নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে। এর মধ্যে খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সাথে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, যা ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হয় না। তখন সরকারি ভাবে সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন। তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য দুর্যোগের মাত্রা নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজন। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ১, ২, ৩, ৪, ৫ (সুপার সাইক্লোন), ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে রিখটার স্কেল (বা মোমেন্ট ম্যাগ্নিটুডে স্কেল) ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ ইত্যাদি। কিন্তু খরা খুব ধীরগতি সম্পন্ন। এর প্রভাব নানাবিধ। ইতিহাস বলে, ৮০০০ বছর আগে সাহারা মরুভূমি টেথিস সমুদ্র শুকিয়ে উৎপন্ন হয়েছে। এটা অতি দীর্ঘ খরার প্রভাব, তেমনি তিব্বতের জলবায়ু প্রায় সবসময় ভয়ানক শুষ্ক, এটাও খরার প্রভাব। এগুলি সবই ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। বাতাসের উলম্ব গতি যুক্ত মেরিডিওনাল ঘূর্ণনের প্রভাব। আবহাওয়া বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবীর ৩০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ বা ল্যাটিচুডের কাছে, উল্লিখিত ঘূর্ণনের গতি নিম্নমুখী। আর নিম্নমুখী বাতাস বায়ুমণ্ডলের উপরকার শুষ্ক বাতাস ভূসমতলের কাছে নিয়ে আসে। সেই কারণে পৃথিবীতে যত মরুভূমি আছ, তাদের বেশিরভাগের অবস্থান ওই ৩০ ডিগ্রি ল্যাটিচুডের কাছে। সাহারা মরুভূমি, থর মরুভূমি ইত্যাদি বেশির ভাগের অবস্থান এই অংশে।
খরার প্রকার ভেদ
খরা হচ্ছে অনতিকাল ধরে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি। পরিণতি হিসাবে জলের অভাব, খাদ্যশস্যের অভাব। পশু-পাখি থেকে শুরু করে মানব জীবনে ভীষণ কষ্টকর প্রভাব পড়ে। আর্দ্রতা কম বা বেশি, সমস্তরকম জলবায়ুর জায়গাতে এর বিস্তার। বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী খরাকে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করা হয়।
মিটিওরোলজিকাল খরা
ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিকাল ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী, গড় শুষ্কতার বা বৃষ্টিপাতের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে খরা বর্ণনা করা হয়। কোনও বিশেষ স্থানে গড় বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের থেকে ৭৫ শতাংশ বৃষ্টি কম হলে খরা বলা হয়। যদি বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ কম হয় তখন বলা হয় মধ্যম মাপের খরা। আর যদি বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ৫০ শতাংশের বেশি হয় তখন বলা হবে ভয়ানক খরা।
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যসাথীতে ১ বছরে ৬ হাজার অস্ত্রোপচার, ২০৯১ কোটির পরিষেবা দিল রাজ্য
কৃষিভিত্তিক খরা
যদি বৃষ্টিপাত কমের জন্য, মাটির উপরিভাগ ও নিচের নানা গভীরতায় জলস্তর কমতে থাকে, যার জন্য নদী-নালার জল শুকিয়ে যায়, ফলে কৃষিকাজের জন্য জল পাওয়া যায় না। উত্তর-পূর্ব ভারতে যদি উত্তর-পশ্চিম বাতাসের স্থায়িত্ব বেড়ে যায়, অর্থাৎ জুন মাসের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় আর দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরীয় বাতাস দুর্বল হতে থাকে, তা হলে এই দুমুখী বাতাসের সংযোগস্থল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি হয়। এই অবস্থায় উত্তর-পূর্ব বাতাস উত্তপ্ত ও শুষ্ক হয়ে বাঁকুড়া-সহ আশপাশের জেলাগুলিতে তাপপ্রবাহ বেশি হবে। কালবৈশাখীর সংখ্যা কমে যাবে। বস্তুত, বিপরীতধর্মী বাতাসের সংযোগস্থানে ঝড়-ঝঞ্ঝা বা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকে।
জলবিদ্যা বা জলানুসন্ধান-সংক্রান্ত খরা
অনেকদিন বৃষ্টিপাত না হলে নদী, লেক, পুকুর ইত্যাদি আধারের জল শুকিয়ে জলবণ্টন বিঘ্নিত হয়। এতে সমাজে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। খরার সঙ্গেই দোসর হিসাবে বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান থাকে তাপতরঙ্গ বা হিট ওয়েভ। সামার মনসুনের সময় উত্তর ভারতে, সাধারণত মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দুপুরের দিকে অস্বাভাবিক উচ্চতাপের প্রবাহ চলতে থাকে, যার তাপমাত্রা ওইস্থানের ম্যাক্সিমাম তাপমাত্রার থেকেও অনেক বেশি। কখনও কখনও সাবধানতা অবলম্বন না করলে মানুষ, গবাদি পশু-প্রাণীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিকাল ডিপার্টমেন্ট (IMD) অনুযায়ী খরার জন্য তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে হবে আর নরমাল তাপমাত্রার থেকে ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হতে হবে। ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হলে সিভিয়ার হিট ওয়েভ বলা হবে। আর কোনও জায়গার তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে হিট ওয়েভ ঘোষণা করা হবে অন্য কোনও কারণ ছাড়াই। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য হিট ওয়েভ সমস্ত পৃথিবীতে দিন দিন বাড়ছে। এর জন্য সক্রিয়ভাবে এলনিনো এবং প্রদূষণ দায়ী। এলনিনো পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপকে বের করে সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আর প্রদূষণের জন্য বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি কারও অজানা নয়। সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা কম হলে (লা-নিনা) বিষুব রেখা বরাবর ওয়াকার্স সার্কুলেশনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ ওয়াকার্স সার্কুলেশন-এর ঊর্ধ্বমুখী গতি ও নিম্নমুখী গতির স্থান ও কালের পরিবর্তন হয়। ফলস্বরূপ স্থান কাল নির্বিশেষে জলবায়ুর পরিবর্তন। এর জন্য শীতকালের সময়কাল কমছে এবং তাপমাত্রা আশানুরূপ হচ্ছে না। তেমনি বর্ষাকালের সেই একই অবস্থা। শুধু গরম, হিট ওয়েভ সংক্রান্ত ঘটনাগুলি বেড়ে যাচ্ছে। মানব শরীরে হিট ওয়েভ-এর প্রভাবই হল হিট স্ট্রোক।
হিট স্ট্রোক হলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া, দুর্বল লাগা, জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা, নাক দিয়ে জল আসা, বমি হওয়া, সাথে প্রচুর ঘাম হতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অথবা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট-এর সাথে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া একটি মারাত্মক ঘটনা। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই রকম অবস্থার আগেই কালবিলম্ব না করে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। অ্যালকোহল ও মাদক জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে রাখা উচিত। হালকা পোশাক পরা উচিত। চোখে-মুখে পরিষ্কার জল দেওয়া উচিত। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনে হিট ওয়েভ সমগ্র পৃথিবীতে দিন দিন বাড়ছে।