উনিশ শতকের বাংলায় নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের সূত্রপাত ঘটেছিল। নারীকেন্দ্রিক সামাজিক আন্দোলন এবং নারী প্রগতির পথে এগোনো – সেখানেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল নারী শিক্ষা। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল নি:সন্দেহে মেয়েরাই। রামমোহনের সতীদাহ বিরোধিতা পরোক্ষভাবে নারীর অধিকারের কথাই বলেছে। অন্যদিকে বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ বিরোধী কর্মসূচি ও লেখনী, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি এবং বিরোধিতা অবশ্যই মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল অনেকটাই। ধূতি চাদরের দেহাতি স্বাভিমান নিয়ে বিদ্যাসাগরের ক্লান্তিহীন উদ্যোগ মহিলাদের শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশকে ত্বরান্বিত করে। স্বাধীনতার আগে ও পরে বিভিন্ন গণআন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ উনিশ শতকের বাংলায় নারী প্রগতির উদ্দীপনাকে আত্মস্থ করেই এগিয়েছে। তবুও সামগ্রিকভাবে ‘সীমায়িত ও নিয়ন্ত্রিত স্ত্রী স্বাধীনতা’-ই উনিশ – বিশের বাস্তবতা। এই প্রেক্ষিতে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে বাংলায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে এক নতুন চেহারা পেতে শুরু করল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কৃতিত্ব আরও বেশি এই কারণে, তাঁর পরিকল্পিত প্রকল্পগুলি তৈরি হচ্ছে আম জনতার চাহিদা এবং প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে। ফলত আলংকারিক সরকারি প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা ভেঙে দিয়ে এগুলো হয়ে উঠেছে মেয়েদের স্বাভিমান এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তাইতো এই পর্বে ‘আমি কন্যাশ্রী’, ‘আমি রূপশ্রী’, ‘আমি সবলা’ বলতে বাংলার মেয়েদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। বোধহয় নারীর ক্ষমতায়নে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
আরও পড়ুন: স্পিকার সময় দিলেন না, সাংসদ পদে ইস্তফা না দিয়েই কলকাতা ফিরছেন বাবুল সুপ্রিয়
১৮৫৭ সালে ‘নারী শিক্ষা ভান্ডার’ চালু করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই তহবিলের অর্থ থেকে সে সময়ে বহু বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ রচনা থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যায় – ” আমরা বিনয় বচনে স্বদেশীয় ভদ্র মহাশয়দিগের সন্নিধানে নিবেদন করিতেছি, যাহাতে এই বাল্যপরিণয়রূপ দুর্ণয় অস্মদেশ হইতে অপনীত হয়, সকলে একমত হইয়া সতত যত্নবান হউন।” – বিদ্যাসাগরের এই আহ্বানের পরে প্রায় দেড়শো বছর ধরে সেমিনার, বক্তৃতা, বিতর্ক, গবেষণাপত্রে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বহু আলোচনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সারা ভারতবর্ষে কন্যা ভ্রূণ হত্যা বন্ধ হয় নি। হাথরস কান্ড ঘটে চলে এখনও। কিন্তু ১লা অক্টোবর, ২০১৩-এ ঐতিহাসিক ‘কন্যাশ্রী’ বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক প্রত্যাঘাত করলো। বিদ্যাসাগরের বাংলায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার এত বড়ো স্পর্ধিত পদচারণা আর কোথায়? ধূতি চাদরের স্পর্ধা অতএব একুশ শতকের বাংলায় এক নতুন নারীকেন্দ্রিক জাগরণের উন্মাদনা সৃষ্টি করলো। বস্তুত মেয়েদের ক্ষমতায়নে এত বড় সার্থক প্রকল্প সারা বিশ্বে বিরল। বিশেষ করে প্রান্তিক মহিলাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। আগামী কয়েক দশক পরে এর প্রকৃত প্রভাব বোঝা যাবে। সেদিন হয়তো ‘কন্যাশ্রী’ কে নিয়ে অনেক বিদ্যায়তনিক আলোচনা ও গবেষণা চলছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাত্র এক দশকের মধ্যেই এ রাজ্যের নারীকেন্দ্রিক সামাজিক – পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটতে শুরু করেছে। সবুজ সাথীর সাইকেলে চড়ে গ্রামের মেয়েদের বিদ্যালয় যাত্রার ছবি আজ আর শিল্পীর কল্পনা নয় – বাস্তব। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত সাম্প্রতিককালে যতগুলো অভিযোগ থানায় হচ্ছে – তার অধিকাংশই স্কুলের মেয়েদের দ্বারা হচ্ছে। মেয়েরাই এখন এ বাংলায় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। কন্যাশ্রীর যোদ্ধারা এখন নিয়মিত বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। ‘দুয়ারে সরকার’র চূড়ান্ত সাফল্যে মেয়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই ব্যাপারগুলো অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়নের প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে।
আরও পড়ুন: স্ট্রেট ব্যাটে ইমরানকে মুখতোড় জবাব দিলেন ভারতের স্নেহা
বর্তমান সরকারের হাত ধরেই এসেছে ২০১৫ সালে যৌন কর্মী ও পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের পুনর্বাসনের প্রকল্প ‘মুক্তির আলো’, ‘স্বাবলম্বন’। বয়:সন্ধির মেয়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির পরিপূরক কর্মসূচি ‘সবলা’ নি:সন্দেহে লক্ষ লক্ষ মেয়েদের আলোর দিশা দেখাচ্ছে। ‘আনন্দ ধারা’, ‘রূপশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’-এই প্রকল্পগুলি আলংকারিকভাবে নয় – সামাজিক ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, বিদ্যালয়ে ব্যাপকহারে স্কুলছুট কমে গেছে। গার্হস্থ্য হিংসা এবং মহিলাদের প্রতি অপরাধ বাংলায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারীকেন্দ্রিক উদ্ভাবনীমূলক পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলির ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার আঙিনাতে ছাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধি বুঝিয়ে দেয় মেয়েদের ক্ষমতায়ন নির্ণায়ক জায়গায় পৌঁছেছে পশ্চিমবঙ্গে। একেবারে সাম্প্রতিককালে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড ও ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প তো মহিলাদের অর্ধেক আকাশের বেড়াও ভেঙে দিতে চাইছে।
রামমোহন – বিদ্যাসাগরের সৃষ্টিশীলতার উত্তরাধিকার এভাবেই জননেত্রীর কর্মকাণ্ডের সুবাদে মেয়েদের মানবী উড়ানের নতুন আখ্যান রচনা করছে।