নব্বই দশকের আর্থিক ও বাণিজ্যিক সংস্কারগুলি যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে, শ্রম সংস্কার তারই যুক্তিযুক্ত পরিণতি। খোলাবাজার অর্থনীতির প্রয়োজনেই শ্রমের বাজারকে নমনীয় করার চাপ বেড়েছে। বাজারের প্রয়োজনমতো শ্রমিক নিয়োগের স্বাধীনতা চাই মালিকপক্ষের। যদিও বড় কোনও শ্রম সংস্কার ছাড়াই গত তিন দশক ধরে শ্রমের বাজারে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। স্থায়ী শ্রমিকদের জন্য চালু আইনগুলি বাস্তবে খুবই কম ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে দেখা গিয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির দর-কষাকষির ক্ষমতা ক্রমাগত কমেছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলি ক্রমশ নয়া উদারবাদী অর্থনীতির চাপে দুর্বল হয়েছে। এই অবস্থায় শ্রম আইন আরও শিথিল ও নমনীয় করার দাবি মালিকপক্ষের দিক থেকে জোরালো হয়ে ওঠে। যার কেতাবি নাম ‘Ease of doing business’।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন চারটি লেবার কোড (Labour Code) তৈরির উদ্দেশ্য দুটি। এক, সংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে এনে শ্রমিককে একা করে দেওয়া এবং দুই, শ্রমিক সংগঠন তথা ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দেওয়া।
পুঁজি ও শ্রমিকের লড়াইয়ের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, পুঁজি সর্বদা শ্রমিকশ্রেণির সংঘ শক্তিকে বিভক্ত করে তাঁদের যৌথ দর-কষাকষির ক্ষমতাকে বিভক্ত ও দুর্বল করার সুযোগ খোঁজে। শিল্প সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষার দায় সর্বদা শ্রমিক শ্রেণিকেই নিতে হয়েছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে – ১. কেন্দ্রীভূত বাজার এবং ২. কেন্দ্রীভূত প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার পরিচালিত হবে। আর রাষ্ট্রের কাজ হল বাজার অর্থনীতি যাতে বেসরকারি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলতে পারে সেরকম পরিবেশ তৈরি করা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সেই কাজ চলছে। রাষ্ট্র ও ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা ছেঁটে দিয়ে পুঁজি আর শ্রমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারলেই শক্তির জোরে পুঁজির পক্ষে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সুবিধাজনক হয়। পুঁজির প্রভুত্বে শ্রম দাসত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। পুঁজির তোষণে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এই প্রক্রিয়াতেই রাষ্ট্র ও পুঁজির মধ্যে একটা অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে। এর ফলে পুঁজি আরও শক্তিশালী হচ্ছে এবং রাষ্ট্র (পড়ুন মোদি সরকার) তার এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও মসৃণ ও আরও প্রশস্ত করে দিচ্ছে। এরই পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক রঙিন স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে লাগাতারভাবে। জনতার ধারণায় বদল ঘটাতে না পারলে রাষ্ট্র ও পুঁজির এই আঁতাতকে দুর্বল করা যাবে না।
শ্রমি কোডগুলি (Labour Code) এই আঁতাতের বিষাক্ত ফসল। যেখানে শ্রমিকদের সংজ্ঞাটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। সংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমজীবী মানুষের ৬ থেকে ৭ শতাংশ। লেবার কোডগুলি (Labour Code) তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অসংগঠিত শ্রমিকেরা কার্যত এর বাইরে অবস্থান করছে।
আরও পড়ুন-এবার ভাঙন সপা, কংগ্রেসে
সংগঠিত শ্রমিকদের বিরাট অংশকে আইনি সুরক্ষার বলয় থেকে হটিয়ে দিতে কারখানার সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইনে, আগের ১০ জন কাজ করেন এমন কারখানা আর আইনের আওতায় থাকবে না। ২০ জন কাজ করে এমন কারখানাই লেবার কোডের আওতায় আসবে। আগে ২০ জন ঠিকা শ্রমিক কাজ করলে তাঁরা আইনি সুবিধা পাওয়ার অধিকারী ছিল। এখন সেই সংখ্যাটা ৫০ করা হয়েছে। আগে ১০০ জন কাজ করে এমন কারখানায় ছাঁটাই, লেঅফ ও ক্লোজারের জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হত। এখন সংখ্যাটা ৩০০ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ১ থেকে ২৯৯ জন শ্রমিক কাজ করেন, এমন কারখানার সংখ্যা মোট কারখানার ৮০ শতাংশ তো হবেই। শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য জীবনধারণ উপযোগী মজুরি তাঁর প্রাপ্য হওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির ধারণাকে নানা কৌশলে বদলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৭৮ টাকার কম মজুরি দেওয়া যাবে না। ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ নিয়ে নানা মত আছে। তাতে ৩৭৫ টাকার দৈনিক মজুরির সুপারিশও আছে। দাবি আছে ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরির। এই সুপারিশ ও দাবি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। উৎপাদন খরচ কমাতে শ্রমিকের মজুরি যতটা নিচে রাখা যায়, মালিকরা তো সেটাই চায়। কল্যাণকামী রাষ্ট্রও শ্রমিকের ন্যূনতম স্বার্থরক্ষায় আগ্রহী নয়। শ্রমদাসত্বের দলিল ছাড়া লেবার কোড অন্য কিছু নয়।
কাজের সময় ৮ ঘণ্টা রাখা হলেও নিয়োগকারী একজন শ্রমিককে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতে পারবে, এমন কথাই বলা হয়েছে। এর ফলে যেখানে তিন শিফটে কাজ হয়, সেখানে দুটো শিফটেই কাজ হয়ে যাবে। ন্যূনতম মজুরি ৮ ঘণ্টার ভিত্তিতে ধার্য হয়। কিন্তু এই মজুরি কোডের বলে শ্রমিককে ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা কর্মক্ষেত্রে আবদ্ধ রাখা যাবে। তা ছাড়া সমকাজে সম মজুরির বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে কম মজুরিতে অসংগঠিত শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যা বিরাটভাবে বৃদ্ধি পাবে।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, তার সরকারি স্বীকৃতি, প্রতিনিধিত্বের অধিকার, দরকষাকষির অধিকার, আন্দোলনের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন স্বশাসন (অটোনমি)-এর অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তা কার্যত ট্রেড ইউনিয়নের সমস্তরকম স্বাধীনতা হরণ করবে।
স্থায়ী কাজে স্থায়ী নিয়োগের ধারণাকে বরবাদ করে নির্দিষ্ট সময়ের শ্রমিক নিয়োগের ধারণা (Fixed-Term employment workman) নিয়ে আসা হয়েছে।
জমি, পুঁজি, যন্ত্রপাতি থাকলেও শ্রম ছাড়া ব্যবহার উপযোগী পণ্য তৈরি হবে না। সেই শ্রমশক্তি ব্যয় করেন শ্রমিকরা। আইন যদি তাঁদের স্বার্থ রক্ষা না করে তা হলে ‘শ্রম কোড’ নাম দেওয়া হল কেন? এই কোডগুলির নাম ‘পুঁজি কোড’ (Capital code) দেওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। শ্রম-সংস্কারের নামে শ্রমখাতে খরচ কমানোর লক্ষ্যে রচিত এই শ্রম কোডগুলি আত্মঘাতী নীতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে।