আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাড়ি থেকে কর্মস্থল, প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষের সর্বাধিক চাহিদার মধ্যে পড়ে নিরাপত্তা। শেষ কয়েক দশকে কর্মসংস্থানের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে শহর বা শহরতলির অফিসগুলির কর্মিসংখ্যা, পরিকাঠামো ও আধুনিকতার মাত্রা বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে ফায়ার অ্যান্ড সেফটি (Fire and Safety Course) নিয়ে পড়াশুনা ও ট্রেনিং নেওয়া থাকলে এই পেশায় সাফল্যের সুযোগ খুবই।
একটি দফতরের নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সঙ্গে রয়েছে অত্যাধুনিক মানের যন্ত্রাদির ব্যবহারও। অতীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফায়ার সেফটির জন্য অফিস তথা কোম্পানিগুলিতে নিজস্ব কর্মী বা সাধারণ নিরাপত্তারক্ষীদের উপরেই ভরসা রাখা হত। তবে সাম্প্রতিককালে অফিস ও বিল্ডিং-কনস্ট্রাকশনগুলির নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য নেওয়া হয়েছে সেফটি ম্যানেজার, ফায়ার সেফটি (Fire and Safety Course) ওয়ার্কারদের।
স্বীকৃত ও উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান থেকে কোর্স এবং হাতেকলমে ট্রেনিং নিয়ে এই পেশার জগতে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। ফায়ার অ্যান্ড সেফটি কোর্স ছাড়াও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি, কনস্ট্রাকশনাল সেফটি ম্যানেজমেন্ট কোর্সের মাধ্যমে এই পেশায় আসা যায়। কর্পোরেট অফিস ছাড়াও, শিল্পাঞ্চলগুলিতে অত্যাধুনিক মানের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সর্বত্র। সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ এবং দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য বাড়ছে কাজের সুযোগ।
ফায়ার অ্যান্ড সেফটি কী?
কর্মস্থল, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, প্রোডাকশন এলাকা, কর্পোরেট বিল্ডিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপণ এবং অন্যান্য দুর্ঘটনা প্রবণতাকে দূর করার জন্য ফায়ার অ্যান্ড সেফটি বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষিত অর্থাৎ দক্ষ কর্মীদের প্রয়োজন। ফায়ার অ্যান্ড সেফটির ব্যাপারে উন্নতমানের নির্বাপক বা সিকিউরিটি সিস্টেম তৈরি থেকে শুরু করে বিপর্যয় মোকাবিলার সময় নিরাপত্তাপ্রদান সবকিছুই রয়েছে এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে। ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনার পর যেরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্বাপক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব, তেমনিই ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করে আফিস-কাছারি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে উন্নতমানের সেফটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করার জন্য সচেষ্ট থাকা যায়।
কী ধরনের কোর্স (Fire and Safety Course)?
ফায়ার অ্যান্ড সেফটি নিয়ে দু’রকমভাবে পড়াশুনা করা যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে যাওয়ার জন্য ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাইরে ম্যানেজমেন্ট কোর্সও করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিষয় নিয়ে ডিপ্লোমা বা পিজি ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। বেশ কিছু স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিষয় নিয়ে বিএসসি ডিগ্রিও করানো হয়ে থাকে। ডিপ্লোমা বা পিজি ডিপ্লোমা কোর্সগুলি মূলত এক বছরের হয়ে থাকে। ম্যানেজমেন্ট কোর্স হলে দু বছরের জন্য এবং ডিগ্রি হলে তিন বছরের হয়ে থাকে। এই কোর্সের মতোই ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি, কনস্ট্রাকশন সেফটি কোর্সও করানো হয়ে থাকে অনেক প্রতিষ্ঠানে।
আরও পড়ুন: দুর্নীতিমুক্ত পৌষমেলার দাবিতে চিঠি দিল ব্যবসায়ীদের সংগঠন
যোগ্যতা কেমন লাগে?
১০+২ যোগ্যতার পর ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি-ডিপ্লোমা কোর্সে পড়াশুনা করা যায়। ওই একই যোগ্যতাতেই অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্সও করা যেতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি কোর্সে ভর্তির যুগ্মপ্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ফায়ার আ্যন্ড সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করা যাবে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এবং অঙ্ক নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর এই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে বিই কোর্সে ভর্তি করা হয়। এই পেশায় শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি দৈহিক গঠন ও মনোবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কোর্সের জন্য ১৬৫ সেমি উচ্চতা, ৫০ কেজি ওজন, ৮১ সেমি বুকের ছাতি (ফুলিয়ে ৮৬ সেমি) দৃষ্টিশক্তি ৬/৬ থাকলে সুবিধা পাওয়া যায়। অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পরিবেশে কাজ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বিপদ-বিপর্যয়ের সময় অসংখ্য মানুষ নির্ভর করেন ফায়ার ও সেফটি ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্যের উপর। স্বাভাবিকভাবেই, অত্যন্ত দায়িত্ববোধ সহকারে কৌশল ও বুদ্ধি ব্যবহার করে শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং ঠান্ডা মানসিকতার সঙ্গে কাজ করবার প্রয়োজন রয়েছে।
কোথায় পড়া যেতে পারে?
কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজমেন্ট, ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ স্কোয়্যার, সেন্ট্রাল লেবার ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান এবং নানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ের উপর ডিপ্লোমা বা পিজি ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। এ-ছাড়াও কিছু ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউশনে এই বিষয়গুলির উপর ম্যানেজমেন্ট কোর্স করানো হয়। ট্যামকেনে সেফটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট— পূর্ব মেদিনীপুর এবং কিছু-কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬ মাসের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বা ফায়ার সেফটি ম্যানেজমেন্টের সার্টিফিকেট কোর্সও করানো হয়। ফায়ার সেফটি অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের উপর একটি পিজি ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয় ইগনু থেকেও। ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং (দিল্লি)-এর মতো কলেজও রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সহযোগে বিভিন্ন অফিস, কমার্শিয়াল হাউস, নার্সিংহোম, প্রোজেক্ট এরিয়াতে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয় এরকম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে।
কী ধরনের কাজ?
ফায়ার আ্যন্ড সেফটি কোর্সের মাধ্যমে ইভ্যাকুয়েশন প্ল্যান, কমব্যাটিং ফায়ারস, ফায়ার রিলেটেড ইনজুরিস, কনস্ট্রাকশন অ্যাক্টিভিটিজ, কনস্ট্রাকশন অ্যাক্সিডেন্ট, প্রোটেকশন প্রসিডিওর, অ্যাক্সিডেন্ট রিপোর্টিং, টুলস অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট ইউজ, মেশিন গার্ডিং, এমারজেন্সি অ্যাকশন, ফার্স্ট এড প্রোগ্রাম প্রভৃতি কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেওয়া হয়। ফায়ার সেফটি ম্যানেজার, ফায়ারম্যান, সেফটি অফিসার, সেফটি ইনস্ট্রাক্টর, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট, ডিজাস্টার সেফটি ম্যানেজার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি ম্যানেজার ইত্যাদি নানা পদে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করে থাকলে ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার বা অফিসার বা সুপারভাইজার পদে কাজ করা যাবে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানের ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি এবং পরিচালনা করতে হয়। এই সিস্টেমের অধীনে নিরাপত্তাকর্মীরা দলগতভাবে কাজ করে থাকেন। শহর বা শহরতলির অফিস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে শিফটিং ডিউটি সিস্টেমে কাজ বেছে নেওয়া যায়। সেফটি সিস্টেম বা ইলেক্ট্রনিক্স ইকুইপমেন্ট রক্ষণাবক্ষেণের কাজেও এই সমস্ত কর্মীদের নিয়োগ করা হয়।
পেশায় সুযোগ কেমন?
শহর এবং শহরতলিতে অফিস, বহুতল অট্টালিকা, শপিং মল ইত্যাদি বৃদ্ধির শতকরা হার বছর-বছর বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে নিরাপত্তার চাহিদাও। বেশিরভাগ কর্পোরেট অফিস, নির্মাণ সংস্থা, হাসপাতাল, প্রতিরক্ষাসংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই পেশার চাহিদাও। সেফটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেফটি ইনস্পেক্টর বা সেফটি ম্যানেজার রাখা বাধ্যতামূলক। যার কারণে নিশ্চিতভাবে তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানের পথ। পুরানো সরঞ্জামের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রাদি দিয়েও প্রশিক্ষণ কোর্স করানো হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলিতে। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে উন্নতমানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। ভারতের প্রথম সারির কোম্পানিগুলিতেও কাজের সুযোগ রয়েছে। সেইল, টিসকো, কোল ইন্ডিয়া, ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের মতো কোম্পানিগুলিও এই সমস্ত পদে নিয়োগ করে থাকে।