও জাতিভেদ নেই। এ যেন এক সর্বধর্ম সমন্বয়ের সংস্কৃতি। ষোড়শ শতকে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে প্রথম বাউল শব্দটি পাওয়া যায়। শোনা যায় শান্তিপুরের নরোত্তম দাস শ্রী চৈতন্যদেবকে বাউল বলে আখ্যা দেন। চৈতন্যদেব নিজেও নিজেকে বাউল বলেছেন। মোদ্দা কথা, বাউলরাই পারেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসতে। বাউলগান দেহতত্ত্বের গান হলেও এ যেন ঈশ্বরের সঙ্গে মহামিলনের গীত। বাউল সংগীতের গূঢ় আধ্যাত্মিক জীবন দর্শনের, নিঃশর্ত প্রেমের কথাই বলে। এই গানের মধ্যে পাশাপাশি রয়েছে দেহসাধনা এবং মন সাধনা দুই-ই।
বাউল সংগীতের এই গূঢ় বিষয় অনুধাবন করে তা ভাবের মাধ্যমে প্রকাশ করা খুব কঠিন যদিও বাউল শিল্পীরা খুব সহজেই তা করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বালিকা বা কমবয়সি মেয়েদের খুব একটা বাউল গাইতে শোনা যায় না। মহিলা বাউল শিল্পী থাকলেও পুরুষের তুলনায় অনেক কম এবং তাঁরা প্রায় সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক। সেই কারণেই বাউল গানে ব্যতিক্রমী শিল্পী হল পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার শ্যামবাটি গ্রামের মেয়ে বর্ষা গড়াই। বর্ষার বয়স এখন এগারো বছর। আর তার বাউল সংগীত শিক্ষার শুরু সেই চার বছর বয়সে। এত ছোট বয়সে এরকম একটা কঠিন সংগীত ঘরানাকে রপ্ত করা সহজ নয় কিন্তু সেই গভীর, গূঢ় সাধন সংগীতকে অনায়াসে আত্মস্থ করেছে বর্ষা। বর্ষার বাবা গৌরচন্দ্র গড়াই-এর দুটি সন্তান— ছেলে ইমন এবং মেয়ে বর্ষা। তাঁর একটি বাউল গানের দল ছিল যা আজ প্রায় বারো বছর ধরেই রয়েছে। তিনি একটা সময় ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ভালবাসা থেকেই পেশা ছেড়ে পুরোপুরি বাউল গানের জগতে চলে আসা। বর্ষার মা কৃষ্ণা গড়াই ছিলেন এর অন্যতম কারণ। তাঁর বাউল গানের প্রতি আকর্ষণ, ভালবাসা ছিল অপরিসীম। স্বপ্ন ছিল মেয়েকে বাউল শিল্পী করে তুলবেন। মাত্র আড়াই বছর বয়সে বর্ষাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেন তাঁর মা। তখনও ভাল করে কথা বলতে শেখেনি সে। ওই সময় বর্ষার নিজের গলায় গাওয়া প্রথম গান ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়’। বাবা গৌরচন্দ্র গড়াই এবং মা তাঁদের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে মেয়েকে তালিম দিতে শুরু করেন। বোলপুরের বিখ্যাত বাউল শিল্পী বাসুদেব দাস, যাঁর কাছেই মূলত বর্ষার বাউল গানের প্রশিক্ষণ। তখন তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে আসা আর কোনও শিক্ষার্থী বর্ষার মতো বয়সি ছিল না । শুরুর দিকে এই বাসুদেব দাস, গৌরচন্দ্র গড়াই, কৃষ্ণা গড়াই এবং ছোট্ট বর্ষা একত্রে বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে যেত। তখন থেকেই ছোট্ট বর্ষা পরিচিত হয়ে যায় বাউল গানের জগতে। যদিও মেয়ের বড় হওয়া নামডাক মা দেখে যেতে পারেননি। ২০১২ সালে কৃষ্ণা গড়াই মারা যান। ছন্দপতন ঘটলেও তার বাবা থেমে থাকেননি। এখন বর্ষা বাসুদেব দাসের কাছেই প্রশিক্ষণরত। বাবা গৌরচন্দ্র গড়াই বাউল সংগীত চর্চার পাশাপাশি ঢোলক, তবলা, মন্দিরা বাজান। বাবার সাহচর্য এবং বাসুদেব দাসের তালিমে এগারো বছরেই পেশাদার শিল্পীর মতো তাঁর গলার ধরন। এর পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল বা রাগাশ্রয়ী সংগীতের তালিম নিচ্ছে বর্ষা। ইমন, ভৈরবী, কলাবতী, ভূপালি রাগ শিখছে সে। গিটার, ইকুলেল, দোতারা, ডুগডুগি, খোল, একতারা সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সমান পটু বর্ষা। কোনও তালিম সে নেয়নি এর জন্য শুধু বাবাকে দেখে আর শুনে শুনে বাদ্যযন্ত্র বাজানো রপ্ত করেছে। নিয়মিত ভোরবেলা উঠে সংগীতের সাধনা করে বর্ষা। পাশাপাশি পড়াশুনা চলে তাঁর। বোলপুর গার্লস-এর ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। পড়াশুনাতেও বেশ দক্ষ বর্ষা। পড়াশুনা, গান, আঁকা নিয়ে সময় কেটে যায় তাঁর। ছবি আঁকতে ভীষণ ভালবাসে বর্ষা। আলাদা করে ইংরেজি, জাপানি, হিন্দি ভাষারও প্রশিক্ষণ নেয়। করোনাকালের আগে দিল্লি, মুম্বই, ত্রিপুরা, অসমে গিয়েছে অনুষ্ঠান করতে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে বর্ষা। বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে, পশ্চিমবঙ্গ কলাকেন্দ্র, রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে ও আরও নানা সংস্থা থেকে পেয়েছে শংসাপত্র। বাবা গৌরচন্দ্র গড়াইয়ের মতে, ‘‘এখনও কিছুই শেখেনি বর্ষা। বাউল সংগীতের শেখার কোনও শেষ নেই। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত শিখে যেতে হবে। এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি।” হিন্দি ভজন গায় সে। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী অরিজিৎ সিং তার গানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ডিডি বাংলাতে অনুষ্ঠান করেছে বর্ষা। সম্প্রতি আরও কয়েকটি চ্যানেলেও সে সংগীত পরিবেশন করবে। এছাড়া রাঙামাটি বাউল স্টুডিও সাইটে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে বর্ষার গান। ছেলে এবং মেয়েকে বড় করতে বাবা গৌরচন্দ্র গড়াই তাঁর জীবনকে নিয়োজিত করেছেন। মেয়ে পড়াশুনা এবং গান দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে যায়, এটাই তাঁর ইচ্ছে। ছোট বয়সে বর্ষা গড়াই বৃহতের সন্ধানে ধাবমান এক জোতিষ্ক।
আরও পড়ুন-দেশের সেরা বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়