এই মুহূর্তে সারা কলকাতা কার্যত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন শূন্য। কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ড, তার মধ্যে ১০২টি আর্বান প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এবং ৫০টি মেগা সেন্টার যেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে কোভিড-প্রতিষেধক দেওয়া হয়, তার একটি সেন্টারেও কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নেই। মানুষ ফিরে যাচ্ছে টিকা নিতে এসে অসহায় অবস্থায়। ক’দিন আগে একই অবস্থা আমরা দেখেছি কো-ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও, সারা রাজ্যে তখন একটি ভায়ালও ছিল না। একই অবস্থা আজ কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন-জিতবে ত্রিপুরা: এবার ত্রিপুরার পরে তৃণমূল কংগ্রেসের নয়া স্লোগান
কিন্ত কেন এই অবস্থা?
সাম্প্রতিককালে লোকসভায় সরকারের কাছে সাংসদ মালা রায়ের লিখিত প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কোন রাজ্য কত ভ্যাকসিন পেয়েছে তা জানিয়েছেন। রাজ্যওয়ারি ভ্যাকসিন বণ্টনের হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এমনকী আমাদের থেকে অনেক কম জনসংখ্যার রাজ্য গুজরাতও অনেক বেশি ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলার তুলনায়। সেখানে ভ্যাকসিন অপ্রতুল কিন্তু তা সত্ত্বেও কো-উইন ড্যাশবোর্ড পোর্টালে দেখতে পাই প্রথম পরিসংখ্যান— যা মার্চ মাসে বিভিন্ন সর্বভারতীয় প্রথম সারির দৈনিক ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়, যা থেকে আমরা জানতে পারি যে দেশের ৬টি বড় শহরের মধ্যে কলকাতা ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ প্রদানে বাকি সবার থেকে এগিয়ে আছে।
অর্থাৎ যেখানে অন্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের বাংলা পরিমাণে কম ভ্যাকসিন পাচ্ছে, সেখানে ভ্যাকসিনেশনে সাফল্যের নিরিখে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতা অনেক অনেক এগিয়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে এখানে পুরো ভ্যাকসিন ভায়ালের পূর্ণ মাত্রায় সঠিক ব্যবহার হয়েছে, অর্থাৎ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ভ্যাকসিন নষ্ট এখানে অনেক কম হয়েছে। এর বাইরেও কলকাতা পুরসভা এমন কিছু পদক্ষেপ করেছে যা দেশের অন্য কোনও শহর করেনি। যেমন ‘ভ্যাকসিনেশন অন হুইল’— যা জনবহুল বাজারের মধ্যে ব্যবসায়ীদের ও বাজারচলতি মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া সুপারস্প্রেডারদের চিহ্নিত করে মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষদের যেমন— রিকশাচালক, বাসচালক, অটোরিকশা চালক, ক্যাব ড্রাইভার, মুদির দোকানদারদের আলাদা করে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে যেমন স্বাস্থ্য ও জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ভ্যাকসিনেশনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে— বাংলাতে তাদের সঙ্গে সুপারস্প্রেডার হিসেবে চিহ্নিত করে এই মানুষদেরও টিকাকরণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে করোনার গ্রাফ নামছে বাংলায়। হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর জমায়েত, যেখানে বলা হয়েছিল সবার আরটিপিসিআর টেস্ট করাতে হবে, সেখানে যে আরটিপিসিআর টেস্ট হয়েছিল তার সমস্ত কিটটাই ছিল জাল!!
সারা দেশব্যাপী করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে ছড়িয়ে দিতে যা অন্যতম কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। এরই সঙ্গে ছিল রাজ্যে আট দফা নির্বাচন, বাইরে থেকে আসা হাজারো কেন্দ্রীয় বাহিনী, যাঁরা সবাই আদৌ আরটিপিসিআর টেস্ট করেছিলেন কি না কিংবা ডাবল ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন কি না, সেটা আদৌ জানা যায়নি, এর সঙ্গে আট দফা জুড়েই আসা বহিরাগত জমায়েতকারী— এইসব মিলে কোভিড পরিস্থিতি এ রাজ্যেও উত্তুঙ্গ জায়গায় পৌঁছেছিল। তারপর সেই অবস্থা থেকে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে আস্তে আস্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয়বারের মতো মা-মাটি-মানুষের সরকার আবারও শপথ নিয়ে, কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ববি হাকিম এবং পূর্বতন ডেপুটি মেয়র তথা বিধায়ক অতীন ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশিত পথে দায়িত্ব নিয়ে সারা কলকাতাব্যাপী টিকাকরণ কর্মসূচিকে কার্যকর করতে শুরু করেন। যার সাফল্য ও ফলাফল আজ কো-উইন ড্যাশবোর্ডের থেকে পাওয়া সরকারি তথ্য দেখলেই পাওয়া যাচ্ছে।
সারা দেশে আজ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে কলকাতার টিকাকরণ কর্মসূচি। সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে কলকাতা পুরসভা যখন অনন্য নজির স্থাপন করছে তখনই আমরা দেখেছি সারা রাজ্যে কো-ভ্যাকসিনের আকাল দেখা দিয়েছিল দিন দশেক আগেই। পরবর্তীকালে কো-ভ্যাকসিন সাপ্লাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এবার এল কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের আকাল।
ফলত, শুধু কলকাতাতে কোভিশিল্ড টিকাকরণ বন্ধ তা-ই নয়, কলকাতার লাগোয়া অঞ্চলগুলোতেও একই হাল। এই সব জায়গাগুলো অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনা হাওড়া, হুগলি থেকে অসংখ্য মানুষ রোজ কর্মসূত্রে কলকাতা আসেন। তাঁদের অনেকেই এই আর্বান প্রাইমারি হেলথ সেন্টার বা মেগাসেন্টারগুলি থেকে ভ্যাকসিনের সুবিধা নিয়ে থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অবিমৃশ্যকারিতার জন্যে রাজ্যওয়ারি ভ্যাকসিন বণ্টনে রাজনীতি ও অসাম্যের ফলে সামগ্রিকভাবে রাজ্যের ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াই আসলে এখন ধাক্কা খেতে চলেছে।
রাজনৈতিক লড়াইয়ে একটি রাজ্য দখল করতে না পেরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এইধরনের চেষ্টা আসলে গোটা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরেই একটি আঘাত।
আরও পড়ুন-সন্ত্রাস ত্রিপুরায় : এবার তৃণমূলে যোগ দিতে আসা বাম নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত বিজেপির হাতে
মনে রাখা দরকার আমাদের পশ্চিমবঙ্গের থেকে আয়তনে এবং জনসংখ্যায় উভয়দিকেই ছোট রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও গুজরাতে অনেক বেশি পরিমাণে ভ্যাকসিন বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তারপরেও ক্রমাগত বঞ্চনা করা হচ্ছে আমাদের রাজ্যকে। এখন ক’দিন ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না, কবে পাওয়া যাবে, কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এভাবে একটা রাজ্যের সঙ্গে এইধরনের বিমাতৃসুলভ আচরণ আসলে দেশের মূল আধার যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, আখেরে সেটাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে না তো, সেই প্রশ্ন কিন্তু জোরালো হচ্ছেই।