দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতির মদতদাতা তথাকথিত প্রগতিশীল বামপন্থী (CPIM) নেতা-উপনেতারা আজকাল বড় বড় চোখ করে গম্ভীর মুখে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে টিভি চ্যানেলে বসে বিষোদ্গার করে চলেছেন। ভাবটা এমন যেন, নিজেরা (CPIM) সব ধোয়া তুলসীপাতা। সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য হাজির থাকছেন কয়েকজন কালো কোট পরিহিত মান্যবর উকিলবাবু। কিন্তু এই মান্যবর ব্যক্তিদের সাধের দলের কিছু কীর্তিকলাপ আজ বড্ড মনে পড়ছে। তথ্যগুলি যদি ভুল হয় আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইব।
এক-এক করে আসা যাক—
শ্রী পার্থপ্রতিম পাল (বাণিজ্য বিভাগ) ১৯৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ সার্ভিস কমিশন পরিচালিত মৌখিক পরীক্ষায় তালিকাভুক্ত হন। তখনও লিখিত পরীক্ষা চালু হয়নি। তিনি প্রায় ৯ বছর পর নিয়োগপত্র পান এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বঙ্কিম সর্দার কলেজে চাকরি পান (২০-০৪-১৯৯৬)। অথচ পশ্চিমবঙ্গ কলেজ সার্ভিস কমিশনের বিধির (Regulations), ১৯৮০-এর ৮(৩) ধারা অনুসারে প্যানেলের আয়ু ১২ মাস। তা হলে ৯ বছর একটা প্যানেলের অস্তিত্ব কী করে থাকে? ১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান নিত্যানন্দ সাহা এক নির্দেশ জারি করেন যে ১৯৮৬, ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮-তে যে প্যানেল তৈরি হয়েছিল, সেই সমস্ত প্যানেল থেকে লেকচারার পদে (এখন বলা হয় ‘সহকারী অধ্যাপক’) নিয়োগ করা হবে। এই নির্দেশ কমিশনের বিধি বিরোধী। কেন এই ধরনের নির্দেশ দেওয়া হল? ১৯৯১-এর অক্টোবর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একটি নির্দেশে (মেমো নম্বর ১-১১/৮৭ (সিপিপি/পিএস) বলা হয়, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলি, সরকারি কলেজে লেকচারার পদে নিয়োগের যোগ্যতা হল স্নাতকোত্তর পদে ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ নম্বর প্রয়োজন এবং স্লেট (বর্তমান সেট) অথবা নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এর আগে স্নাতকোত্তর স্তরে ৫০ শতাংশ পেলেই চলত। লিখিত পরীক্ষা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে লিখিত পরীক্ষা অর্থাৎ স্লেট সম্ভবত ১৯৯৪ সালে প্রথম হয়েছিল। ১৯৮৬-’৮৮-র প্যানেলে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের একটা বড় অংশের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ৫৫ শতাংশের কম ছিল। একইসঙ্গে তাঁরা তৎকালীন শাসক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন অথবা দলদাস ছিলেন। পার্থপ্রতিম বাবু এইভাবেই চাকরি পেয়েছিলেন। অভিযোগ, তাঁর নিয়োগের জন্য কলেজ সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পত্রের কোনও রেকর্ড নেই এবং কমিশনের সুপারিশ যে গৃহীত হল এই মর্মে সংশ্লিষ্ট কলেজের পরিচালন সমিতির নিয়োগ-পর্বের পূর্বে কোনও প্রস্তাব নেই। কমিশন নিয়োগ করে না, সুপারিশ করে। নিয়োগ করে কলেজ। কলেজের পরিচালন সমিতি কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ সংক্রান্ত প্রস্তাব নেওয়ার পর অধ্যক্ষ নিয়োগ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে থাকেন। পার্থবাবুর বঙ্কিম সর্দার কলেজে যোগদানের বেশ কিছু কাল পরে পরিচালন সমিতি তাঁর নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করে, যেটি সম্পূর্ণ বেআইনি। তিনি তখন বড় নেতা। পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদক। এই সংগঠনটি প্রায় পুরোটাই সিপিএম নিয়ন্ত্রিত ছিল। শোনা যায়, একইভাবে চাকরি পেয়েছিলেন বর্তমানে মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া কলেজের অধ্যক্ষ স্বপনকুমার মিশ্র। ১৯৯৫-তে তিনি শ্যামপুর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৬ বা ১৯৮৭ সালের প্যানেলভুক্ত ছিলেন। একই বছরে যোগ দিলেন প্রাঞ্জল চক্রবর্তী নেতাজিনগর ডে কলেজে। ওই সময়ের প্যানেলভুক্ত। একটু খোঁজ নিলে এবং তদন্ত হলে স্পষ্ট হবে, ১৯৯৪-তে নিত্যানন্দ সাহার নজিরবিহীন নির্দেশের পর ১৯৮০-র দশকের প্যানেলে নথিভুক্ত যে-সমস্ত মান্যবর ব্যক্তির কলেজে চাকরি হয়েছে তাঁদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কত শতাংশ প্রাপ্ত নম্বর ছিল এবং তাঁদের রাজনৈতিক পটভূমি কী ছিল? পুরো ব্যাপারটা আলিমুদ্দিনের নেতৃবৃন্দ নিপুণভাবে পরিচালনা করেছিলেন, ঠিক যেমনভাবে তাঁরা ভোটের সময় ‘বৈজ্ঞানিক রিগিং’ করতেন।
আরও পড়ুন-মোদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব পাহাড়
অপরদিকে দেখুন, কৌশিক মল্লিক নামে প্যানেলভুক্ত জনৈক প্রার্থী ২০১০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন, তাঁর পরে নিচে প্যানেলভুক্ত অনেকে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে কোনও কলেজে চাকরি জোটেনি। প্যানেলটি ২০০০-এর ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল। কলেজ সার্ভিস কমিশনের বক্তব্য ছিল, মেধা তালিকা প্রকাশের পর প্রায় ১০ বছর চলে গিয়েছে। তালিকাটি এক বছরের বেশি কার্যকরী থাকে না। মহামান্য হাইকোর্ট কমিশনের বক্তব্য মেনে নিয়েছিল এবং মামলাটি খারিজ হয়ে গেল। তা হলে ১৯৮৬-১৯৮৮ এই সময়ে যে মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, ৮/৯ বছর পর সেই তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের কীভাবে চাকরি দেওয়া হল? নিশ্চয়ই সিপিএম নেতৃত্বের নির্দেশে ধামাধরা চেয়ারম্যান নিত্যানন্দবাবু উল্লিখিত বেআইনি নির্দেশ জারি করেছিলেন। কৌশিকের দুর্ভাগ্য, তিনি তৎকালীন শাসক দলের তল্পিবাহক হতে পারেননি। একইসঙ্গে কয়েকটি মামলায় মেধা তালিকার নিচের দিকে থাকা তুলনামূলক ভাবে কম যোগ্য প্রার্থীদের অধ্যাপনার কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল তালিকার উপরের দিকে থাকা অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করার ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্ট তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। শুনেছি, হাইকোর্টের নির্দেশে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছিলেন। অবশ্য লক্ষণীয়, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে মেধা তালিকায় নিচে থাকা যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, মাননীয় বিচারকেরা তাঁদের চাকরি বাতিল করেননি। বিচারপতিরা সঙ্গতভাবেই ভেবেছিলেন, সেইক্ষেত্রে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। যতদূর জেনেছি, মামলার নম্বরগুলি হল— ১২১৭৮(W)/৯৫, ৪৯৪৯ (W) ৯৫, ১০০৩৮ (W) ৯৫, ১০৯২০ (W) ৯৫ এবং ১৩৬৭৩ (W) ৯৫।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সিপিএমের (CPIM) দুর্নীতির আরও কিছু তথ্য পরবর্তী কোনও প্রবন্ধে প্রকাশের ইচ্ছা রইল। কাউকে আঘাত দেওয়া বা অসম্মান করা উদ্দেশ্য নয়। সিপিএমের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেওয়াই উদ্দেশ্য। আমার দেওয়া তথ্যে কোনও ভ্রান্তি থাকলে আমি সংশোধিত হব।