চৈতন্যদেবের সমন্বয়ী ধারণার বিপ্রতীপে অবস্থান বিজেপির

সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, দলিত বিদ্বেষ যাঁদের ডিএনএতে তাঁরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবান্দোলনের অংশীদার হতে পারেন না। বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ হওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁদের। লিখছেন অধ্যাপক ড. অর্ণব সাহা

Must read

বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার গোটা হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব দাবি করলেও আদতে তারা উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের উপাসক। তারা গোটা ভারতে দলিতদের উপর নৃশংস অত্যাচার বাড়িয়ে দিয়েছে বিগত দশ বছরব্যাপী। সঙ্ঘের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউ যে জায়গা পায় না, তা বিগত ১০০ বছরের আরএসএস-এর ইতিহাসই প্রমাণ করেছে। সঙ্ঘ মূলত পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী, নারী-বিদ্বেষী একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা, যারা ভোট অথবা নিজেদের প্রসারের স্বার্থে হিন্দু ধর্মের সমস্ত স্তরগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে একটি সার্বিক ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় বটে, কিন্তু সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ, দলিত-বিদ্বেষ এদের ডিএনএ-তে রয়েছে। আর বাংলায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র বাঙালি-বিদ্বেষ। বাঙালি শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ী বাতাবরণে নিজের জাতিগত অস্মিতা গড়ে তুলেছে বিগত একহাজার বছর ধরে। বিজেপি এই সমন্বয়ী সংস্কৃতির চেহারা আদৌ বোঝেই না। তাই কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে, কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করেও বাঙালির মনের দখল পাচ্ছে না তারা। পাবেও না। কারণ, বাংলা ও বাঙালি যে চৈতন্যদেব (Chaitanya Mahaprabhu), লালন ফকির, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উত্তরাধিকার বহন করে, বিজেপি তার অর্থই বোঝে না। তাই বিজেপি বাঙালির হৃদয়ে জায়গা পাবে না।
মধ্যযুগের চৈতন্য (Chaitanya Mahaprabhu) প্রবর্তিত বৈষ্ণব ভাবান্দোলন বাঙালি সমাজে এক চিরস্থায়ী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। সনাতন বর্ণাশ্রমশাসিত হিন্দুধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো চৈতন্যদেব ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর ভাবধারায় ইসলামি সুফি সাধনার প্রভাব নিয়ে অজস্র গবেষণা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে চৈতন্য-ভাবান্দোলন বাংলায় অনেকগুলি লৌকিক গৌণধর্ম গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। যেমন ধরা যাক, বাউল সম্প্রদায়ের কথা। তাঁরা মনে করেন নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্রই স্বয়ং চৈতন্যের অবতার। তাঁর থেকেই নাকি বাউলদের ক্রিয়া-করণের সূচনা। মারফতি ফকিররা মনে করে, যে আল্লা সেই রসুল, যে আল্লা সেই মহম্মদ, যে মহম্মদ সেই চৈতন্য। দেহের মধ্যে চৈতন্য রূপে তাঁর যাতায়াত। সেই চৈতন্যই আবার তাদের ধর্মের প্রবর্তক আউলে-চাঁদ। তিনিই পরে সতী মায়ের গর্ভে তাঁদের পরমারাধ্য দুলালচাঁদ হয়ে জন্মেছেন। নবদ্বীপে শচীমায়ের গর্ভে যেমন চৈতন্যচাঁদ, ঘোষ-পাড়ার সতী-মায়ের গর্ভে তেমনই দুলালচাঁদ। তাদের যুক্তি অনেকটা এইরকমই। মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি বলে একজন সাধক তাঁর নিজের নামে বলরামী বলে এক সম্প্রদায় গড়েছিলেন। শিষ্যেরা তাঁর প্রয়াণের পরে সেই বলরামের মধ্যে চৈতন্যতত্ত্ব মিলিয়ে গান বাঁধলেন—
নবদ্বীপে এসে ছদ্মবেশে
কেঁদে গেল শচীর গোরা।
কলিকালে মেহেরপুরে
পূর্ণমানুষ দেখরে তোরা।।
অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই কথাই কায়েম হয় যে, মেহেরপুরের বলরাম সেই পূর্ণমানুষ যিনি আসলে শচীর গোরা। ঠিক তেমনই লালন ফকির লিখলেন:
শুনে অজানা এক মানুষের কথা
গৌরচাঁদ মুড়ালেন মাথা।
এ-গানের সারকথা হল, বাউল দরবেশরা যে অজানা মানুষ বা ‘আলেক মানুষে’র সাধনা করে শ্রীচৈতন্যও সেই ‘আলেকে’র (‘আলেক’ কথাটির অর্থ ‘অলক্ষ’) খবর অন্তরের মধ্যে পেয়ে গ্রহণ করেছিলেন সন্ন্যাস। এই কথার মাধ্যমেই কিন্তু বলার চেষ্টা হল, শ্রীচৈতন্যের যে সাধনার ধারা তার সঙ্গে বাউল দরবেশের সাধনা অভিন্ন। তাঁরা বলেন—
দরবেশী বাউলের ক্রিয়া
বীরভদ্র জানে সেই ধারা।
আসলে চৈতন্যের (Chaitanya Mahaprabhu) মধ্য দিয়েই সামাজিক অচলায়তন ভাঙনের সূচনা। চৈতন্যের কৈশোর-যৌবনকালে সমাজে একদিকে ইসলামি শাসন চলছে, অন্যদিকে চলছে নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রবল অত্যাচার। সেই অরাজকতা ও অনাচারের সামনে চৈতন্য যে বিপ্লবের বাণীগুলি বহন করে আনলেন সেগুলি হল— (১) জাতি বর্ণের কোনও ভেদ নেই, সকলেই সমান। কথাটির সম্প্রসারণ করলে দাঁড়ায়, জন্ম যে জাতেই হোক দ্বিজ বা চণ্ডাল, হরি বললে সকলেই সমান, সকলেই বৈষ্ণব। (২) হরিকে পেতে গেলে শুধু হরি বলো, আর কিছু চাই না। অর্থাৎ বৈষ্ণবের সাধনায় বৈদিক যাগযজ্ঞের বালাই নেই (মনে রাখতে হবে, গৌতম বুদ্ধও বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ-পুরোহিত চাই না। মন্ত্র ও দেবতার মূর্তিও নিষ্প্রয়োজন। কেবল দেবতামূর্তি নয়, শিলা, বিগ্রহ, কাঠের পুতুল, গাছ এগুলোও পুজো করতে হবে না (মনে রাখতে হবে এগুলো টোটেম পূজা, নিম্নবর্ণের দেশীয় অস্ট্রিক সমাজে এগুলোর প্রচলন ছিল)। (৩) বৈষ্ণবকে হতে হবে সহিষ্ণু, আচরণে দীনাতিদীন। আর, যে মানুষ মানহীন, অবমানিত, অবহেলিত দাঁড়াতে হবে তাদের পাশে। তাদের করুণা নয়, করতে হবে শ্রদ্ধা। একসঙ্গে তাদের অপমানেরও ভাগিদার হতে হবে। তাদের দুঃখদুর্গতির ভাগও নিতে হবে। চৈতন্যধর্ম যে এত দ্রুত বাংলার সমাজের এতো বিরাট অংশে প্রভাব ফেলেছিল, তা বিনা কারণে নয়। এবং আজও বাংলার মাটিতে সমন্বয়ী সংস্কৃতির বীজ ও শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত বলেই বাংলার জনমানুষের রায় বারবার হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের ধারক ও বাহক বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে বাংলার আপামর গণ-মানুষ সেই প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন।

আরও পড়ুন-শারদ-উদ্ধবের সঙ্গে আজ বৈঠকে নেত্রী, কথা হবে অখিলেশের সঙ্গেও

Latest article