জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi) নিয়ে বাঙালির আবেগ উৎসাহ চিরকালীন হয়েও সমকালীন।
লোকাচার বিষয়ে গবেষকদের মতে, আঠারো উনিশ শতকে বাংলায় বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই সামাজিক পরিস্থিতিতে জামাই অর্থাৎ কন্যার স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা বাবা-মায়ের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তার থেকেই দেবী ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা ও জামাইকে আপ্যায়নের পালা শুরু হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে জামাইষষ্ঠীর সূচনা কিন্তু সুপ্রাচীন কালে একথা বলাই যায়।
গবেষকদের মতে, মানব বৃহসূত্রের সম্ভাব্য সংকলন কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকেরও আগে। বৈদিক পদ্ধতিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা এই দেশে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। যদিও সময়ের নিরিখে এই পুজোর রীতিনীতিতে অজস্র বদল এসেছে।
কারণ, আমরা দেখি যে, সুদূর অতীতে বৈদিক সংস্কৃতিতে ও ষষ্ঠীকল্পের রীতি ছিল যা আজকের সময়ে নারীদের কাছে ষষ্ঠীব্রত। সংহিতা অংশে অগ্নিজাতক দেবতা স্কন্দের উল্লেখ রয়েছে একাধিকবার। এখানে স্কন্দপত্নী ষষ্ঠীর উপাসনার বিধিও রয়েছে।
দেবী ষষ্ঠীর উপাসনার বিধি পাওয়া যায় মানব গৃহসূত্র গ্রন্থে। দেবী ষষ্ঠীর কাছে সন্তান, ধন ধান্যের সমৃদ্ধি কামনায় উপাসনার কথা রয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে তেতাল্লিশতম অধ্যায়ে নারায়ণ নারদকে দেবী ষষ্ঠীর পরিচয় দিয়ে বলেন—
“ষষ্ঠা ষষ্ঠাংশা প্রকৃত চ সা প্রকৃতের্যা চ সা ষষ্ঠী প্রকীত্তির্তা।
বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণু মায়া চ বালাদা।।
মাতৃকা সু চ বিখ্যাত দেবসেনা ভিদা চ যা।
প্রাণাধিক প্রিয়া সাধ্বী স্কন্দভার্যা, চ সুব্রতা।।
আয়ুঃ প্রদা চ বালানং ধাত্রী রক্ষাকারিণী।
সততং শিশুপার্শ্বস্থা যোগেন সিদ্ধিযোগিনী।।“
অর্থাৎ বালকগণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বালকদায়িনী, বিষ্ণু মায়া প্রকৃতির ষষ্ঠকলা এই নিমিত্ত তিনি ষষ্ঠী নামে কীর্ত্তিতা।
তিনি সুব্রতা। তিনি ষোড়শ মাতৃকার মধ্যে দেবসেনা নামে বিখ্যাত্যা।
তিনি মাতার ন্যায় সর্বদা বালকগণের পরমায়ু বৃদ্ধি করেন। যোগে সিদ্ধি স্বরূপা, সেই দেবী নিরন্তর শিশুগণের সঙ্গে অবস্থান করে রক্ষা করেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে আরও একটি কাহিনির কথা আছে দেবী ষষ্ঠীকে ঘিরে তা হল— রাজা প্রিয়ব্রতর মৃত পুত্র দেবী ষষ্ঠীর কৃপায় পুনর্জীবন লাভ করলে তিনি কৃতজ্ঞতাবশত দেবীর পুজো শুরু করেন।
আবার কাশীরাম দাসের মহাভারতের সভাপর্বে নারদ লোকপালদের সভা বর্ণনা অংশে ষষ্ঠী দেবীর উল্লেখ আছে।
সাবিত্রী ভারতী লক্ষ্মী অদিতি বিনতা ভদ্রা ষষ্ঠী অরুন্ধতী কন্দ্রু নাগমাতা।।
দেবী ভাগবতের নবম স্কন্দের ছেচল্লিশ অধ্যায়ে দেবী ষষ্ঠীর কথা বর্ণিত হয়েছে।
আবার বাণভট্ট রচিত কাদম্বরীতেও দেবীর প্রসঙ্গ আছে। উজ্জয়নী শহরের তারাপীড় নামক এক রাজা বাস করতেন। তাঁর রানির নাম ছিল বিলাসবতী। সন্তান কামনায় বহুবার ব্রত, মানত, পুজো, দান-ধ্যান করতেন।
একদিন বিলাসবতী সন্তানসম্ভাবনা হলেন এবং সুন্দর একটি পুত্রও জন্মাল। এরপর রাজা মন্ত্রী পারিষদ-সহ আঁতুড়ঘরে গিয়ে দেখলেন ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে এবং এয়োরা মা ষষ্ঠীর পুজোর কাজে ব্যস্ত।
তাহলে দেখাই গেল, নারীদের ধর্মীয় কর্তব্যের অংশ হিসাবে এই পুজোর উৎপত্তি বহু যুগ আগে থেকেই।
জানা গেল যে, দেবী ষষ্ঠী সন্তানের আয়ু বৃদ্ধির জন্য পুরাকাল থেকেই আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠাতা।
যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে মা ষষ্ঠী গন্ধদেবের পালিকা মা ও রক্ষয়ত্রী।
দেবী ষষ্ঠীর কাহিনিগুলো পাওয়া যায় বাংলার মঙ্গলকাব্যে।
ষষ্ঠীমঙ্গলের সর্পদেবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। তবে ধর্মীয়ভাবে এই দিনটি বেশি পালিত হয় অরণ্যষষ্ঠী হিসেবে।
নন্দনের রঘুনন্দ রঘুনন্দনের তিথি তত্ত্ব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মহিলারা অরণ্যে গিয়ে হাতে পাখা নিয়ে স্কন্ধ ষষ্ঠীর পুজো করতেন। এই পুজো বনভূমি বা অরণ্যের ভেতরে সম্পন্ন করার নিয়ম। তাই এর নাম অরণ্যষষ্ঠী। এখন প্রশ্ন হল, ষষ্ঠীপুজোর সঙ্গে জামাই আদরের বিষয়টা সম্পৃক্ত হল কীভাবে?
বৈদিক যুগ থেকেই বাংলায় জামাইষষ্ঠী পালন করা রীতি। বিবাহিত নারীর শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিত্যনৈমিত্তিকের ব্যাপার। আর নারীর যদি সন্তান না থাকে তাহলে তো কথাই নেই! সেই অত্যাচার সীমা ছাড়ায়।
এছাড়াও একটা সময় পর্যন্ত বিবাহিত কন্যার পিতৃগৃহে যাওয়া অথবা কন্যার মা- বাবার কন্যার শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত সেভাবে প্রচলিত ছিল না। সন্তান না থাকলে তো নয়ই। তাই দীর্ঘদিন কন্যাকে না দেখার কষ্ট দূর করতে, মেয়ে-জামাইকে আমন্ত্রণ জানানো হত। কতকটা জামাইকে তুষ্ট করতেই এই জামাইষষ্ঠীর সূচনা।
বিবাহিত মেয়ের সুখী জীবনের কামনায় ও জামাইকে পুত্রস্নেহে মঙ্গল কামনায় মা ষষ্ঠীর পুজোপাঠ।
সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা, মা ষষ্ঠীর মঙ্গলকারক দেবী। সন্তানের মঙ্গল কামনায় মা ষষ্ঠীর পুজো করেন সব মায়েরাই।
ষষ্ঠীঠাকুর হলেন বাংলার এক লৌকিক দেবী। মূলত প্রজননের দেবী। তাঁর কৃপায় নিঃসন্তান নারী সন্তানবতী হয় শুধু তাই নয় তিনি সন্তানের রক্ষাকর্ত্রীও বটে। এমনটাই বিশ্বাস।
এ তো গেল দেবী ষষ্ঠীর কথা। এবার দেখে নেওয়া যাক ষষ্ঠীপুজোর অনুষঙ্গে জামাইষষ্ঠীর কথায়।
মহাকাব্যের জামাইয়ের আদর-আপ্যায়ন কেমন ছিল?
মিথিলার রাজা জনক নিজের দুই রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। রামের সঙ্গে সীতার, লক্ষ্মণের সঙ্গে ঊর্মিলার আর সহোদর কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবী আর শ্রুতকীরবিবাহ দিলেন ভরত আর শত্রুঘ্নের সঙ্গে।
রাজকীয় শুভপরিণয় তো হল। এবার দেখা যাক জামাইবরণ ও আদর আপ্যায়নের বহর।
বহুমূল্যের মণিমাণিক্যখচিত সোনার বসার জায়গা। পরাক্রমশালী মহাবীর রামের জন্য পা ধোয়ার জল নিজ হাতে দিলেন জনক। হাতির দাঁতের কারুকার্যমণ্ডিত টেবিলে সোনা ও রুপোর থালায় পছন্দের খাবার দেওয়া হল পরম যত্নে। রাজমাতার তদারকিতে পরিবেশিত হল বৈচিত্র্যময় এবং বর্ণময় সুস্বাদু সব খাবার। খাবারের সুঘ্রাণে চারিদিক আমোদিত। শুধু আহারই নয় সঙ্গে ছিল বিহারের ব্যবস্থা।
পারিষদদের জন্যও ছিল ঢালাও আয়োজন।
শুধু জামাইরাই নয় কন্যাদের আশীর্বাদস্বরূপ জনক দিয়েছিলেন হাতি, ঘোড়া, রথ, পদাতিকসৈন্য, অগুন্তি সিল্ক ও সুতির বস্ত্র, হাতেবোনা কার্পেট, সোনা ও রুপোর অভূতপূর্ব অলঙ্কার এবং শত শত সুসজ্জিতা দাসী।
রামায়ণে মন্দোদরীর কথা আমরা সকলেই জানি। তিনি লঙ্কা রাজ্যের পাটরানি। জীবনভর পাটরানির আসন আর রাবণের অন্তরে তাঁর স্থান ছিল অক্ষুণ্ন।
ময়দানব ছিলেন রাবণের শ্বশুর ও মন্দোদরীর পিতা। দীর্ঘ, বলশালী লঙ্কাধিপতি জামাই পেয়ে ময়ের আনন্দের সীমা ছিল না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জামাইবরণ করেছিলেন তিনি। যৌতুকে তিনি দিয়েছিলেন পছন্দের জামাইকে এক অত্যাশ্চর্য উপহার। নিজের তপোলব্ধ যোগশক্তি। শক্তিশেল!
রামায়ণ, মহাভারতে এরকম জামাইবরণের অজস্র কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে।
মহাভারতের পাণ্ডুর কথাই ধরা যাক। এমনিতে আমরা জানি যে পাণ্ডু অসুস্থ, দুর্বল একটু ক্ষীণকায়। কিন্তু জামাই হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর আদর ছিল অন্যরকম। সেখানে যথেষ্ট জনপ্রিয় তিনি। স্বয়ম্বর সভায় কন্যা বরণ করেছিলেন পাণ্ডুকে। শ্বশুর কুন্তীভোজ অত্যন্ত আনন্দিত তাতে। রকমারি অলঙ্কার আর খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন জামাতার।
মহাভারতের চিত্রাঙ্গদার পিতা মণিপুরের রাজা চিত্রবাহন জামাই অর্জুনের খুব খাতিরদারি করেন।
এমনিতেই ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা মনোরম মণিপুরের সমৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। সমস্ত প্রাসাদের থাম, খিলান, দরজা-জানলা সবেতেই সোনার জলের কারুকাজ। আসবাবপত্র সব রূপোর। তার সেখানে জামাই অর্জুনের বরণ কতটা বর্ণময় হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আর হবে নাই বা কেন পৃথিবীর সেরা ধনুর্ধর চিত্রবাহনের জামাই! জমকালো আপ্যায়নই যথাযথ।
যেমন মহাকাব্যের জামাই আদরের পাশাপাশি এবার আসি দেশজ রাজাদের জামাইষষ্ঠী নিয়ে মজার আলোচনায়।
আরও পড়ুন- জামাইবরণ
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের জামাইষষ্ঠীর (Jamai Sasthi) আয়োজন থাকত কিংবদন্তির পর্যায়ে। এই পরিবারেরই এক দণ্ডমুণ্ডের কর্তার জামাতা ছিলেন বঁইচির রাজা ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়।
তার একমাত্র কন্যার স্বামী। তাঁর ছিল পানের নেশা। নানা সুগন্ধি মশলা দিয়ে সাজা পান না খেলে তাঁর চলত না।
পান তো অনেকেই খান। এতে আবার বিশেষত্ব কী!
বৈঁচির রাজা বলে কথা! তাঁর পানে তো বিশেষত্ব থাকবেই।
তাঁর পানের খিলি গাঁথা হত সোনার লবঙ্গ দিয়ে।
প্রত্যেকবার খাওয়ার পর সেই সোনার লবঙ্গ পান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন তিনি।
সেই লবঙ্গ ইতিউতি ছড়িয়ে থাকত। কচিকাঁচাদের দল অনেক সময় সেটা সংগ্রহ করত।
জামাইদের নিয়ে রয়েছে আরও একটি মজার গল্প।
বারোশো নব্বই বঙ্গাব্দ। তেলেনি পাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের জমিদারবাড়ির গিন্নি কর্তার কাছে আবদার রাখলেন জামাইষষ্ঠীতে এমন মিষ্টি তৈরি হবে যা দিয়ে জামাই ঠকানো যাবে। সব শুনে জমিদার মশাইয়ের কপালে ফুটল দুশ্চিন্তার রেখা।
জামাইকে ঠকানো! তাও আবার মিষ্টি সহযোগে! কীভাবে সম্ভব! এদিকে গিন্নির আবদার বলে কথা। সেটা তো রক্ষা করতেই হবে। অনেক চিন্তা করে তিনি ডাকলেন মিষ্টি প্রস্তুতকারক সূর্য মোদককে। খুলে বললেন পুরো বিষয়টা। অনেক ভেবে সূর্যমোদক ও তাঁর ছেলে সিদ্ধেশ্বর তৈরি করলেন তালশাঁসের আকারে বিশেষ ধরনের মিষ্টি। জামাইষষ্ঠীর (Jamai Sasthi) দিনে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বাড়ির গিন্নিরা দিলেন সাজিয়ে সেই মিষ্টি। বড় বড় সুন্দরদর্শন সেই মিষ্টি দেখে তো জামাই মহাখুশি। মহানন্দে মিষ্টিতে কামড় দিতেই গোলাপের সুগন্ধীমিশ্রিত রসে ভিজল শৌখিন পাঞ্জাবি।
জামাই লাজে রাঙা হল। আর গিন্নিরা হেসে কুটিপাটি।
এইভাবেই বাঙালির মিষ্টির ইতিহাসে জুড়ে গেল জামাইঠকানো মিষ্টি জলভরা সন্দেশের নাম। আজও যার জনপ্রিয়তা অমলিন।
জামাই আদরের পাশাপাশি হাসি, ঠাট্টা, মশকরা মিলেমিশে জামাইবরণ, জামাইয়ের কল্যাণ কামনা নিয়ে আজও বহমান জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi) ধারা।
* পূর্ববঙ্গে জামাইষষ্ঠী (Jamai Sasthi) মানেই কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। উপহার দেওয়া-নেওয়া।
* পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে জামাইষষ্ঠীর দিনে ষষ্ঠীপুজোই মূল প্রাধান্য। সেদিন নিরামিষ ভক্ষণ।
* পশ্চিমবঙ্গীয় ষষ্ঠীপুজো পালনের উপাচার হল সাতটি— সতেজ বাঁশপাতা, পাঁচ-সাতটি গোটা ফল, দই, হলুদ, তেল, একগুচ্ছ দূর্বাঘাস, ষষ্ঠীর ডোর বা সুতো।
* পুজো শেষ হলে মা সন্তান এবং জামাইদের হাতে ডোর বাঁধবেন, কপালে তেলহলুদ, দইয়ের ফোঁটা, পাখার বাতাস দেবেন আশীর্বাদস্বরূপ।
* ঘটিবাড়িতে পুজোর পর দই, খই, মিষ্টি, মুড়কি সহযোগে ফলার খাওয়ার চল। গোটা দিনটা নিরামিষ খাওয়ার চল।