গভীর রাত। গ্রিফিন্ডর হাউজে সবাই ঘুমোচ্ছে, কেয়ারটেকার আর্গাস ফিলচ আর তার পোষা বিড়াল মিসেস নরিস ছাড়া গোটা স্কুলচত্বরে কেউ জেগে কি না সন্দেহ। তবু সাবধানের মার নেই, তাই সদ্য উপহার পাওয়া ‘ইনভিজিবিলিটি ক্লোক’ গায়ে জড়িয়ে নেয় এগারো বছর বয়সি ছেলেটা। বন্ধু রন-কে ডাকে না ইচ্ছে করেই, পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় কয়েক রাত আগে খুঁজে পাওয়া আয়নাটার কাছে। অদ্ভুত সেই আয়না, কিন্তু ওর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। আয়নার সামনে ও এসে দাঁড়িয়েছে একটাই উদ্দেশ্যে—মৃত বাবা- মাকে দু’চোখ ভরে দেখবে বলে। যাদের শৈশবেই হারিয়েছে ও, যাদের মুখগুলো পর্যন্ত মনে করতে পারে না ঠিকমতো, সেই জেমস আর লিলি পটার-কে আয়নায় নিজের দু’পাশে দেখতে পায় ছেলেটা। এই দৃশ্য ওর কাছে নেশার মতো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।
সম্পূর্ণ অলীক, অথচ প্রচণ্ডভাবে কাঙ্ক্ষিত সেই প্রতিবিম্বের মায়ায় ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে ছেলেটা, এমনসময় পেছন থেকে কারওর গলা শোনে ও। ফিরে দেখে, স্কুলের হেডমাস্টার অ্যালবাস ডাম্বলডোর এসে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। অত রাতে হ্যারি-কে (Harry Potter) বাইরে দেখেও উত্তেজিত হন না তিনি, বরং শান্তভাবে উচ্চারণ করেন সাবধানবাণী। যে জাদু আয়নার আহ্বানে ধরা দিয়েছে ছেলেটা তার নাম ‘মিরর অফ এরিসেদ’, যে এর সামনে দাঁড়ায় তার হৃদয়ের তীব্রতম চাহিদা, গভীরতম ইচ্ছেকে প্রতিবিম্ব আকারে ফুটিয়ে তোলাটাই এর ধর্ম। আর সেকারণেই এই আয়না অতি বিপজ্জনক। সে যা দেখছে তা আদতেই মরীচিকা—এই বোধ একসময় হারিয়ে ফেলে দর্শক, যুক্তি-বুদ্ধি খুইয়ে উন্মাদ হয়ে পড়ে অচিরেই। অসম্ভবকে পেতে বদ্ধপরিকর কত মানুষের জীবন যে এরিসেদ-এর আয়নার জন্য নষ্ট হয়েছে, তার খতিয়ান দিতে দিতে বিষণ্ণ হয়ে আসে ডাম্বলডোর-এর গলা।
সেই মুহূর্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় ছেলেটার কাছে। ও বোঝে, এরিসেদ-এর আয়না এক মোহফাঁদ। নিশ্চিন্ত হই আমরাও; এই নিশিডাক অবশ্যই জয় করবে ছেলেটা, নায়কোচিত ভাবে বেরিয়ে আসবে এরিসেদ-এর অজগরী মায়া কাটিয়ে। ও যে সাধারণ কেউ নয়, হ্যারি পটার—‘দ্য বয় হু লিভড’ (Harry Potter)।
১৯৯৭ সালের ২৬ জুন, এক অনামা ব্রিটিশ মহিলা জোয়ান রোওলিং-এর ছোটদের ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোজফারস স্টোন’ প্রকাশিত হল ইংল্যান্ডের ছোটমাপের প্রকাশনা সংস্থা ‘ব্লুমসবেরি’ থেকে। তারপর যা ঘটল, তাকে ম্যাজিক ছাড়া আর কীই বা বলা যায়? ‘বয় উইজার্ড’ হ্যারি-র কাহিনি দারুণভাবে দাগ কাটল শিশু-কিশোরদের মনে, অল্প সময়েই রোওলিং-এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ব্রিটেনজুড়ে। প্রশংসার ঝড় উঠল বড় সংবাদপত্রের রিভিউ কলামগুলোতে, সমালোচকরা একবাক্যে স্বীকার করলেন সি এস লিইউস-এর ‘ক্রনিকলস অফ নার্নিয়াঃ দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ড্রোব’-এর পর ছোটদের জন্য এত ভাল ফ্যান্টাসি ইংরেজি ভাষায় আসেনি। ‘নেস্টলে স্মার্টিজ বুক প্রাইজ’ পুরস্কারে ভূষিত হলেন রোওলিং। যে ‘ব্লুমসবেরি’ ‘ফিলোজফারস স্টোন’-এর জন্য মাত্র ২৫০০ পাউন্ড অগ্রিম দিয়েছিল লেখিকাকে, তারাই সিরিজের পরবর্তী বইয়ের বরাত পেতে বিশাল অঙ্কের সম্মানদক্ষিণার বিনিময়ে চুক্তি সই করল তাঁর সঙ্গে। এগিয়ে এল আমেরিকান পাবলিশিং প্রতিষ্ঠান ‘স্কলাস্টিক’, এক লক্ষ ডলার দিয়ে কিনে নিল বইটার বিদেশ স্বত্ব। পেছনে ফিরে তাকানো কাকে বলে, ভুলে গেলেন রোওলিং।
যাকে নিয়ে এত হইচই, সেই হ্যারি পটার (Harry Potter) আসলে কে? বইয়ের পাতা উল্টোলেই উত্তরটা পেয়ে যাই আমরা। রোগামতো একটা ছেলে, পরনে ঢিলেঢালা রংচটা পোশাক, মাথাভরতি এলোমেলো চুল, সেলোটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো গোল ফ্রেমের চশমার পেছনে একজোড়া উজ্জ্বল সবুজ চোখ। সিঁড়ির নিচের ঘুপচি একটা ঘরে থাকে ও, মাসি-মেসোর অনাদর, মাসতুতো ভাই ডাডলি-র অত্যাচার সহ্য করে দিন পার করে, আর মনে আশা রাখে, কোনও একদিন পরিস্থিতি পাল্টাবে। এগারোতম জন্মদিনে হ্যারি-র মনের ইচ্ছে পূর্ণতা পায়, দৈত্যাকার চেহারার এক আগন্তুক এসে চেনা জগতের ওপারে অন্য দুনিয়ার খোঁজ দেয় ওকে। বিস্ময়ের কোনও সীমা থাকে না হ্যারি-র (Harry Potter) যখন সেই আগন্তুক বলে ওঠে, ‘You’re a wizard, Harry!’
আরও পড়ুন: সংবিধান-বিরোধী বুলডোজার-তন্ত্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রতিরোধী-যন্ত্র
নাম্বার টুয়েলভ, প্রাইভেট ড্রাইভ-এর কয়েদখানা থেকে মুক্তি পাওয়া এগারো বছরের ছেলেটার খুশি বাঁধ মানল না যেন। নতুন ভোরের আলো গায়ে মেখে হ্যাগ্রিড-এর সঙ্গে পথে বেরোনোমাত্র লন্ডনের জাদুজগতের একেকটা দরজা খুলে যেতে লাগল ওর সামনে। ডায়াগন অ্যালি, গ্রিংগটস ব্যাঙ্ক, প্ল্যাটফর্ম নাইন অ্যান্ড থ্রি কোয়ার্টার্স, হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস—ম্যাজিক দুনিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হল হ্যারি, একইসঙ্গে মন থেকে ভালও বেসে ফেলল তাদের। হগওয়ার্টস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ডরি দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল অনাথ ছেলেটাকে।
লালচুলো, মিশুকে রন উইজলি, উঁচু দাঁতওয়ালা, সবজান্তা হাবভাব দেখানো হারমায়নি গ্রেঞ্জার, গোলগাল, ভিতুভিতু নেভিল লংবটম-এর সঙ্গে আলাপ হল ওর, বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগল না বিশেষ। হ্যাগ্রিড-এর পোষা ড্রাগন নরবার্ট, বিপদসংকুল ফরবিডন ফরেস্ট, কুইডিচ-এর মাঠে ‘গোল্ডেন স্নিচ’-এর হাতছানি ওকে ভুলিয়ে দিল ড্রেকো ম্যালফয়-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বদরাগী প্রোফেসর স্নেপ-এর অকারণ বকাঝকা। জীবনে প্রথমবার কোথাও নিজের স্থান খুঁজে পেল হ্যারি (Harry Potter), পেল সত্যিকারের আশ্রয়।
যে কোনও উপন্যাসের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে তার নায়কচরিত্রের ওপর। আর যদি তা হয় ফ্যান্টাসি উপন্যাস, তখন সেটা প্রধানত হয়ে ওঠে ‘হিরো’জ জার্নি’। বিশেষজ্ঞদের মতে, নায়কের অভিযানের তিনটে মূল পর্যায় থাকে—সেপারেশন অর্থাৎ বিচ্ছেদ, ইনিশিয়েশন অর্থাৎ আরম্ভ এবং রিটার্ন অর্থাৎ প্রত্যাবর্তন। এই তিনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ পর্যায় হল বিচ্ছেদ, যেখানে নায়কের সঙ্গে তাঁর এক বা একাধিক প্রিয়জনের সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে যায়। প্রথম শৈশবে বাবা মাকে আকস্মিকভাবে হারানো হ্যারি-র সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, আবার নিয়তিও বটে। শিশু হ্যারি-কে বাঁচাতে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন লিলি পটার, সন্তানকে মুড়ে দিয়েছিলেন এমন এক সুরক্ষা-বর্মে যাকে ভেদ করতে পারেনি ডার্ক লর্ড-এর মারণশাপ। এই রক্ষাকবচ এমন এক আশীর্বাদ যা হ্যারি-র (Harry Potter) পরবর্তী জীবনকে দিশা দিয়েছে, প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করেছে, একের পর এক কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে নায়ক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
‘ফিলোজফারস স্টোন’ উপন্যাসে খুদে পাঠকদের এক সুন্দর মায়াপৃথিবী উপহার দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি রোওলিং, আস্থা রেখেছেন ওদের শুভবোধ, মনের শুদ্ধতার ওপরেও। ছোটরা অবুঝ নয়, ভালমন্দের পার্থক্য জানে, বড়দের তুলনায় অপরিণত হলেও নিষ্কলুষ হৃদয়ের কথা শুনে সঠিক পথ বেছে নিতে ওদের অসুবিধে হয় না—এমনটাই রোওলিং-এর ভাবনা। আর সেকারণেই তাঁর কাহিনি অল্পবয়সিদের কাছে এতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। ভুল করেও সেই ভুলকে শুধরে নেওয়া, বন্ধুত্বকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া, ফলাফল যাই হোক না কেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়ানো— জীবনের সবচেয়ে দামি শিক্ষাগুলো কত সহজে আমাদের সামনে তুলে ধরে হগওয়ার্টস-এর কচিকাঁচারা। ম্যাকগোনাগল, স্নেপ, ফ্লিটউইক-এর মতো প্রাপ্তবয়স্ক, দক্ষ উইজার্ড-রা যার কথা অস্তিত্ব ঘুণাক্ষরেও টের পান না সেই ষড়যন্ত্রের মূল অবধি পৌঁছে যায় এগারো বছরের হ্যারি, রন, হারমায়নি। নিকোলাস ফ্ল্যামেল নির্মিত পরশপাথর লর্ড ভোল্ডেমর্ট-এর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাণপণ লড়াই করে ওরা, এবং সফল হয়। এই সাফল্য তারুণ্যের, এই সাফল্য আগামীর। হ্যারি-র জয় আবহমানকাল ধরে চলে আসা প্রথা, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া চিন্তাধারার বিরুদ্ধে আধুনিকমনস্কা লেখিকার প্রতিবাদ, চিরসবুজ, চিরনতুনের উদাত্ত জয়গান।
মানুষের মধ্যে শুভত্ব যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে পাপের বীজও। রোওলিং তাঁর পাঠকদের সাবধান করতে চেয়েছেন পাপের পরিণাম সম্বন্ধে, তাই লর্ড ভোল্ডেমর্ট-এর মতো অন্ধকার চরিত্রকে এঁকেছেন অনন্যভাবে। ‘ফিলোজফারস স্টোন’ বইয়ে ভোল্ডেমর্ট-কে প্রত্যক্ষভাবে পাই না আমরা, তবু তাঁর প্রভাব অস্বীকার করতে পারি না কোনওমতেই। পৃথিবীর কুখ্যাততম ডার্ক উইজার্ড— যার নাম অবধি নিতে ভয় পায় ম্যাজিক সমাজ, ‘হি হু মাস্ট নট বি নেমড’ বলে কেবল ইঙ্গিত দেয় তাঁর ভয়াবহতার প্রতি— তাঁর অতীতের কুকর্ম আমাদের আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে আতঙ্কের ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। তাছাড়া বইয়ে খলনায়ক হিসেবে আমরা পাই প্রোফেসর কুইরেল-কেও। শুরুতে নিরীহ গোবেচারা শিক্ষক হিসেবে সামনে আসা কুইরেল আসলে নিষ্ঠুর, বিবেকহীন, ধূর্ত; যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা চায় সে। তাই স্বেচ্ছায় প্রেতরূপী ভোল্ডেমর্ট-কে নিজের শরীরে ধারণ করে, ইউনিকর্ন-এর মতো নিষ্পাপ জীবকে হত্যা করে তার রক্ত পান করার আগে দু’বার ভাবে না। অন্ধকারের আনুগত্য মেনে নেওয়া কুইরেল যেন মানুষের চারিত্রিক অবনমনেরই মূর্ত প্রতীক, লোভের বশবর্তী হয়ে মানবতা কোন ঘৃণ্য পর্যায়ে নামতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
মানসিকতার দিক দিয়ে কুইরেল-এর একেবারে বিপরীতে অবস্থান হ্যারি-র। উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখি, হ্যারি-কে প্রলোভন দেখাচ্ছেন ভোল্ডেমর্ট, অর্থ ও প্রতিপত্তির বিনিময়ে আলোর পথ ছেড়ে আঁধারকে বেছে নিতে বলছেন। ‘There is no good or evil, there is only power and those too weak to seek it’ বলা ডার্ক লর্ড বোঝেন না, হ্যারি পরশপাথর পেতে চায় ঠিকই, কিন্তু নিজের জন্য নয়, সকলের ভালর জন্য। বৃহত্তর স্বার্থে আত্মবলিদান দিতে পিছপা হয় না ও। ঠিক যেমন পিছপা হয় না রন, নির্দ্বিধায় বিপদের মুখে এগিয়ে যেতে, পিছপা হয় না শৃঙ্খলপরায়ণা হারমায়নি, মানবিকতার আদর্শের স্থির থাকতে গিয়ে স্কুলের তুচ্ছ কয়েকটা নিয়ম ভাঙতে। এখানেই নিজেকে ছাপিয়ে যান রোওলিং; তাঁর খুদে পাঠকরা অবাক হয়ে দেখে, এরিসেদ-এর আয়নার সামনে আরেকবার দাঁড়ানোমাত্র আপনাআপনিই পরশপাথর এসে ধরা দিচ্ছে হ্যারি-র কাছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে ভালর পথে, আলোর পথে চলে, শেষ অবধি জয় তারই হয়—শিশু-কিশোরদের মনে আশ্বাসের এই বীজ বুনে দিয়েছেন রোওলিং, এজন্য আমাদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য।
হ্যারি পটার সিরিজের উপন্যাসগুলোতে খ্রিস্টান রূপকের ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু লেখা হয়েছে, আগামীতেও হবে। শিশুকিশোর সাহিত্যে ধর্মীয় উপদেশ আদৌ থাকা উচিত কি না, এই নিয়েও তর্ক বহুদিনের। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড ফিলোজফারস স্টোন’ রোওলিং-এর প্রথম বই বলেই হয়তো এখানে এজাতীয় রূপক প্রকট নয়, প্রচ্ছন্ন। কিন্তু বাইবেল-এর উৎসাহী পাঠকের কাছে তা ধরা দেয় অনায়াসে। খ্রিস্টান ধর্মমত অনুযায়ী ঈশ্বর এক হলেও তাঁর প্রকাশ তিনরূপে—দ্য ফাদার, দ্য সন এবং দ্য হোলি স্পিরিট। ‘হোলি ট্রিনিটি’-র এই তত্ত্ব ‘ফিলোজফারস স্টোন’-এও এনেছেন রোওলিং। জ্ঞানবৃদ্ধ, শ্বেতশুভ্র ডাম্বলডোর লেখিকার কল্পনায় ‘দ্য ফাদার’, আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক হ্যারি অবশ্যই যিশু খ্রিস্ট তথা ‘দ্য সন’। আর ‘হোলি স্পিরিট’? যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, যা সূক্ষ্মতম অথচ সর্বত্র বিরাজমান, সেই ভালবাসাই রোওলিং-এর উপন্যাসের ‘হোলি স্পিরিট’। বইটা পড়তে পড়তে ভালবাসার সেই মাহ্যাত্ম্য উপলব্ধি করে পাঠকও, পবিত্র ভালোবাসার নির্যাসটুকু সযত্নে ধারণ করে নেয় বুকের বাঁদিকে।
২৬ জুন ২০২২; অর্থাৎ পেরিয়ে গিয়েছে পঁচিশ বছর। সময়টা নেহাত কম নয়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরেছে নিজের নিয়মে, নব্বইয়ের দশকে যারা ছিল কিশোর-কিশোরী আজ তারা প্রাপ্তবয়স্ক-বয়স্কা। জীবনযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ফ্যান্টাসির নিয়মে নির্ধারিত হয় না, বাস্তবের রুক্ষ ময়দান কখনওই কল্পলোকের দেশ হয়ে উঠতে পারে না—এই সত্যিগুলো তাদের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। তবু দৈনন্দিন লড়াইয়ের ফাঁকে তারা হ্যারি পটার-এ ডুব দেয়, অফিস-সংসারের হাজার কাজের মাঝেও সময় বের করে ফিরে ফিরে যায় ম্যাজিক-এর কাছে। এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। ১৯৯৭ সালে যে বই আদর করে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জোয়ান রাওলিং, তা আক্ষরিক অর্থেই ছিল ‘ফিলোজফারস স্টোন’; এমন এক জাদুবস্তু যার সংস্পর্শে এসে লোহার মতো তুচ্ছ জিনিসও সোনা হয়ে যায়। আমরা সৌভাগ্যবান, সেই পরশপাথরের ছোঁয়া পেয়েছি, তাই আজও হ্যারি-র সঙ্গে একাত্ম আমরা। শুধু বইটা হাতে তুলে নেওয়ার অপেক্ষা, তারপরই ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়ি আমরা– সবকিছু ভুলে, মনের গহীন কোণে লুকোনো ইচ্ছেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে সওয়ার হই হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস-এ, ক্লোক আর ওয়ান্ড-কে সঙ্গী করে আরও একবার খুঁজে নিই জাদুস্কুলের অচিন ঠিকানা।