নির্মাণ আর উন্নয়ন ছিল তাঁর মূল মন্ত্র

পরবর্তীতে বামেরা যে বাংলার সর্বনাশ করে ছেড়েছিল, সেই বাংলার আদি রূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তাঁরই ব্যাটন আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য হাতে। লিখছেন অধ্যাপক ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

কিংবদন্তির কিংবদন্তি চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রবাদপ্রতিম প্রশাসক ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় (Dr. Bidhan Chandra Roy) ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের এক তারিখে পাটনায় এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রকাশচন্দ্র রায় সরকারি কর্মচারী ছিলেন। মা অঘোরকামিনী দেবী ধর্মপ্রাণা ও সেবাপরায়ণা মহিলা ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ডক্টর রায় কনিষ্ঠতম ছিলেন। বর্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্বন্ধে বেশি কিছু জানে বলে মনে হয় না। সম্ভবত এইটুকুই জানে, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং বড় চিকিৎসক ছিলেন। এই স্বল্প পরিসরে তাঁর সম্পর্কে, তাঁর জীবনসংগ্রাম সম্পর্কে কিছু কথা লিখছি।

তাঁর বিদ্যালয় শিক্ষা পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯০৯ সালে এমবিবিএস হন। আর্থিক কষ্টের মধ্যে তাঁকে ডাক্তারি পড়ার খরচ চালাতে হয়েছিল। অর্থ রোজগারের জন্য তাঁকে নার্সের কাজ ও ডোমের কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। পরে তিনি বলেছিলেন, মৃতদেহ হল একজন ডাক্তারি ছাত্রের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ১৯০৯-এ চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে ভর্তির ক্ষেত্রে তাঁকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয় এবং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তির সুযোগ পান। লন্ডনে সকলকে অবাক করে দিয়ে দু’বছরের মধ্যে একই সঙ্গে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করেন, যেটা দুর্লভ। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে ডক্টর রায় ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে (যেটি এখন এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ) অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং প্রথম ভারতীয় যিনি ‘প্রফেসর’ পদমর্যাদার শিক্ষক ছিলেন। ইতিমধ্যে প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সুনাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য, তিনি রোগীকে এক মুহূর্তের জন্য দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারতেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন।

ইতিমধ্যে গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব, জীবনধারা এবং অহিংস আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ডক্টর রায় (Dr. Bidhan Chandra Roy) কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলার আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত কলকাতার মহানাগরিকের দায়িত্ব পালন করেন। মহানাগরিক হিসাবে তিনি নগর উন্নয়নের বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল, শহরের জল সরবরাহ ব্যবস্থার প্রসার হয়েছিল এবং শিক্ষার বিস্তার হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮-এ তিনি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু (১৯৬২) তিনি এই পদে সসম্মানে বহাল ছিলেন। বিধানচন্দ্র রায়কে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বলা হয়। এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ডক্টর রায়ের বিশেষ সহকারী সরোজ চক্রবর্তী লিখছেন, যখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেন, চিকিৎসক হিসাবে তাঁর মাসিক গড় আয় ছিল ৪২০০০ টাকা (এখন মূল্য কত সহজেই অনুমেয়)। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি নিজের মাসিক বেতন ঠিক করলেন ১৪০০ টাকা। তাঁর চেম্বারের সহকারীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তান্বিত হলেন, কারণ সাহেব তো আর অর্থের বিনিময়ে রোগী দেখতে পারবেন না (যদিও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রতিদিন বিনা পয়সায় রোগী দেখতেন।) ডক্টর রায় আশ্বস্ত করলেন তাঁরা যেমন আছেন, তেমনই থাকবেন (My Years with Dr. B. C. Roy, পৃষ্ঠা ১০)। অন্য একটি সূত্র থেকে জেনেছি, সেই সময় খরচ চালানোর জন্য নিজের আয়ে অর্জিত বেশকিছু সম্পত্তি তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- চিকিৎসকদের জন্যই ১৩ বছরে বাংলায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপ্লব, Doctor’s Day-তে মুখ্যমন্ত্রী

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ডক্টর রায়ের সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, ১৯৪৭-এ দুর্ভাগ্যজনক বাংলা ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আগত ভিটেমাটি হারা লক্ষ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসনের ও রোজগারের বন্দোবস্ত করা। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর তৈরি হল। বাস্তুহারা যুবক-যুবতীদের চাকরি দেবার উদ্দেশ্যেই ‘কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম’ নামে নতুন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হল। প্রয়োজন না থাকলেও সরকারি অফিসে অনেক নতুন পদ সৃষ্টি করা হল। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা, দুর্গাপুর শিল্পনগরী এবং খড়্গপুর আইআইটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডক্টর রায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কলকাতার উপর জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য শহরের উপকণ্ঠে লবণহ্রদে (বর্তমান বিধাননগর) এবং কিছুটা দূরে কল্যাণীতে উপনগরী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। এই দুটি শহর উন্নতমানের পরিকল্পিত আবাসস্থল ও বাণিজ্য নগরিতে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসক হিসাবে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগ যাদবপুরে এবং উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচড়াপাড়ায় টিবি হাসপাতাল চালু হল। চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের পরিকাঠামো আরও শক্তিশালী করা হল। ১৯৪৭-এ বিভিন্ন জেলা ও মহকুমাতে ৭০টি চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। ১৯৫৬-তে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭১, শয্যাসংখ্যা ২৭৬২। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৬টি জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সংখ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হাজরায় চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। বিধানচন্দ্র রায়ের সময় সমগ্র ভারতবর্ষে ১০০০ জনসংখ্যা পিছু হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক ছিল। পোলিও রোগ নিবারণের জন্য ডক্টর রায় সরকারি অনুদান ছাড়া ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রথম পোলিও হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, যেটি উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু। বর্তমানে এটি ‘বি সি রায় পোলিও ক্লিনিক’ হিসাবে পরিচিত। ‘ভারতরত্ন’ প্রাপক বাংলা তথা ভারতের এই মহান সন্তান ১৯৬২-এর ১ জুলাই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। তাঁর জন্মদিনটিকে (মৃত্যুদিনও একই) সারা দেশে ‘চিকিৎসক দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।

ডক্টর রায়ের (Dr. Bidhan Chandra Roy) পর অনেক মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন-গিয়েছেন। সকলেই মান্যবর ও শ্রদ্ধেয়। তবুও এ-কথা বলতে কোনও সংকোচ নেই, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মতো জনপ্রিয় ও দৃঢ়সংকল্পময়ী ব্যক্তিত্ব আর কেউ আসেননি। জীবন-মৃত্যুর পরোয়া না করে স্নেহের মমতা তিন দশকের বেশি সময় ধরে আপসহীন লড়াই করে জগদ্দল পাথরকে রাজ্যের মসনদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। তারপর প্রশাসনকে জনমুখী করবার কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বামফ্রন্ট আমলে ভেঙে পড়া সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল স্তরের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের পর্যাপ্ত সুবিধা হয়েছে। নিছক লোহা, কয়লা প্রভৃতি উৎপাদনের পরিমাণ, সমৃদ্ধ নগর ও শপিং মলের সংখ্যার উপর দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি নির্ভর করে না। সমাজের প্রান্তিক মানুষ জীবন ধারণের ন্যূনতম সুবিধা পাচ্ছেন কি না, তার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। এই সহজ, অথচ বাস্তব সত্যটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় উপলব্ধি করেছেন। এখানেই অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর তফাত।

Latest article