শুরুর কথা
ভারতীয় মশলার (Condiment) গুণাগুণ বিশেষ করে ঔষধি গুণ আদিমকাল থেকে জনপ্রিয়, আয়ুর্বেদেও এর উল্লেখ রয়েছে। এইসব মশলা যার ব্যবহার বেশির ভাগটাই এশিয়ার কিছু কিছু দেশে এবং চিনদেশে দেখা গেছে। চাইনিজ মেডিসিনেও ব্যবহার হয়েছে এই মশলার। মশলার ব্যবহার মূলত রান্নায় খাবার হিসেবে এবং রান্নার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ হিসেবেও। মশলার (Condiment) ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে আজ থেকে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওল্ড টেস্টামেন্টে মরিচের কথার উল্লেখ রয়েছে। আরব্য রজনীতে, নাবিক সিন্দাবাদের অভিযানে মরিচের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য দেশে রসুন, পেঁয়াজ, জাফরান, এলাচের ব্যবহার ছিল। মশলার রফতানি হত ভারতবর্ষ থেকে। তখন পাশ্চাত্য দেশগুলোয় মশলার ব্যবহার খুব কম হত। তবে সেখানেও ধীরে ধীরে চাহিদা তৈরি হয়। তারা তখন মশলা (Condiment) খোঁজার জন্য পথে বেরয়। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে কিছু আরব নৌকা ভারতের পশ্চিম উপকূলে নোঙর করে এবং তারা মালাবার দ্বীপে মশলা নিয়ে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। বেশ কয়েক শতাব্দী পর দেখা যায় মশলা সরবরাহ শুরু হয়ে গেছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। এখান থেকেই মশলার বাণিজ্য আরব, পারস্য, চিন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারা ইউরোপে তখন ভারতীয় মশলার গুণাগুণ নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গেছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে
এই সময় মশলার (Condiment) সন্ধানে ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৮ সালে ভারতের কালিকটে এসে পৌঁছন। উনি এখানে এসেছিলেন কালোমরিচের বা ব্ল্যাক পিপারের সন্ধানে। ওঁরা জাহাজে করে প্রচুর মরিচ নিয়ে ফিরে যান। ওদিক থেকে বেরিয়েছিলেন কলম্বাস। তিনি ভারতে পৌঁছননি। সোজা চলে গিয়েছিলেন সাউথ আমেরিকাতে। ওখানে কলম্বাস পেয়েছিলেন ক্যাপসিকাম। লঙ্কার তখন কিন্তু খুব বেশি ব্যবহার হত না। বেশিরভাগই মরিচের ব্যবহার ছিল, বিশেষ করে এই দেশে।
মশলার (Condiment) কথা বলতে গেলে আর একটা দেশের কথা বলতেই হয়— সেই দেশ হল ইজিপ্ট। সেই দেশের রানি ক্লিওপেট্রা নিজের রূপচর্চায় প্রচুর মশলা ব্যবহার করতেন। নানারকম সুগন্ধী ব্যবহার করতেন যা মশলা দিয়েই তৈরি হত। সেই সময় মিশরে যেসব পিরামিড তৈরি হয়েছে তা মূলত বড় বড় পাথর দিয়ে। যে পাথর টেনে টেনে আনতে হত শ্রমিকদের, কারণ, অত যুগ আগে কোনও আধুনিক যন্ত্র ছিল না আজকের মতো যা দিয়ে পাথর টানা যাবে। তো এই অমানুষিক শক্তি ওই দেশের শ্রমিকদের থাকার কারণ হচ্ছে তাঁদের খাবার। যে খাবারে প্রচুর মশলার ব্যবহার হত। জানা গেছে, তাঁদের শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পিঁয়াজ-রসুন খাওয়ানো হত। আবার মিশরের পিরামিডের ভিতরে মমিগুলো যুগের পর যুগ ধরে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। এত ভাল প্রিজার্ভেশনের কারণ কিন্তু মশলা। ইজিপশিয়ানরা মশলা এবং মশলা দিয়ে তৈরি তেলের ব্যবহার জানতেন।
মশলাতেই বাধল গোল
আমাদের দক্ষিণ ভারতে প্রচুর মশলা পাওয়া যায়। ওখানে একটা বোর্ড আছে যার নাম ইন্ডিয়ান স্পাইসেস বোর্ড। এটি ভারতীয় মশলার আমদানি এবং রফতানি করে এবং ভারতের প্রধান যে আয় তা কিন্তু মশলা থেকে।
আবার এই মশলাই ভারতের স্বাধীনতা হারানোর অন্যতম কারণ। মশলার টানেই প্রথমে পর্তুগিজরা আসে এখানে তারপর ডাচ এল, তারপর একসময় এল ইংরেজরা। তারা প্রথমে এসছিল মশলার সন্ধানেই। এই দেশে এসে মশলা নিয়ে গেছে সকলেই এবং প্রচুর মশলার পেটেন্টও হয়েছে বিদেশে গিয়ে। যে কারণে ভারতবর্ষ এখন মশলার জন্য লড়ছে। যেমন হলুদের পেটেন্ট নিয়ে লড়ে ভারত সম্প্রতি জিতেছে। ভারতে মশলা ছিল একটা বিরাট সম্পদ। যা লুটেপুটে নিয়ে গেছে বিদেশিরা। নিঃস্ব করেছে এই দেশকে। এত অপার ঐশ্বর্য মশলার যে এত লুটপাটের পরেও এখনও ভারতীয় মশলাভাণ্ডার কিছু কম নেই। মশলার চাহিদার কারণ এর প্রচুর ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে।
আরও পড়ুন: আজ ডুরান্ডের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী
মশলা আসলে কী
মশলা হল যা স্বাদ দেয়, গন্ধ দেয়, যার ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে, কম পরিমাণে ব্যবহার হয় রান্নায় এবং সর্বোপরি তা গাছের যে কোনও একটি অঙ্গ হতে পারে। যেমন, গাছের ফল হল লঙ্কা, তেঁতুল, জায়ফল, জয়িত্রী ইত্যাদি। জায়ফল আর জয়িত্রী একই ফলের দুটো অংশ বাইরেটা এবং ভিতরটা। আবার অপরদিকে গাছের পাতা হল তেজপাতা, পুদিনাপাতা, তুলসীপাতা, মেথিপাতা, কারিপাতা ইত্যাদি। কিছু মশলা গাছের ছাল থেকে আসে যেমন দারুচিনি। শিকড় থেকে পাওয়া যায় আদা, পিঁয়াজ জাতীয় মশলা। যেসব মশলা ফলের বীজ হিসেবেই রয়ে যায় সেগুলো হল— মৌরি, জোয়ান, সোয়া, পোস্ত, বেদানার বীজ ইত্যাদি। কিছু ক্ষেত্রে ফুলের রেণুও মশলা হতে পারে যেমন জাফরান, গাছের আঁঠা শুকিয়ে পাওয়া যায়। গাছের রস হল হিং। ফুলের কুঁড়ি থেকে ফুল না হয়ে শুকিয়ে গিয়ে পাওয়া যায় লবঙ্গ। সুতরাং গাছের কোনও একটি বিশেষ অঙ্গ মশলা হবে তার কোনও মানে নেই। মশলা গাছের যে কোনও অঙ্গই হতে পারে। এগুলোকে মেডিসিনাল প্ল্যান্টও বলা হয়। মেডিসিনাল প্ল্যান্টের একটা বড় অংশ হল মশলা। একটা তাই মশলার উৎপত্তি দেখে একে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা সম্ভব।
ঔষধিগুণ
এই মশলার অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে তাই ভারতীয়রা একে শুধু রান্নায় স্বাদের জন্য ব্যবহার না করে ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করছে আসছে বহুযুগ ধরে। কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় মশলার ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে বিদেশে মশলা থেকে তাঁর সারবস্তু (Active Principle) আলাদা করে নিয়ে চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
শুরু থেকে শেষ মশলাই
মশলার প্রথম কাজ রান্নাকে সুস্বাদু করা। পাশ্চাত্য দেশে মশলার ব্যবহার কম কারণ তারা ভয় পান মশলা বেশি খেলে পেটব্যথা বা শারীরিক সমস্যা হতে পারে যেটা খুব ভুল ধারণা। দক্ষিণ ভারতীয় স্পাইসেস বোর্ড বাহান্ন ধরনের মশলাকে চিহ্নিত করেছে। তার মধ্যে গোটা পঁচিশ থেকে তিরিশটা মশলা পশ্চিমবঙ্গ এবং গোটা দেশের মানুষ সারাদিন ধরে ব্যবহার করে চলেছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মশলার ব্যবহার রয়েছে। যেমন, ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজা। সেই মাজনের মূল উপাদান কিন্তু লবঙ্গ। লবঙ্গ, লবঙ্গর তেল ব্যবহৃত হয় টুথপেস্টে। লবঙ্গ দাঁতের যন্ত্রণায় খুব উপকারী। চিকিৎসকেরা লবঙ্গ ব্যবহার করেন এবং ব্যবহার করতে বলেন। লবঙ্গ অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণে সমৃদ্ধ। লবঙ্গর মধ্যে রয়েছে থাইমল। এই কম্পাউন্ড ভীষণ কার্যকরী। এই কম্পাউন্ড দিয়ে অ্যানালজেসিক তৈরি করা হয়েছে যা ব্যথা উপশম করে। কিন্তু আসল হল লবঙ্গই। আবার দিনের শেষে রাতে শোবার সময় কিছু একটা খাই। অনেকেই পান খান যার মধ্যে অনেক মশলা থাকে এছাড়া মৌরি বা জোয়ান যা হোক বাড়িতে থাকেই। তাই আমরা বলি স্টার্ট দ্য ডে উইথ স্পাইসেস, এন্ড দ্য ডে উইথ স্পাইসেস।