হতে চেয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী। হয়ে গেলেন ক্রিকেটার। মিতালি রাজ। মহিলা ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকর। মিতালির খেলাধুলার শুরু ১০ বছর বয়সে। তবে তখন তাঁর শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধুই ভরতনাট্যম। চেয়েছিলেন, সারা দুনিয়া তাঁকে চিনবে এই নাচের জন্য। তবে মঞ্চে নয়, তিনি প্রতিষ্ঠা পেলেন সবুজ মাঠের বাইশ গজে। এই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারের নামের আগে আজ বসে গেছে কিংবদন্তি তকমা।
বাবা দরাই রাজ ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁরা বেশ কিছুদিন ছিলেন রাজস্থানের যোধপুরে। সেইসময় জন্ম হয় মিতালির। ১৯৮২-র ৩ ডিসেম্বর। এই তামিল পরিবার ছিল রীতিমতো সচ্ছল। মিতালির স্কুল জীবন কেটেছে হায়দরাবাদে। পড়াশোনা এবং নাচের পাশাপাশি স্কুল জীবনেই তিনি ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তখন মহিলা ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয় হয়নি। সেইসময় বাইশ গজে নিজেকে মেলে ধরে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অন্যদের তুলনায় মিতালি ব্যাট-বল হাতে এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, স্কুলে পড়ার সময় তিনি দাদার সঙ্গে কোচিং করাতেন। সমবয়সিরাও রীতিমতো সমীহ করতেন তাঁকে। মেনে চলতেন সমস্ত নির্দেশ। সময়টা দারুণ উপভোগ করতেন মিষ্টি মুখের মিতালি।
আরও পড়ুন-সুব্রত মুখোপাধ্যায় মানেই আন্দোলন
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নাম পৌঁছে যায় উপর মহলে। ভারতীয় ক্রিকেটের কর্মকর্তারা বোলারদের উপর তাঁর সংহারমূর্তি দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যান। মিতালির সুযোগ এসে যায় ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে। ১৯৯৯-র ২৬ জুন। ১৭ বছরের মিতালির গায়ে ওঠে টিম ইন্ডিয়ার জার্সি। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিকে হয় তাঁর রাজকীয় অভিষেক। সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে তিনি অপরাজিত ছিলেন ১১৪ রানে।
টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয় ২০০২-র ১৪ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। খেলেছেন টি-২০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও। দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলকে। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট আজ যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তারজন্য মিতালির অবদান কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
রং কিছুটা চাপা। বাইশ গজের শ্যামাসুন্দরী। তবে তিনি টোল খেলানো হাসি ছড়ালে ঢেউ খেলে যায় গ্যালারিতে। তাঁর চরিত্রে দেখা যায় অদ্ভুত বৈপরীত্য। একদিকে মিষ্টভাষী, অন্যদিকে নিষ্ঠুরভাবে করেন বোলার-শাসন। চার, ছক্কার ফোয়ারা ছুটিয়ে মুঠোয় পুরেছেন একটার পর একটা সেঞ্চুরি। উঠে বসেছেন রানের পাহাড়ে। ২২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি পেরিয়েছেন ১০ হাজার রানের সীমা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিছুদিন আগেই টপকেছেন ২০ হাজার রানের মাইলফলক। মহিলা ক্রিকেটারের মধ্যে এই কৃতিত্ব আর কারও নেই। সম্প্রতি তিনি গড়েছেন আরও এক নজির। টানা পাঁচ ম্যাচে করেছেন হাফ সেঞ্চুরি।
এই মহিলা অলরাউন্ডার ডান হাতে ব্যাট করার পাশাপাশি করেন ডান হাতে লেগ ব্রেক বোলিং। সময় বিশেষে পটাপট তুলে নেন উইকেট।
বাইশ গজের এই রানি বিতর্কে জড়িয়েছেন বহুবার। ২০১৮ সালে টি-২০ বিশ্বকাপের সময় তিনি কোচ রমেশ পাওয়ারের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ আনেন। চিঠি লেখেন বিসিসিআই কর্মকর্তাদের। পাল্টা দেন রমেশও। বলেন, মিতালি উদ্ধত। ব্যাটিং অর্ডারে নিচে নামতে বলায় তিনি অবসর নেওয়ার হুমকি দেন। টি-২০ দলের বর্তমান অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌরের সঙ্গেও নাকি মিতালির সম্পর্ক মধুর নয়।
তবে এইসব বিতর্ক বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি তাঁর কেরিয়ারে, ভক্তদের মনে। ভারতের পাশাপাশি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অগণিত ভক্ত। মিতালির জনপ্রিয়তা এবং বৈচিত্রপূর্ণ জীবন দেখে বলিউড পরিচালক রাহুল ঢোলাকিয়া তৈরি করছেন তাঁর বায়োপিক ‘সাবাস মিঠু’। নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন তাপসী পান্নু। সেই নিয়েও বাজার সরগরম।
আরও পড়ুন-ইন্দিরাজির সঙ্গে সেদিন সেই কপ্টারে
২০০৩ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার, ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী। এইবছর মিতালি পাচ্ছেন ধ্যাঁনচাদ খেলরত্ন পুরস্কার। ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
আশা করা যায় ৩৯ বছরের এই তারকা মহিলা ক্রিকেটার আরও কিছুদিন বাইশ গজ কাঁপাবেন। ঝুলিতে পুরবেন আরও অনেক রেকর্ড। খেলতে খেলতেই তিনি পালন করছেন কোচের ভূমিকা। ভবিষ্যতে মিতালিকে পূর্ণ সময়ের জন্য কোচের ভূমিকায় দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাতে সমৃদ্ধ হবে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট।