আমাদের স্বাধীনতারও আগে, ১৯৪৬ সালে বহু বিবর্তনের পথ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কম্পিউটার (Computer and Computing) আবিষ্কার ও স্বীকৃত হয়। নাম ইনিয়াক, নকশায় নির্মাণে ছিলেন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন মাউচলি ও জে প্রেস্পার একার্ট । প্রতিরক্ষা দপ্তরের গোলা নিক্ষেপের গতিবেগ নির্ধারণই ছিল এর কাজ। ব্রিটেনের চার্লস ব্যাবেজ সেই ১৮২২ সালে ভেবেছিলেন ডিফারেন্স ইঞ্জিনের কথা, পরে এল অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন। অ্যালান টিউরিং এলেন তার বিশ্বখ্যাত মডেল, তত্ত্ব নিয়ে। ভারতে প্রথম কম্পিউটার বসে ও চালু হয় কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটে ১৯৫৫ সালে। মূলত অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহালনাবিশের উদ্যোগে এবং সহযোগী অধ্যাপক সমরেন্দ্রকুমার মিত্রের নেতৃত্বে। এই সত্তর বছরের বেশি সময়ে বিদেশে তো বটেই, স্বদেশেও বিভিন্ন প্রান্তে মূলত মানুষের গণনার ভার কমানোর জন্য কম্পিউটার, এককালের বিরোধিতা সত্ত্বেও, অজস্র প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হয়েছে এবং বহু কাজকে সহজ ও কার্যকরী করা সম্ভব হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ আসে ও বহু বিবর্তনে তার আধুনিক রূপ দেখতে পাই।
সেই পঞ্চাশ বা ষাট দশকে যে বিষয়গুলি ছিল কম্পিউটারকে (Computer and Computing) বুঝতে বা ব্যবহার করতে, তার অনেক ধরন বা শৈলী আজ বদলে গেছে। কম্পিউটার নির্মাণ তো বটেই, তার প্রোগ্রামিং ভাষা শেখা ও ব্যবহারের বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে, দক্ষতারও। আবার, বড় কম্পিউটার থেকে এসে গেছে ডেস্কটপ ল্যাপটপ পিসিতে, এমনকী মুঠোফোনে, এক কুক্ষিগত জায়গা থেকে চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া নেটওয়ার্কের বিবিধ যোগাযোগে, অনেক ভাষাতে লেখাপড়া, সংস্কৃতির বিভিন্ন সড়কে, অডিও ভিডিও নিয়ে। বস্তুত, সমাজমাধ্যমে কম্পিউটারের বিবিধ উদ্ভূত যান্ত্রিক উপকরণ নিয়ে লেখা আর ছবি, বক্তব্যের আদানপ্রদানের ছড়াছড়ি। অঙ্ক কষা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে পড়েছে কিছুটা ব্রাত্য, অগাণিতিক প্রক্রিয়াগুলির প্রবল আগ্রাসী চাপে । কিন্তু সংখ্যা যদি কোটি কোটির পরেও পৌঁছয়, কম্পিউটার (Computer and Computing) তার দ্রুত গতি ও বিশাল ধারণক্ষমতা নিয়ে তথ্য সামাল দিতে আসতে বাধ্য। সুসংহত বিগ ডাটা বুঝে ছোট করে, সিদ্ধান্ত নিতে, ছেঁকে কম্পিউটারে বিধির নতুন দিক অধ্যয়নে, গবেষণায় ও বাণিজ্যে অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
কম্পিউটার তাই ব্যবহারে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে চায়, এসে পড়ে। কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ফিরে ফিরে নব নব বিষয়ের পথ খুঁজেছে । শুধু তা পড়ার জন্যই নয়, তারও পরে গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার পরীক্ষামূলক ও চালু ব্যবহারে। তাই বহুজনের কেরিয়ার বা নিজ জীবনধারার অসংখ্য দিক খুঁজে নেওয়া এতে বেরিয়ে আসে। ইদানীং যে বিষয়গুলি এসেছে, তার মধ্যে পড়ে ডাটা সায়েন্স, আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং বিষয়গুলি। তাতে এই ছোট্ট ভূমিকা হয়তো কিছু পাঠকদের নতুন করে এই ব্যাপারে আবার উস্কে দেবে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বিষয় আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধি। আমাদের যে বুদ্ধি, যার তারতম্যে আমরা নিজেদের সব কাজগুলো ভেদাভেদ করতে করাতে থাকি, তার কতখানি কম্পিউটার নিতে পারে, তা নিয়ে চর্চা। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে রচনার সমাহারও এক বিগ ডাটার উদাহরণ। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স থেকেই এসে গেছে মেসিন লার্নিং এবং ডীপ লার্নিং। রোবোটিকস জুড়ে গেছে এই চর্চা নিয়ে, বিভিন্ন স্তরে মানুষের উপকারে। নিউরন কেন্দ্র বা উপাদানকে নিয়ে এর বিস্তার। ডীপ লার্নিং এক ধরনের মেসিন লার্নিং ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স যা মানুষ কীভাবে বিভিন্ন জ্ঞান পায় তা অনুকরণ করতে। ডিপ লার্নিং-এ গভীরে বাড়তি স্তর যথেষ্টই রয়েছে যা তথ্য থেকে শিখতে পারি।
ডেটা সায়েন্স বিষয়টি জানতে গেলে অঙ্ক তো জানতে হবেই, রয়েছে রাশিবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স-এর বেশ কিছু প্রাথমিক ও উচ্চতর দিক, যা তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে তথ্য বণ্টন, বিতরণ পর্যন্ত এই বিষয়গুলির নীতি, সূত্র, সমাধানের বহু স্বীকৃত ও পরীক্ষিত দিক নিয়ে চর্চা এগোতে হয়। ডাটা সায়েন্সে তাই ডেটা বা তথ্য চিহ্নিত করে অন্যান্য ডেটার সঙ্গে তার মিলমিশ, সম্পর্ক কতখানি, কতদূর, এমন কি বিজ্ঞানসম্মতভাবে এনে পরীক্ষা প্রমাণ করা, প্রক্রিয়ায় ব্যবহারে নতুন অন্তর্দৃষ্টি আনা। সে তথ্য সম্পাদনেও, সংরক্ষণে, বিশ্লেষণেও।
ডেটা সায়েন্সেস ব্যবহারের দিক রোজই উন্মোচিত হচ্ছে। তথ্য সত্য কী মিথ্যা, আর্থিক দুর্নীতি, অডিট পদ্ধতির নব ধাপে ধাপে মত দেওয়া, অসাধু, অপরাধীর কথাবার্তায়, কাজেকর্মে এখনকার দিনে উদ্ভূত সাইবারক্রাইম, সাইবারসিকিউরিটির অর্থাৎ তথ্যের সুরক্ষায়, প্রতিকারে প্রতিরোধে ঈপ্সিত বা সমাধিত তথ্য এসে পড়ছে, প্রয়োজনীয় ডেটাবেস গড়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-জাঙ্গিপাড়ায় কিশোরী খুনে গ্রেফতার চার
রোগ অসুখ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে, সুস্থ অসুস্থ সব মানুষের যাবতীয় মেডিকেল তথ্য এক ঢাউস ইতিহাস তৈরি, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ডেটা-মেটাডেটা, তা নিমেষে নিয়ে এসে চিকিৎসার, শুশ্রূষার সুবিধা করছে। আবহাওয়া ভালমন্দের পূর্বসাবধানতায়, মোকাবিলায় রাশি রাশি তথ্য থেকে অবস্থা অনুযায়ী মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় হাজির হচ্ছে। অর্থনীতিতে, ব্যাঙ্কে, স্টক মার্কেটে, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আগে পরে গিয়ে ভবিষ্যৎবাণী বা সম্ভাবনা আরও ভালভাবে বলা যাচ্ছে।
হোটেল বা কেনাবেচার ছোটবড় মল দোকানে, বিভিন্ন পরিষেবায়, ক্রেতাদের ঝোঁক, অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ, তাদের ধরে রাখায় তথ্য বিকল্প সমাধানগুচ্ছ নিয়ে হাজির হয়। মূল কথা, গণিতের দিক থেকে তথ্যগত সমস্যা যদি ছড়ানো, অরৈখিকতার রূপ ধারণ করে, তাহলে তা বাস্তবতায় ফেলে ছোট ছোট রৈখিক মডেলে ফেলে আরও ভাল সমাধান আসছে । তথ্যখনি থেকে তুলে আনা তথ্য, গুদামের মতো সারি সারি সাজিয়ে, অঙ্কের সারি মেনেই, যাতে প্রয়োগ করা যায় অঙ্কের সূত্র এবং জ্যামিতিতে তা বিবিধ চিত্র দিয়ে অনেককে সহজ করে বোঝানো যাচ্ছে। এখন কেনাকাটিই যে অনেকটা অনলাইনে, তা বই বা খাবারদাবার বা জিনিসপত্রে, বাণিজ্যের পরিষেবায় ভাল দামে বা সরবরাহে, তাও চিহ্নিত ও উপলব্ধি করা যাচ্ছে ; বিশেষ ছাঁচ বা আদর্শ, তথ্য এসে প্রতিযোগিতাকেও এক অন্য দিগন্তে এনে মাথা ঘামানোর সুযোগ করে দিচ্ছে, কম্পিউটারশাসিত (Computer and Computing) ও বাহিত বিশাল তথ্যের ও প্রক্রিয়ার দাক্ষিণ্য নিয়ে। এ ছাড়াও রয়েছে চালক ছাড়া গাড়ি চালানোয় সহায়তা, ট্রাফিক বুঝে, স্থির বস্তু দেখে, যাতায়াতে কোনটা সবচেয়ে ভাল পথ তা জানিয়ে দেওয়া। মেশিন লার্নিং আর অ্যানালিটিক্স বিষয়ে আরও কত জায়গায় সুবিন্যস্ত তথ্য ঘিরে সমাধান দৈনন্দিন জীবনেও ঢুকে পড়েছে, স্বাভাবিকভাবেই, এই স্বল্প পরিসরে সেইসব দিক ও ব্যবহার এখানে বলা গেল না।