ছোটবেলায় দিদাকে দেখতাম দুপুরে ভাত খেয়ে ওঠার পরে পানের বাটা নিয়ে বসতেন, তারপর পানের মধ্যে চুন, সুপুরি দিয়ে সুন্দর করে পানের খিলি বানাতেন। বাড়ির বড়রা তো সেই সাজা পান (Betel Leaf) পেতেনই, আমরা ছোটরা ও মায়েদের চোখ এড়িয়ে সেই পান খেতাম। সেই বয়সে পান খাওয়ার অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়। আর হবে না-ই বা কেন! আসলে বাঙালিরা মনে করেন ব্রহ্মা তুষ্ট সুপুরিতে, বিষ্ণু তুষ্ট পানে, আর মহাদেব তুষ্ট চুনে। আর পানের খিলিতেই বাস করেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেব।
পান শব্দটির সঙ্গে বাঙালির জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাঙালিদের সমস্ত রকমের আচার অনুষ্ঠান অর্থাৎ পুজো-পার্বণ থেকে শুরু করে শান্তি স্বস্ত্যয়ন— সবকিছুতেই পান অপরিহার্য, পান (Betel Leaf) ছাড়া সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ। আগেকার দিনে বাড়িতে অতিথি এলে খাওয়াদাওয়ার পরে তাঁকে পান সাজিয়ে দেওয়ার একটা রীতি ছিল।
কবে থেকে আমরা পান মুখশুদ্ধি হিসাবে ব্যবহার করছি সেটা বলা খুবই কঠিন। পানের গতিবিধি যেমন জাতকের গল্পে আমরা দেখতে পাই ঠিক তেমনি বাৎসায়নের কামসূত্র থেকে চরক-সুশ্রুত-কাশ্যপের আয়ুর্বেদশাস্ত্রতেও পানের ব্যবহারিক উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ পান (Betel Leaf) খেতেন। আবার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে সম্রাজ্ঞী নুরজাহান পান খেতে খুব ভালবাসতেন, তিনি মুঘলদের অন্দরমহলে অন্যান্য নারীদের কাছে পান খাওয়াটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখাতেও সেই সময় যে পানের ব্যবহার ছিল তার কথা জানতে পারা যায়। ভারতবর্ষে আসা প্রায় সমস্ত পর্যটকেদের রচনা থেকেই অনেক উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতে এসে মার্কোপোলোর ধারণা হয়েছিল যে এখানকার মানুষদের মজবুত দাঁত আর খোলতাই চেহারার পিছনে পান খাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। পনেরো শতকে আব্দুর রাজ্জাক বিজয়নগর যান এবং সেখানে তাঁর হাতে পান তুলে দেন সেখানকার রাজা। পান (Betel Leaf) খাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছিল যে পান খুবই বলবর্ধক। পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা পানের অনেক গুণগান করেছিলেন। আবার ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চির পান খেয়ে ঠোঁট রাঙানো দেখে মনে হয়েছিল এখানকার লোকদের কোনও অসুখ হয়েছে।
মধ্যযুগের কবি আলাওলের কবিতা থেকেও পানের কথা জানতে পারা যায় এবং ইউসুফ জুলেখা কাব্যতেও রুপোর পানের বাটার কথা উল্লেখ করা আছে। মনসামঙ্গল কাব্যে জানা যায় চাঁদসওদাগরের স্ত্রীর সনকা পানের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ মেশাতেন, আর যেটা খেয়ে তাঁর ঠোঁট হত রঙিন। প্রাচীনকালে রাজপরিবারের পান ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। আর রাজসভায় পান পরিবেশন করার জন্য বিশেষ শ্রেণির দাস নিযুক্ত করা হত। এঁদের তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী বলে অভিহিত করা হত। এই তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীর উল্লেখ বাণভট্টের কাদম্বরীতে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে, পান ইন্দো-আরিয়ান নয়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক। এর আদি ঠিকানা ফিলিপিন্স, সেবিস কিংবা জাভা বোর্নি। ঐতিহাসিকদের মত যা-ই হোক না কেন, ভারতীয় তথা বাঙালিদের ধারণা পান তাদের একান্ত নিজস্ব।
- আরও পড়ুন: হিমালয়ের কোলে এক টুকরো মায়াবী পৃথিবী চটকপুর
ষোড়শ শতাব্দীর একটি রান্নার বইয়ে মাণ্ডুর সুলতান গিয়াসউদ্দিন খলজি পান কীভাবে খাওয়া হবে তার বর্ণনা করেছেন। এই বইয়ে লেখা আছে প্রথমে পানপাতার ওপর গোলাপ জল ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর এতে জাফরান, সুগন্ধযুক্ত মশলা এবং গোলাপজলে ভিজিয়ে রাখা কাটাসুপারি দিতে যুক্ত করতে হবে।
ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই পান (Betel Leaf) উৎপাদন হয়। পানকে ভারতীয়রা শুভ বলেই গণ্য করে থাকে। দক্ষিণ ভারতে কোনও শুভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের পানপাতা সুপারি এবং নারকেল দেওয়া একটি ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে। এ-ছাড়াও বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথিদেরও পান-সুপারি ও নারকেল দেওয়া হয়। এটিকে তাম্বলাম বলা হয়ে থাকে। অসমে বিয়ের অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করার সময় অতিথিদের পান-সুপারি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভারতবর্ষ ছাড়াও ফিলিপাইন, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশেও পান তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ঐতিহ্য বহন করে।
পান চিবানোর পর সেটা লাল হয়ে যায়। চুন-সুপুরি মিশ্রিত পানের পিকের রং তামাটে। সংস্কৃতে তামাটেকে তাম্র বলে, আর মনে করা হয় এই রঙের দিকে খেয়াল রেখেই সংস্কৃতে তাম্র থেকে তাম্বুল শব্দটি এসেছে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পানের নানান ধরনের গুণ উল্লেখ আছে। সংস্কৃত সাহিত্যে বলা হয়েছে মুখ বিশুদ্ধ করতে এবং মুখের দুর্গন্ধ তাড়াতে পান অপরিহার্য। এ-ছাড়াও আগেকার দিনে পানকে ওষ্ঠরঞ্জনি হিসেবে ব্যবহার করা হত, কারণ পান খাওয়ার পর ঠোঁট লাল হয়ে যেত। আর সেই কারণেই সেই সময় হিন্দু বিধবাদের পান খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এ-ছাড়াও পান যেহেতু আনন্দের প্রতীক সেই কারণেও হিন্দু বিধবারা পান খাওয়ার অনুমতি পেতেন না।
পান শব্দটি সংস্কৃত শব্দ পর্ণ থেকে এসেছে। তবে এর অস্ট্রিক নাম ছিল ‘বর’। বাংলা ভাষায় ‘বর’ শব্দটি পানের জায়গা নিতে না পারলেও বারুই বা বারুজীবী শব্দে এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
কৃষ্ণের শতনামএর মতন পানও বহু নামে প্রচলিত। তামিলে পানকে ডাকা হয় ‘ভেট্টিলাই’ বলে, সেরকম তেলুগুতে বলা হয় ‘তমলপাক’, বার্মিজে ‘কুন আ’, মারাঠিতে ‘বিদয়েচি’, মালায়ালামে ‘বেত্তিনাই’, গুজরাটিতে ‘নাগরবেল’, সংস্কৃতে ‘তাম্বুল’, কানাড়িতে ‘বিলেদেলে’, আরবিতে ‘তানবোল’, ফরাসিতে ‘তাবোল’ প্রভৃতি।
হিন্দুশাস্ত্র মতে পানকে তাম্বুল তখনই বলা হয় যখন তার মধ্যে চুন-সুপারি ও খয়ের দেওয়া হয়।
পানের জন্মভূমি হচ্ছে জাভা। পান যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রটিকে বাটা বলে। তবে রাজস্থান, বেনারস, লখনউ, উত্তরপ্রদেশে পান রাখার পাত্রকে বলা হয় কৌটো। এই বাটা বা কৌটোতে পান ছাড়াও নানা ধরনের সুগন্ধী ও মশলা রাখা হয়। পানের সঙ্গে সেই মশলা মিশিয়ে খাওয়ার চল এইসব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। তবে বাংলা বা আসামে পানের বাটার মধ্যে মশলা রাখার চল নেই। এখানে পিতল বা রুপোর বাটা ব্যবহৃত হয়। সেই বাটাতে নানা ধরনের নকশাকাটা থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের বাংলার ঠাকুরমা-দিদিমারা পানের বাটায় বিপ্লবীদের নাম লিখে রাখতেন। আগেকার দিনে পান মাউথ ফ্রেশনারের কাজ করত।
পান নিয়ে পুরাণে অনেক গল্পকথার উল্লেখ পাওয়া যায়।
পুরাণকালে ব্রাহ্মণ এবং অতিথিদের বিদায় করার সময় অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পান দেওয়ারও রীতি ছিল। তাই অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে সারা দুনিয়া পানের খোঁজে তোলপাড় করে ফেলেন। কিন্তু কোথাও তাঁরা পানের খোঁজ পান না। পান খুঁজতে খুঁজতে একসময় একদল পাতালপুরীতে পৌঁছে যান। সেখানে ছিল নাগরানীর বাস। সেই নাগকুলের সঙ্গে পাণ্ডবদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আর সেই কারণেই নাগ রানি তাঁর নিজের কনিষ্ঠ আঙুলটি কেটে নিয়ে সেই পান খুঁজতে আসা দলের হাতে দেন। এবং সেই আঙুলটি মাটিতে পুঁতে দিতে বলেন। সেই আঙুল মাটিতে পোঁতার পর সেখান থেকে জন্ম নেয় পানের বল্লরী। ফুল-ফল বিহীন সবুজ কচিপাতা সমৃদ্ধ সেই বল্লরী। আর মনে করা হয় এই কারণের জন্যই সংস্কৃত ভাষায় পানকে নাগবল্লরী বলা হয়ে থাকে।
এ-ছাড়াও আরও একটি পৌরাণিক আখ্যান আছে, সেখানে বলা হয়েছে যখন সমুদ্রমন্থনের সময় বিষের ভাণ্ডার উঠেছিল তখন দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। কণ্ঠে বিষ ধারণ করার পর কিছুক্ষণের জন্য তিনি মূর্ছা গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর কপালে আর শরীরে জমা ঘাম আর ময়লা একটা তামার পাত্রে জমানো হয়। আর সেই মিশ্রণ থেকে জন্ম নেয় এক সুদর্শন পুরুষ এবং নারায়ণ তাঁর নাম রাখেন তাম্বুলপুত্র। জন্মানোর পর সেই সুদর্শন পুরুষ নাগলোকে চলে যান, এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে নাগকন্যা তাঁকে বিবাহ করে এবং তার ফলে জন্ম নেয় পানরূপী নাগবল্লরী।
আবার লোকগাথা অনুসারে আয়ুর্বেদ পণ্ডিতরা দেবচিকিৎসক ধন্বন্তরির সহায়তায় পান আবিষ্কার করেন।
পান খাওয়াও এক ধরনের শিল্পের মধ্যে পরে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী পানের অগ্রভাগে আছে পরমায়ু, মূল ভাগে আছে যশ এবং মধ্যভাগে লক্ষ্মী বিরাজ করেন। আর সেই কারণেই হয়তো পান তৈরির সময় পানের বোঁটা ছিঁড়ে পানটা মাঝ-বরাবর ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে তবেই পান সাজা হয়। এবং পান খাওয়ার সময় খিলির আগা বাদ দিয়ে কেটে ফেলে দেওয়া হয়। মনে করা হয় পানের মূলভাগ খেলে কঠিন রোগ হয়, বোঁটা খেলে বুদ্ধিনাশ হয় এবং পানের অগ্রভাগ খেলে আয়ু কমে যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে পানের খিলি বানিয়ে পরিবেশন করার রীতি প্রথম প্রবর্তন করে আর্যরা, আর এই রীতি পরবর্তীকালে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে চিরাচরিত সাবেকি পানের সঙ্গে সঙ্গে চকোলেট-পান, ফায়ার-পান প্রভৃতি নানা ধরনের সাজাপান পাওয়া যাচ্ছে। তবে কোনও শুভ অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার পরে শেষপাতে পান দেওয়ার চল আজও বিরাজমান।