হ্যারিসন রোডের সেই বিখ্যাত বাসিন্দা। লম্বা ছিপছিপে অবয়ব, ধারালো নাক, অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অনবদ্য বিশ্লেষণী দক্ষতা। বাংলা সাহিত্যে ক্রাইম থ্রিলারের মাইলস্টোন বাঙালির প্রিয় ব্যোমকেশ। বাংলা ও বাঙালির শুধু নয়, অবাঙালিরও ছবির রসদ। স্রষ্টা শরদিন্দুর চিরায়ত সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সী।
ব্যোমকেশ গোয়েন্দা নন, সত্যান্বেষী। ব্যোমকেশের ফ্ল্যাটের দরজার পাশে পেতলের ফলকে লেখা ছিল দু’ছত্র— শ্রীব্যোমকেশ বক্সী/ সত্যান্বেষী। ‘সত্যান্বেষী’ মানে কী জিজ্ঞেস করায় অজিতকে ব্যোমকেশ বলেছিল, ‘ওটা আমার পরিচয়। ডিটেকটিভ কথা শুনতে ভাল নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ। তাই নিজের খেতাব দিয়েছি সত্যান্বেষী।’
নিপাট বাঙালি এই ভদ্রলোকটি বড়পর্দা, ছোটপর্দায় দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে চলেছে সেই কবে থেকে। আলোচনা, বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ব্যোমকেশের। সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী ব্যোমকেশ সিরিজের অন্যতম গল্প ‘দুর্গরহস্য’। আর ছবির নাম ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’ (Byomkesh o Durgo Rahasya)। যেখানে দুর্গের ভিতর অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র মজুমদারের হঠাৎ মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন আর সিংহ পরিবারের গুপ্তধন রহস্য এবং সিরিয়ালি ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোর তদন্ত করবে ব্যোমকেশ বক্সী। সঙ্গে থাকবে অজিত এবং সত্যবতী।
শুরুর দিন থেকেই ছবিটা চর্চার এবং খানিক বিতর্কের মধ্যে। এর প্রধান কারণ হল একই গল্প নিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায় ওয়েব সিরিজ বানিয়েছেন। সিনেমা এবং সিরিজের মধ্যে কোনটা সেরা এই নিয়ে ব্যোমকেশের দুই শিবিরের মধ্যে ছিল টক্কর। অবশেষে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আজ মুক্তি পাচ্ছে বীরসা দাশগুপ্ত পরিচালিত বহু প্রতীক্ষিত ছবি ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’। ছবিতে ব্যোমকেশ হিসেবে দেখা যাবে দেব-কে। ইদানীং দেবের সব ক’টি ছবি দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবার তিনি ‘সত্যান্বেষী’। বড়দের তো বটেই, সেই সঙ্গে কৌতূহল ও উত্তেজনা তুঙ্গে ছোটদেরও। কারণ কচিকাঁচাদের খুব প্রিয় ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর। টিজার এবং ট্রেলার লঞ্চ হবার পরেই বোঝা গেছে এ-ছবি ছোট থেকে বড় সবার ভাল লাগতে বাধ্য। সেইসঙ্গে দেবের লুকেও রয়েছে চমক। হঠাৎ তাঁকে দেখেই মনে হয়েছে যেন চিড়িয়াখানার উত্তমকুমারের সেই মোটা চশমার ফ্রেমের লুকের সঙ্গে অসম্ভব মিল। দেব-অনুরাগীরা মুগ্ধ তথা ছবির অজিত অম্বরীশ তো বলেই দিয়েছেন ‘উত্তমের পর সেরা ব্যোমকেশ দেব’। কাজেই রিলিজের আগেই একশো পেয়ে গেছেন দেব। সব মিলিয়ে ছাপিয়ে যাবে নতুন ব্যোমকেশ— এমনটাই আশা করা যাচ্ছে।
একটা বিস্তীর্ণ যুগ, দীর্ঘ সময়কাল আর পটভূমি ঘিরে দুর্গরহস্যের গল্প লিখেছেন লেখক। নবাব আলিবর্দি খাঁ, মারাঠা বর্গির বাংলা আক্রমণ, বণিক তথা বাণিজ্যের খোলস ছেড়ে রাজদণ্ডের দিকে ধীরে ধীরে এগোনো ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ। রাষ্ট্রবিপ্লব, সিপাহি বিদ্রোহ, পলাশির যুদ্ধ এবং তার একশো বছর পর, বিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই শুরু হয়েছে দুর্গরহস্যের প্রেক্ষাপট। যেখানে খুনের রহস্যের কিনারা করতে ব্যোমকেশ ও অজিতের আগমন। গর্ভবতী স্ত্রীর হাওয়া বদলের সঙ্গে রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন, রথদেখা আর কলাবেচা— দুই নিয়েই জমজমাট ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’।
আরও পড়ুন- দাঙ্গার গঠনতন্ত্র
দেব নিজের অভিনীত চরিত্রগুলো নিয়ে বরাবর বেশ সিরিয়াস। স্বাভাবিকভাবেই ব্যোমকেশ নিয়ে অনেক বেশি খেটেছেন তা ট্রেলারের ঝলক দেখে বোঝা গিয়েছিল। প্রসঙ্গত ব্যোমকেশ চরিত্রটা নিয়ে দেব জানিয়েছেন, ‘সবসময় চেয়েছিলাম ব্যোমকেশ হলে আমি আমার মতো হব। অনেক ব্যোমকেশ হয়েছে, আমি তাঁদের কারোর মতো নিজেকে দেখতে চাইছিলাম না। নিজের উপর অনেক কাজ করেছি এই ছবিটা করার আগে।
তিনি আরও বলেন, ‘সব ছবিতেই দর্শকের কাছে একটা সামাজিক বার্তা যায়। এই ছবিতে স্ত্রী সত্যবতী আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা, তাই ছবির ব্যোমকেশ ধূমপান করেন না। সে ফ্যান্টাস্টিক ফ্যামিলি ম্যান। আমি পড়াশুনো করেছি এটা নিয়ে এবং দেখলাম, যে-সময় ব্যোমকেশের গল্প সেইসময় জার্মানিতে রিসার্চ চলছে এবং প্রমাণ হয়ে গেছে যে সিগারেট খেলে মা এবং বাচ্চা দুয়েরই ক্ষতি হতে পারে। কাজেই মনে হয়েছিল ওই সময়ের দৃশ্যপটে এটা রাখলে ভুল কিছু হবে না।’
মে-জুন মাসে প্রায় ৪৭ ডিগ্রি গরমে শ্যুটিং হয়েছে ছবির অনেকটা অংশ। মধ্যপ্রদেশের ‘ওরছা’র অদূরে গারপুঙ্গা ফোর্টে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছবিতে দর্শকদের মুগ্ধ করলেও নেপথ্যের প্রস্তুতি ছিল বেশ কঠিন। প্রায় রোজ ২৫০ থেকে ৩০০ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হত দেব-সহ গোটা টিমকে। কঠিন পরিশ্রমসাধ্য আউটডোর ছিল গোটা টিমের জন্য।
ছবিতে সত্যবতীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী রুক্মিণী মৈত্র। চরিত্রের দাবিতে কৃত্রিম গর্ভ নিয়ে তিনি অভিনয় করেছেন। সাড়ে চার কিলো ওজনের কৃত্রিম গর্ভ নিয়ে অত গরমে শ্যুটিং করা মোটেই সহজ ছিল না তাঁর জন্য। প্রসঙ্গত রুক্মিণী জানালেন, প্রথম প্রথম খুব উৎসাহী ছিলাম। নকল গর্ভ নিয়ে শ্যুটিং করব ভেবে, এক্সাইটেড ছিলাম ভীষণই। এটাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা শ্যুটিং করেই হাড়ে হাড়ে টের পাই যে কেবল নকল গর্ভ নয়, একজন সন্তানসম্ভবা মায়ের যা যা কষ্ট হয় সবই আমার হবে। সমস্ত শারীরিক সমস্যাই আমায় ফেস করতে হবে। আমার পা ফুলে গিয়েছিল কয়েক দিনের মধ্যেই। আমাকে ওজনও বাড়াতে হয়েছিল সত্যবতী হয়ে ওঠার জন্য।’
দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেঞ্চার, শ্যাডো ফিল্মস প্রযোজিত, শ্যামসুন্দর দে, তন্ময় সাহা এবং দেব অধিকারী নিবেদিত, বীরসা দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’তে (Byomkesh o Durgo Rahasya) দেব আর রুক্মিণী ছাড়াও অজিতের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অম্বরীশ ভট্টাচার্য, রয়েছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, সত্যম ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে।
‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’র টাইটেল ট্র্যাক ‘ব্যোম সত্যান্বেষী’ কথা ও সুর মন জয় করেছে দর্শকদের৷ লগ্নজিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও যে মানে না মানা…’তে ফ্যামিলি ম্যান ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর দাম্পত্য রসায়নও নজর কেড়েছে। মিউজিক প্রোডাকশনের কাজ করেছেন সুদীপ্ত পাল এবং দীপ্তার্ক বসু।
দুর্গের মধ্যে রহস্য, খুন ও প্রতিহিংসার সমাধানে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ৷ কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে? আর কীভাবে হবে রহস্যের সমাধান? তার উত্তর মিলবে আজ।