ভারতবর্ষ হল মশলার (Condiments) দেশ। ভারতীয় মশলাকে (Condiments) শুধু স্বাদের গণ্ডিতে না রেখে নিয়ে আসা হয়েছে কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়। বর্তমানে বিদেশে মশলা (Condiments) থেকে তার সারবস্তুটি (Active ingrediant) আলাদা করে নিয়ে চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আজকে লবঙ্গ আর লঙ্কার ঔষধি গুণাগুণ জানা যাক।
লবঙ্গ
প্রথমেই বলা যেতে পারে লবঙ্গর কথা। মশলার (Condiments) ঘরানায় সবচেয়ে বহুল প্রচলিত হল লবঙ্গ। পৃথিবীতে এর প্রচলন কবে থেকে বলা মুশকিল। তৃতীয় খ্রি. পূ. চিনে লবঙ্গর ব্যবহার হত দাঁতের যন্ত্রণা উপশমের জন্য। রোমানরা এর ব্যবহার করেছিলেন অনেককাল আগে। চতুর্থ শতাব্দীতে সারা ইউরোপে লবঙ্গ জনপ্রিয়তা পায়। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা লবঙ্গ চাষের উৎসস্থান আবিষ্কার করেছিলেন। সংহিতা আর বেদে লবঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম লবঙ্গ ভারতে রফতানি করে।
লবঙ্গ গাছের বোঁটা-সহ ফুলের কুঁড়ি শুকিয়ে গেলে তা লবঙ্গে পরিণত হয়। লবঙ্গের তেলের উপর তার মান নির্ভর করে। লবঙ্গে ষোল থেকে আঠারো শতাংশ তেল পাওয়া যায়। লবঙ্গে রয়েছে শর্করা, প্রোটিন, স্নেহ জাতীয় তৈল পদার্থ, হাইড্রোলিক অ্যাসিড, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, থায়ামিনরাইবোফ্লোবিন, নায়াসিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ। লবঙ্গের তেলে রয়েছে ইউজিনল অ্যাসিটেট এবং ইউজিনল ও ক্যারিওফিলিন।
উপকারিতায়
রোগ নিরাময়ে লবঙ্গকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই আদিকাল থেকে। বাতের ব্যথা, দাঁতের ও মাথার যন্ত্রণায় লবঙ্গের তেল খুব উপকারী।
লবঙ্গের তেল হজমশক্তি বাড়ায়। পেট ফাঁপা রোধ করে। স্টমাক আলসার, পেপটিক আলসার থেকে সুরক্ষা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে জীবাণু ও কীটনাশক ক্ষমতা।
ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের রোগ সারাতে সাহায্য করে। ধোঁয়া, ধুলো, ঠান্ডা লাগার ফলে শ্লেষ্মা বেড়ে গিয়ে শির রোগের ক্ষেত্রে লবঙ্গের তেল উপকারী।
চোখ উঠলে লবঙ্গ ভিজিয়ে সেই জল লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
লবঙ্গ শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদানগুলো সরিয়ে রক্ত পরিশোধনে সাহায্য করে। রক্তকে পরিষ্কার করে।
লবঙ্গের উপাদান হাড়ের জোর ও বোন ডেনসিটি বাড়াতে সাহায্য করে।
লঙ্কা
আঝালা খাবার কি আমাদের ভাল লাগে? সব খাবারে কম-বেশি লঙ্কা দিয়ে থাকি। অথচ এই লঙ্কার হাত যদি চোখে-মুখে কোথাও লাগে তাহলে কী হয়? জ্বালা করে, লাল হয়ে যায়, যন্ত্রণা হয়। লঙ্কার ধোঁয়াতে হাঁচি, কাশি সব হয়। মুখরোচক স্পাইসি ফুড মানেই লঙ্কা। তাহলে শরীরে গিয়ে এই লঙ্কা থেকে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণা করা উচিত। তা হলে লঙ্কা আসলে কী? লঙ্কা কিন্তু একটা অ্যাডিকশন। যাঁরা লঙ্কা খায় তাঁরা ছাড়তে পারবেন না। শরীর লঙ্কা নিচ্ছে। যদি রিজেক্ট করে দিত তবে লঙ্কার চাহিদা থাকত না। প্রাচীনকাল থেকে চিন এবং এইদেশে লঙ্কাকে ব্যাধি-নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। চরক ও সুশ্রুতে লঙ্কার উল্লেখ রয়েছে। বেদ এবং সংহিতায় এর উল্লেখ নেই তাই লঙ্কাকে নবাগত বলা যায়। লঙ্কার পুরো প্রজাতিটাই হল ক্যাপসিকাম। আমরা চলিত কথায় বড় সবুজ লঙ্কাগুলোকে ক্যাপসিকাম বলি কিন্তু ছোট লঙ্কাও ক্যাপসিকামই। তফাত একটাই— বড়গুলোয় ঝাল হয় না। এক-একটি রাজ্যে এক-এক ধরণের লঙ্কা হয়।
উপকারিতায়
লঙ্কার মধ্যে রয়েছে ক্যাপসাইসিন যার উপর লঙ্কার ঝাল নির্ভর করে। এটি একটি যৌগ যা যে কোনও ধরনের ফোলা বা ব্যথা, ফোঁড়া কমিয়ে দিতে পারে। লঙ্কা খেলে এই ক্যাপসাইসিন শরীরের মধ্যে যায় এবং যত জ্বালা-যন্ত্রণা ধীরে ধীরে কমাতে শুরু করে।
আরও পড়ুন:বয়কট কালচার: সংস্কৃতি-সন্ত্রাসের নয়া হাতিয়ার
শরীরে যখন কোনও আঘাত লাগে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় এবং যত দিন যায় সেই ব্যথা ধীরে ধীরে নিজে থেকেই কোনও ওষুধ ছাড়াই কমতে থাকে এর কারণ আমাদের দেহের মধ্যেই রয়েছে নিজস্ব প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। শরীরের নিজস্ব পেনকিলার যার নাম এন্ডোরফিন বা এন্ডোজেনাস মরফিন। অর্থাৎ শরীরের মধ্যে ক্যাপসাইসিনের মতোই একটা পদার্থ রয়েছে যা এই জ্বালা, যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে। কাজেই লঙ্কার মধ্যে যে ক্যাপসাইসিন রয়েছে সেটাকে গ্রহণ করার রিসেপটর রয়েছে শরীরে। আর রিসেপটর মানেই হল যত দেবে তত নেবে ফলে আমাদের শরীরে লঙ্কা সহজে গৃহীত হয় এবং লঙ্কা যাঁরা খান তাঁদের অভ্যেস বাড়তে থাকে। এতে ক্ষতি নেই বরং কিছুটা পরিমাণে লঙ্কা নিয়মিত খাওয়া খুব উপকারী।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে লঙ্কা মাথার যন্ত্রণায়, ঠান্ডা লাগলে খুব উপকারী।
লঙ্কা অ্যাসিডিটি থেকে বাঁচাতে খুব কার্যকরী। নিয়মিত লঙ্কা খেলে শরীর পেন রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। সর্দি কাশি হলে সবাইকে বলতে শোনা যায় ঝাল-ঝাল কিছু খেলে মুখে ভাল লাগবে। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ঝালে ওই সর্দি-কাশি, অরুচিজনিত কষ্ট কমে।
ঝাল খেলে আমাদের ফুসফুস নালি, গোটা পালমোনারি সিস্টেমে খুব ভাল কাজ করে। এর ফলে সাইনাস, অ্যালার্জি জনিত হাঁচি-কাশি এগুলো কমে যায় অনেকটা।
লঙ্কার দুরকম প্রতিক্রিয়া রয়েছে— একটা অ্যাকিউট এবং অপরটা লং টার্ম। যাঁরা একদম লঙ্কা খান না তাঁরা লঙ্কা খেলেই পেট জ্বালা করবে, সমস্যায় পড়বেন কিন্তু যাঁরা লঙ্কা খান তাঁদের এর কোনওটাই হবে না। লঙ্কা খাওয়াটা একটা অভ্যেস এবং এই অভ্যেস যত থাকবে মানবদেহের উপকার।
লঙ্কা খাওয়ার আর একটা বড় সুফল হল কোলেস্টেরল একদম হতে দেয় না। ওজন কমিয়ে দেয় বা দেহে মেদ জমতে দেয় না। এমনটা একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যাঁরা অনেক লঙ্কা খান তাঁরা বেশিরভাগ খুব রোগা হয়।
লঙ্কা হল থার্মোরেগুলেটরি— শরীরের গরম, ঠান্ডাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যোগী পুরুষেরা পাহাড়-পর্বতে থাকেন তাঁরা শরীর গরম রাখতে প্রচুর লঙ্কা খান। আবার মরুভূমির মানুষ শরীর ঠান্ডা রাখতে লঙ্কা খান!
তবে গুঁড়োলঙ্কা খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। কারণ এর কোনও খাদ্যগুণ নেই। টাটকা কাঁচালঙ্কা এবং লাললঙ্কা খাওয়ার অভ্যেস করা উপকারী। এতে শরীরে অনেক রোগের প্রকোপ কমে।
একটা কথা খুব শোনা যায়, লঙ্কা খেলে আলসার হয়৷ কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত সত্য হল সাধারণ মাপে কাঁচালঙ্কা সারাবছর খেলে আলসার সেরে যায়। হোমিওপ্যাথিতে আলসার সারানোর একটি ওষুধ রয়েছে যার কম্পাউন্ডে লঙ্কার নির্যাস দেওয়া হয়।
একফোঁটা লঙ্কার রস এককাপ গরমজলে মিশিয়ে গার্গেল করলে যে কোনও রকমের গলার অসুখ সারাতে সাহায্য করে। লঙ্কাকে বিষাক্ত কীটের বিষের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শ্রীলঙ্কার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ওখানকার লঙ্কা পেশাইকারী শ্রমিকদের ফুসফুসের অবস্থা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক সতেজ এবং রোগমুক্ত। সাধারণের তুলনায় এঁদের সর্দিকাশি, হাঁপানি অনেক কম। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে ক্যাপসাইসিন ফুসফুসকে ভাল রাখে।
প্রসঙ্গত একটি উক্তিতে এই পর্বের শেষ করা যায়। স্বামী বিবেকানন্দ লঙ্কা ছাড়া (Condiments) খাদ্যগ্রহণ করতেন না। হরিপদ মিশ্র একবার স্বামীজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘স্বামীজি এত লঙ্কা খান কেন?’ উওরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘পথচারী সন্ন্যাসীদের পেটে কত দূষিত জল যায়, তার দোষ কাটাতে এই লঙ্কার ঔষধ। অন্য সাধুরা গাঁজা চরসে যে কাজ করে আমি তা করি লঙ্কা দিয়ে।’’ (‘সহাস্য বিবেকানন্দ’ থেকে উদ্ধৃত)