বিগত প্রায় বছর দুয়েক ধরে করোনা ভাইরাসের জেরে জেরবার আমরা। বলতে পারেন রীতিমতো ভয়ের দিনগুলো কাটিয়ে এখন ফের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছি আমরা। এখন তো লকডাউনও শিথিল হয়ে গিয়েছে। তবু যেন অভ্যাসটা বদলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
লকডাউন না থাকলেও ছুটির ঘোর যেন কাটতেই চাইছে না। সেই আনন্দেই যেদিকে খুশি বেরিয়ে পড়ছে ভ্রমণপিপাসু বাঙালি। কেউ ছুটছেন সাগরে, তো কেউ জঙ্গলে। কারও পছন্দ আবার শুধুই পাহাড়। আর যাঁরা হিমালয়ের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য মনস্থির করেই ফেলেছেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে মহানন্দা (Mahananda) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আপনাদের জানিয়ে রাখি, সবুজে মোড়া এই অরণ্যে কিন্তু আজও একঘাটে জল খায় বাঘ ও হরিণ।
সাধারণত বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ পরিবেশ, তাদের স্বাভাবিক কিংবা বর্ধিত প্রজনন পরিবেশ, বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক সংখ্যা এবং বৃক্ষরাজি কিংবা ঔষধি বৃক্ষরাজির নিরাপদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে সরকার কিংবা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনও এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনাঞ্চলকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ভারতে এই ঘোষণা রাজ্য সরকার করে থাকে।
অভয়ারণ্য ঘোষণা করার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় :
১. ঐ এলাকার বন্যপ্রাণী যেন ধ্বংস না হয়।
২. পশুপাখিদের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কাজ থেকে যেন এই বনাঞ্চল মুক্ত থাকে। পাশাপাশি, বাইরে থেকে শিকারিরা যাতে এই নিরাপত্তা বলয়ে প্রবেশ না করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষিত অঞ্চল রাজ্যের মোট আয়তনের ৪ শতাংশ স্থান অধিকার করে আছে। পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চল রাজ্যের মোট ভৌগোলিক আয়তনের মাত্র ১৪ শতাংশ; যা জাতীয় গড় ২৩ শতাংশের বেশ কম।
মনে রাখবেন, মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য শিলিগুড়ি থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত সুকনা দিয়ে এই অরণ্যে প্রবেশ করতে হয়। একেবারে হিমালয়ের পাদদেশে তিস্তা ও মহানন্দা (Mahananda) নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যে প্রবেশ করলে আপনিও নস্টালজিক হতে বাধ্য।
মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বহুমুখী বনভূমি রয়েছে। পার্থক্য উচ্চতার কারণে এটি প্রধানত নদী, বন থেকে ঘন মিশ্র, মিশ্র-বন, বন থেকে পরিবর্তিত হয়। উচ্চতা এবং বন প্রকারের বৈচিত্র্য স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং সরীসৃপের বিশাল সংখ্যক প্রজাতির অস্তিত্বকে সহায়তা করে। প্রধানত শাল, শিশু, টেক, জারুল বন এখানে পাওয়া যায়।
কীভাবে পৌঁছবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে শিলিগুড়ি পৌঁছতে হবে। সেখানে আপনার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য দেখবেন প্রচুর গাড়ি অপেক্ষা করছে। যে কোনও গাড়িকে বললেই সোজা আপনাকে পৌঁছে দেবে সুকনা অরণ্যের গেটে। শিলিগুড়ি থেকে এই অভয়ারণ্যে পৌঁছতে মাত্র তিরিশ মিনিট সময় লাগে। আর বাগডোগরা থেকে মহানন্দা অভয়ারণ্যে পৌঁছতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তাই বলছি, আলাদা করে পরিকল্পনা না করে বরং শৈলশহরে ঢুঁ মারার পথে টুক করে মহানন্দা (Mahananda) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘুরে আসুন। দেখতে খুব বেশি সময়ও লাগে না।
নেপথ্যের ইতিহাস
প্রায় ১৫৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুকনা অরণ্য ১৯৫৫ সালে গেম স্যাংচুয়ারি হিসেবে পরিচিত ছিল। বাইসন, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীকে রক্ষা করতে ১৯৫৯ সালে এটিকে অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। সর্বোচ্চ ১৩০০ মিটার উঁচু এই বনের ৬০ ভাগ পার্বত্যভূমি এবং বাকি অংশ সমতল।
কী কী দেখবেন
কপাল যদি ভাল থাকে তবে কোনও রকম ভাবে টিকে থাকা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখা পেতে পারেন। কারণ, এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার মহানন্দ (Mahananda) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অন্যতম আকর্ষণ। এ-ছাড়াও দেখা মেলে এশীয় হাতি, বাইসন, দেশি বনশূকর, সম্বর হরিণ, চিতাবাঘ, পাহাড়ি কালো ভাল্লুকেরও। বিভিন্ন মরশুমে এই বনে ভিড় করে বিভিন্ন প্রজাতি ও রংয়ের পরিযায়ী প্রাণী। যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় পর্যটকদের।
মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে কিছু বিপন্ন প্রজাতির মতো অন্তর্ভুক্ত রুফাস-গলায় হার্নবিল, ওরিয়েন্টাল পাইড হর্নবিল, দুর্দান্ত হর্নবিল অন্যদের মধ্যে গিলে ফেলা, দ্রুত, ছোঁড়া, বকবক, যুদ্ধবাজ, বেলন, মিনিভেট এবং সানবার্ড প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাবে।
আবহাওয়া
মহানন্দা (Mahananda) বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, প্রধানত তিনটি ঋতু, গ্রীষ্ম, শীতকালীন এবং বর্ষাকালে পাওয়া যায়। শীতকালে, তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে আসে যেখানে গ্রীষ্মকালে এটি ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। কিন্তু গড় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ভারী বৃষ্টিপাত অঞ্চলের অন্তর্গত। মে মাস থেকে অক্টোবর মাস বর্ষাকাল হিসাবে পরিচিত এখানে। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩০০ সেমি।
কোথায় থাকবেন
মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বা সুকনা বন ঘুরে দেখতে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এর জন্য নিকটস্থ হোটেল বুকিংয়ের প্রয়োজন নেই। তবে জঙ্গলে রাত কাটাতে চাইলে সেনার কাছ থেকে আগেভাগে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।
আরও পড়ুন: কেন্দুপাতার সংগ্রহমূল্য বাড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী, আদিবাসীদের জীবিকার নতুন দিশা
বিশেষ গুরুত্ব
মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, হাতি মাইগ্রেশন রুটের কাছে অবস্থিত। বর্ষা এবং শীতকালে, এখানে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী হাতির আশ্রয়স্থল রয়েছে। তাই, অন্ধকারের পরে আশ্রয়স্থল পরিদর্শনের জন্য নিরাপদ নয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারণে ভারতের অরণ্য মানচিত্রগুলিতে এই আশ্রয়স্থলটি অসাধারণ গুরুত্ব পেয়েছে। মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং গৌর (ইন্ডিয়ান বাইসন)-এর জন্য সংরক্ষিত। সেই প্রাণী ছাড়াও আশ্রয়স্থলটি আছে চিটাল (ঘূর্ণমান হরিণ), হরিণ, সুগন্ধি, পঙ্গোলিন, সবার, রিশাস বানর, হিমালয় কালো বিড়াল, মাছ ধরার বিড়াল এবং জঙ্গল বিড়ালের মতো ছোট বিড়ালের বহু প্রজাতি, হিমালয় কালো বিয়ার, চিতাবাঘ-সহ মেঘলা চিতাবাঘ, এবং অন্যান্য ছোট ছোট প্রাণী যেমন বিরল পর্বত ছাগল (সারো), পোর্কিউইন, বন্যশূকর, সিভেট, মনিটর গিরিখাত, সাপ ইত্যাদি। এ-ছাড়াও আপনি এই আশ্রয়স্থলটিতে কিছু রেশাস বানর খুঁজে পেতে পারেন।
এবার চলুন এখান থেকে ঘুরে আসা যাক চাপরামারি অভয়ারণ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে ঘুরতে খুব একটা পকেটে টান পড়ে না।
কীভাবে যাবেন
চাপরামারি যাওয়ার নিকটবর্তী রেলস্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি এবং নিউ মাল স্টেশন। শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। নিকটবর্তী বাস টার্মিনাস তেনজিং নোরগে আর নিকটবর্তী বিমানবন্দর বাগডোগরা।
পড়ন্ত বেলায় আদিবাসী নাচ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। চাপরামারি ওয়াচটাওয়ার থেকে প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারবেন।
অবস্থিতি
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির অন্তর্গত চালসা এবং লাটাগুড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত চাপরামারি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। চালসা থেকে নাগরাকাটা যাওয়ার পথে ১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে মূর্তি নদী পেরিয়ে দুই দিকে যে অরণ্য চোখে পড়বে, সেটিই জানবেন আপনার গন্তব্য।
কীভাবে পৌঁছবেন
শিলিগুড়ি থেকে সড়কপথে চাপরামারি যান। শিলিগুড়ি থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে মাত্র দু ঘণ্টা সময় লাগে। কেউ কেউ ট্রেনে সরাসরি মালবাজার স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে চাপরামারি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে পৌঁছন।
ইতিহাস
জলপাইগুড়ির অন্তর্গত এই স্থান ১৮৯৫ সালে অরণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৩৯ সালে এর নাম হয় চাপরামারি ওয়াইল্ডলাইভ রিজার্ভ। ১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই জঙ্গলকে জাতীয় বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের মর্যাদা দেয়। যার অধীনে রয়েছে ৯৬০ হেক্টর সবুজ বন।
কখন যাবেন
বর্ষার কারণে জুলাইয়ের মধ্যভাগ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত অরণ্য বন্ধ থাকে। বাকি সময় জঙ্গলের শোভা দর্শন করতে পারেন পর্যটকরা। তাই মে মাসের শেষের দিক থেকে জুন মাসে পর্যটকরা বেশি ভিড় করেন।
কী কী দেখবেন
এশীয় হাতি, বাইসন, সম্বর হরিণ, চিতাবাঘ এবং বন্যশূকর চাপরামারি অভয়ারণ্যের মূল আকর্ষণ। কোনও কোনও পর্যটক অবশ্য দাবি করেন, ঘন জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে থাকে বাংলার বাঘও। যদিও সচরাচর লোকালয়ে তাদের দর্শন মেলে না। বরং জঙ্গল ছেড়ে মাঝেমধ্যেই জনারণ্যে বেরিয়ে আসে হাতি, বাইসন কিংবা চিতা। গা-ছমছম করা এই অরণ্যে বিভিন্ন মরশুমে পরিযায়ী পাখিরাও ভিড় করে। জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা ওয়াচটাওয়ার থেকে বন্যপ্রাণীর দর্শন মন মোহিত করে। গাড়িতে জঙ্গল সাফারি করে থাকেন অনেকে।
চাপরামারি অভয়ারণ্য ভ্রমণের ডে ভিজিটে পাশ সংগ্রহ করতে পারেন বনবিভাগের ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার লাটাগুড়ি থেকে।
অভয়ারণ্যে থাকার জন্য যোগাযোগ : ডিএফও,
বৈকুণ্ঠপুর ডিভিশন, হসপিটাল মোড়, শিলিগুড়ি।