আমাদের দেশের (India) সাফল্য ও গৌরবের কথা যখন তারস্বরে প্রচার করা হয়, তখন দেশের ব্যর্থতা ও অগৌরবের কথা অনেকটাই চাপা পড়ে থাকে। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। বর্তমান সময়ে দেশের শাসক-প্রধান এক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছেন। শুধু বর্তমান নয়, অতীত গৌরব নিয়েও তিনি মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বসিত। আবার নিকট অতীত নিয়ে তাঁর নীরবতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। আমাদের এই দুর্ভাগ্য নিয়ে দু’চার কথা বলার উদ্দেশ্যেই এই লেখা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির দিক থেকে দেশের (India) মোট উৎপাদন (জিডিপি) যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের উপরের দিকে থাকা পাঁচটি দেশের (India) মধ্যে এক্ষেত্রে ভারত জায়গা করে নিয়েছে। এই একই সময়ে দেশের (India) দারিদ্র অসহ্যরকম ভাবে বেড়ে গিয়েছে। নীতি আয়োগের বহুমুখী দারিদ্র সূচক অনুযায়ী জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ এখনও গরিব রয়েছেন। গ্রামীণ গরিবের সংখ্যা আরও বেশি, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। প্রকৃত সংখ্যা যে অনেক বেশি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে বহু মানুষ দারিদ্রসীমার বাইরে চলে এসেছেন। এই ভয়ঙ্কর দারিদ্র থেকে মানুষকে মুক্ত করার বিশ্বাসযোগ্য কর্মসূচি কোথায়? ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর কথা এখন আর শ্রুতিগোচর হয় না।
এর পরও আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এমন মাত্রায় হচ্ছে যে, জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রান্তিক অবস্থানে। আয় ও সম্পদে তাঁদের অংশ কমে যাচ্ছে। ফলে তাঁদের ভোগ করার ক্ষমতা ও চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর ধনী এবং ক্ষমতাশালীরা অফুরন্ত ভোগের অধিকারী হচ্ছেন। জনসংখ্যার এক শতাংশের আয় ক্রমশ বাড়ছে ৫০ শতাংশ মানুষের ক্রমহ্রাসমান আয়ের বিনিময়ে। আর ভারতীয় ধনকুবেরদের কয়েকজনের আয় বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে বিশ্ব তালিকার শীর্ষের দিকে। শাসকরা তাঁদেরই নানা আর্থিক সুবিধা দিচ্ছেন।
সরকারি হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, মোদি রাজত্বের প্রথম ৭ বছরে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া মূলত বৃহৎ কর্পোরেটদের ১০.৭২ লক্ষ কোটি টাকা মকুব করে দেওয়া হয়েছে। আরও সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া ১৩টি কোম্পানিকে ২.৮৫ লক্ষ কোটি টাকা আপসে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেটদের ট্যাক্স যেখানে বাড়ানো দরকার, তাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরাই তো শাসক আরএসএস-বিজেপির টাকার থলি ভরে দিচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ নয় কি? ২০২২-এর অক্সফাম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের দ্রুত আর্থিক উন্নতি হচ্ছে, আর ধনী-দরিদ্রের আয়ের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি যেসব দেশে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। সর্ববৃহৎ ধনীরা সম্পদের বেশিরভাগ লুটে নিচ্ছে, অন্যদিকে গরিবরা ন্যূনতম মজুরিটুকুও পাচ্ছেন না। ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তির মালিক ২০০০ সালে ছিল ৯ জন। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা হয়ে যায় ১০১ জন এবং বর্তমানে ১১৯ জন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিদিন ভারতে জন্ম নিচ্ছে ৭০ জন নতুন কোটিপতি। কোনও কোনও কোম্পানিতে উচ্চবেতনভুক্ত কর্তা এক বছরে যা আয় করেন, গ্রামের একজন ন্যূনতম মজুরি প্রাপক তা আয় করতে ৯৪১ বছর লাগবে। এর থেকেই বোঝা যায়, কেন কৃষকরা চিরকাল গরিব থাকে।
সমভাবে কষ্টকর হল ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিভাজনের চিত্রটি। প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে যে ৫ জন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন, তাঁরা হলেন সুবিধা না-পাওয়া নিম্নবর্গের মানুষ এবং আদিবাসীরা। অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মানুষের একটা বড় অংশ এর-ই অন্তর্ভুক্ত। এর পর রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। সবথেকে যন্ত্রণাদায়ক হল এদেশের লিঙ্গ-বৈষম্য। বেশিরভাগ সাম্প্রতিক তথ্য থেকে সবচেয়ে খারাপ নারী-পুরুষের বৈষম্য এদেশে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরব, নাইজেরিয়া এবং মিশরের সঙ্গে ভারতের তুলনা করা যেতে পারে। এই লিঙ্গ-বৈষম্যের প্রধান কারণ এদেশে চলে আসা বিকৃত পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্য। নারীর ক্ষমতাহীনতা এবং তাঁর কাজের অধিকার সঙ্কোচনের এটাই বড় কারণ।
আরও পড়ুন-গবেষণার মানচিত্রে হ্যারিয়েট ব্রুকস
যত দিন যাচ্ছে, ততই জোগান-কেন্দ্রিক বাজার-অর্থনীতির উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার আর্থিক নীতি, আর্থিক বৃদ্ধির দিকে ছুটছে। মানুষের চাহিদাভিত্তিক আর্থিক নীতি অবহেলিত হচ্ছে। গরিবের ন্যূনতম আয়ের বিষয়ে অনীহা ক্রমশ বাড়ছে। অন্যদিকে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের। মানুষের জীবন-জীবিকার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিভাজনের রাজনীতি। খুনি ধর্ষকদের জন্য ফুলমালা, এ কেমন দেশ?
এরই ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী শক্তির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটছে, যা আবার কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধারীর হাতে। সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে বশে আনা আজ রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বিচার ব্যবস্থা এবং মিডিয়া যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
এরই মধ্যে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলির অর্জিত অধিকার হজম করে ফেলার কারণে রাজ্য সরকারগুলি দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং সম্পদহানির ঘটনায় কাতর হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজম এখন কথার কথা। কার্যত যা চলছে তাকে অসহযোগিতামূলক কেন্দ্রিকতা ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় না। কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কেন্দ্রের ধারাবাহিক নাক গলানোর ঘটনাগুলি এ বিষয়ে উল্লেখ করা যায়। নিয়মিত বার্তালাপের কোনও আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিদারুণভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা আমাদের কম দুর্ভাগ্যের বিষয় নয়। সবকিছুর এমন অধঃপতন হচ্ছে যে, রাজ্যগুলির টিকে থাকাটাও কেন্দ্রের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পর্যন্ত চলে গেল। পশ্চিমবঙ্গের উপর কেন্দ্রের চাপ ক্রমাগতই বাড়ছে। ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজ্যগুলিকে নড়বড়ে করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সরকার ভাঙার খেলা চলছে।
একই ভাবে রাজ্যগুলির আর্থিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের আর্থিক নীতি, যথা— নোটবন্দি, প্রস্তুতিবিহীন জিএসটি এবং করোনা মহামারী সামলানোর পদ্ধতিসমূহ রাজ্যগুলির উপর চরম আর্থিক আঘাত নামিয়ে এনেছে। শক্তিশালী রাজ্যগুলিই যে দেশকে আরও শক্তিশালী করতে পারে— ওই সত্যকে কেন্দ্রীয় সরকার অবজ্ঞা করছে।
এখন ব্যর্থতা আড়াল করার শাসকীয় কৌশল হল, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ফ্যাসিস্ত পদ্ধতির শাসন। ফলে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ধ্বংসের বাড়াবাড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে চলছে বিলিওনেয়ার রাজ প্রতিষ্ঠার সার্বিক অপচেষ্টা। এমন ‘নতুন ভারত’ আমরা চাই না।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়ানো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য দেশব্যাপী ফ্যাসিস্ত শাসক বিরোধী সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে উঠছে না। বৃহত্তর গণআন্দোলন ছাড়া এই হতাশাজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। ইতিহাসের নানা পর্বে এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তবে, মানুষই শেষ করা বলে। সেই ভরসা যেন বেঁচে থাকে।