১০ এপ্রিল থেকেই মহাসমারোহে শুরু হয়ে গেছে কোভিড (Covid) প্রতিরোধের সতর্কতামূলক বুস্টার ডোজ প্রদান। আগের দুটো টিকার সঙ্গে এবারের এই বুস্টার টিকার ফারাক রয়েছে। আগে সরকার বিনি পয়াসায় এই টিকা প্রদান করত যা দেওয়া হত সরকারি হাসপাতাল আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালেও সে-টিকা দেওয়া হত বটে তবে নাগরিকদের সেখানে টিকা নিতে বাধ্য হতে হত না। আর এবারের বুস্টারের ক্ষেত্রে সরকার গোড়াতেই দায় নেওয়ার ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে ফেলেছে। চালু হয়েছে সম্পূর্ণত নগদ-বিদায়ের মাধ্যমে টিকা নেওয়া; একেবারেই ফেলো কড়ি মাখো তেল। টাকা গুনলে তবেই মিলবে টিকা!
টিকা নিয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, একটি টিকা নিলেই সারা জীবনের মতো রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যে মুক্তি মিলবে তা কিন্তু নয়। জীবাণু তার চরিত্র বদলাবে আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাতে হবে প্রতিরোধী ব্যবস্থা। “হার্ড ইমিউনিটি” তৈরির মাধ্যমেই হয়তো মিলতে পারে মুক্তি। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে বলেই কমেছে কোভিড আক্রান্ত রোগী, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। নতুন নতুন ভাইরাস আসার খবর খবরের কাগজে মিলছে। অনেকে ভয় পাচ্ছেন। হয়তো ভয় কিছুটা দেখানোও হচ্ছে। সে যা-ই হোক, সতর্ক থাকাটাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
সত্যি কথা বলতে কী, কোভিডের (Covid) মতো অতিমারির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে লড়াইটা লড়তে হবে অন্যভাবে। সাম্প্রতিক অতিমারি “অতীত” হয়ে গেলেও ভবিষ্যতের জন্য তা যে শিক্ষা দিয়ে গেল তা কি আমরা নিলাম? প্রথমেই বলি, কোভিড মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও গ্রহণ করা হয়েছিল লকডাউন নীতি। এর লক্ষ্য ছিল কিছুটা সময় বের করে নেওয়া যাতে রোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। লকডাউনের উদ্দেশ্য ছিল গণ-সংক্রমণকে আটকে দেওয়া। যদি একসঙ্গে বহু বহু লোক এই রোগের শিকার হতেন তবে কোনওভাবেই তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত না। আর সেজন্য অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য কিছুটা সময়-সুযোগ বের করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। অবশ্য সবটা যে তাঁদের হাতে ছিল তা নয়। কাজের আসল কারিগর সরকারি নীতিপ্রণেতা ও তা কার্যকর করার কুশীলবেরা। তাঁদের জন্য এই অতিমারি একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেল ভাবী কালের জন্য। কিন্তু তাঁরা সবাই তা শুনলেন কি? উত্তরপ্রদেশে আর যাতে গঙ্গায় লাশ না ভাসে, তা নিশ্চিত করা গেল কি?
আরও পড়ুন: বড়পর্দায় দ্য একেন
এই অতিমারির সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আজও রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের প্রধান সহায় সরকারি হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে ভয় দেখিয়ে, মিথ্যে কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল করেছে সেখানে সরকারি হাসপাতাল বিনা খরচে যুগিয়েছে উপযুক্ত চিকিৎসা আর পথ্য। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলো সীমিত সামর্থ্যে রোগমুক্ত করেছে লক্ষ লক্ষ রোগীকে, আশ্বস্ত করেছে রোগী আর তাঁর নিকটজনকে। কাজেই যদি এই অতিমারি থেকে শিক্ষা নিতেই হয় তবে আরও জোর দিতে হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকাশে; হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে। বাড়াতে হবে এই খাতে ব্যয়বরাদ্দ। অথচ এই জরুরি কাজে অবহেলা করে গত কয়েক দশক ধরে দেশের নানান প্রান্তে বাড়ানো হয়েছে বিমানির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থা। দেশের নানা প্রান্তে বেসরকারি বিমা কোম্পানি আর অসৎ বেসরকারি হাসপাতালের দুষ্টচক্রে পড়ে শুধু যে সাধারণ মানুষ হয়রান হচ্ছেন তা নয়— সাধারণ মানুষ ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালের বৈভবে মোহিত হয়ে ভিড় জমাচ্ছেন সেখানে। আগে তাঁদের সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। এখন স্বাস্থ্যবিমা তাঁদের কাছে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। আর এখানেই শোষণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু স্বাস্থ্যব্যবসায়ী। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাই শুধু নয়, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও চলছে। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তে এরকম হরেক বেনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। অতিমারির সময় এই দুর্নীতি আরও বে-আব্রু হয়ে গিয়েছে।
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকাশের বিষয়টি মোটেই কথার কথা নয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা যে সরকারেরই দায়, তার স্বীকৃতি মিলেছে। নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব, যেমনটা নিয়েছে নরওয়ে (১৯১২), সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৩৭, তবে গ্রামাঞ্চলে ১৯৬৯), নিউজিল্যান্ড (১৯৩৮), জার্মানি (১৯৪১), ব্রিটেন (১৯৪৮), চিন (১৯৫০), কিউবা (১৯৬০), শ্রীলঙ্কা (২০০০), পেরু (২০০৯)-সহ বিভিন্ন দেশ। বিরাট জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষেও এই কাজটা সম্ভব। কীভাবে সম্ভব সেটা শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বে ২০১০ সালে গঠিত ভারত সরকারের উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা ২০১১ সালে প্রকাশিত এই কমিটির রিপোর্টকেই হাতিয়ার করেছেন।
কাজেই হাল ফেরাতে হবে জনস্বাস্থ্যের। শেষে যে-কথা বলার তা হল, স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য হল অধিকার। পশ্চিমবঙ্গে সে-কথাটা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভারতের বাকি অংশে? সমস্যাটা সেখানেই।