সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রে কাঙ্ক্ষিত মৌলিক পরিবর্তন আনতে গেলে মেয়েদের সার্বিক উন্নয়নে নজর দিতে হয়। তাদের একটু একটু করে সুযোগ দিতে হয়। সুযোগ পেলে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবেই। বাংলার দিকে নজর করলে এ-কথা আজ বুকে ঠুকে বলা যায়— মেয়েরা সামগ্রিকভাবে বাংলায় এগচ্ছে। তবে যা আরও জোর দিয়ে বলার মতো তা হল, মুসলিম (Muslim) মেয়েদের নীরব ‘ইনকিলাব’। এটা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান নয়। প্রকৃত অর্থে একটা নীরব বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে সেখানে।
যাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত কেউ লেখাপড়া করেনি, সেই বাড়ির মেয়েরা এমএ পাশ করছে। কম্পিউটার শিখছে। তাদের চিন্তাধারায় আমূল বদল এসেছে। এই বদলের যিনি অন্যতম কারিগর তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বাংলার অতি সাধারণ ছাপোষা বাড়ির মেয়েদের মনেও ভরসা জুগিয়েছেন। অনেকের কাছেই তিনি রোলমডেল। তবে সকলের কাছে তা রাজনৈতিক কারণে নয়। তাঁর ফাইটিং স্পিরিট মেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছে। সে কারণেই মহিলাদের ভোট তাঁর মতো করে আর কেউ পাননি এদেশে। বাংলার একের পর এক প্রকল্প মহিলাদের নামে করে তিনি তাদের আত্মমর্যাদা যেমন বাড়িয়েছেন, তেমনই ভরসা জুগিয়েছেন। চোয়াল শক্ত করে তারা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প করতে সাহস পাচ্ছে তাঁরই ভরসায়।
গাছের গোড়ায় জল না ঢেলে কেবল আগায় ঢাললে কাজের কাজ হয় না। মেয়েরা হচ্ছে সমাজের গোড়া, আজকে যে মেয়েটি সবুজসাথীর সাইকেল নিয়ে স্কুল যাচ্ছে, কয়েক বছর পর সেই মেয়েটিই হবে কারও মা। তার শিক্ষা, চেতনা, ভাষা বহন করবে আর একটি প্রজন্ম। তাই মায়েরা শিক্ষিত ও চেতনাসম্পন্ন না হলে সমাজে উন্নয়নের সূচকে তেজি ভাব আসে না। মুসলিম (Muslim) সমাজে মেয়েদের মনে একটা আত্মবিশ্বাস দিন দিন সামনে আসছে। একেবারে প্রত্যন্ত বাংলাতেও মুসলিম মেয়েরা পড়ছে। মা-মাটি-মানুষের সরকার মেয়েদের জন্য প্রকল্পগুলি এমন সুন্দর করে তৈরি করেছে যে, গরিব অভিভাবকরাও চাইছে মেয়ে পড়ুক। কারণ আজ তারা পড়াশুনো করার জন্য আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে। সরকারি স্কুলে পড়ার খরচ আর নেই। সবুজসাথীর সাইকেল নিয়ে শহুরে আঁতেলরা যতই নাক সিঁটকান, প্রত্যন্ত গাঁয়ের লোকের কাছে সেটি অনেক বড় পাওনা। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, সংখ্যালঘুদের জন্য ‘ঐক্যশ্রী’র মতো প্রকল্পগুলি দারিদ্র্যের অসুখে অব্যর্থ ওষুধের মতো কাজ করেছে।
এপার বাংলায় শিক্ষিত মুসলিমদের (Muslim) একটা বড় অংশ দেশভাগের সময় তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেও শিক্ষিত হিন্দুদের একটা অংশ এই বাংলায় চলে এসেছিলেন। মুসলিমদের (Muslim) মধ্যে যাঁরা এ-বাংলায় থেকে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কিছু মুসলিমের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। তাঁরা শিক্ষিত ছিলেন। খানিকটা সমাজকল্যাণ তাঁরা নিজেদের খরচেই করতেন। বাম জমানায় এই মানুষগুলোর গায়ে বুর্জোয়া তকমা লাগিয়ে নানা মিথ্যা ও কুৎসা রটানো হল। রুশ প্রলেতারিয়েত সংস্করণের একটা পাইরেটেড কপি বানিয়ে ফেলে অশিক্ষিত মুসলিমদের এই শিক্ষিত ও সম্পন্ন মুসলিমদের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া হল। চুরি ও জুলুমকে বৈধতা দেওয়া হল। বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত মানুষকে প্রকাশ্যে অন্যকে মেরে-খাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হল। নৈতিকশিক্ষা, ধর্মীয়শিক্ষা কিংবা স্কুলশিক্ষা— কোনওটাকেই তারা তেমন আমল দিত না। সেই আবহে মুসলমান পরিবারের ছেলেরা কিছুটা লেখাপড়া করলেও মেয়েদের নিয়ে তেমন ভাবনা-চিন্তা অভিভাবকদের মধ্যে দেখা যেত না। মেয়ে মানে, তার বিয়ে দিতে হবে, এটাই ছিল প্রধান ভাবনা।
আরও পড়ুন: মুখ বদলালেই কঙ্কাল বদল হয় না: কুণাল
সিপিএম-আমলের শেষের দিকে একটু একটু করে মিশন আন্দোলন সামনে আসে। শিক্ষানুরাগী শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের আর্থিক আনুকূল্যে এবং এম নুরুল ইসলামের দূরদৃষ্টি ও দক্ষতায় আল-আমীন মিশন সফল হয়। তারই সূত্র ধরে মেয়েদের মিশন পথ চলা শুরু করেছে। পাশের ঘরের খেটে খাওয়া মানুষটির সন্তান ডাক্তার হলে আমার মেয়ে পারবে না কেন? এমন একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে মুসলিম পরিবারগুলোর ভেতর। ধীরে ধীরে শিক্ষাকে প্রত্যন্ত পরিবারের গ্রামের মুসলিমরা সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অবলম্বন বলে ভাবতে শুরু করেছেন। মুসলিম সমাজে শিক্ষায় যতটা জোর একজন ছেলের ওপর দেওয়া হচ্ছে ঠিক ততটাই জোর দেওয়া হচ্ছে মেয়ের ওপর।
একদিকে মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রকল্পের সুবিধা, অন্যদিকে চেনা সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ও অধ্যাপকদের দেখতে পেয়ে মুসলিম ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও উৎসাহ পাচ্ছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বহু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা ঠিকানা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিকাশ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের হাত ধরে। সবথেকে আশার কথা হল এই ছাত্রীরা দিশাহীনভাবে ডিগ্রির অন্বেষণ করছে না। তারা নিজেদের পেশা নিয়ে ভীষণ সচেতন। দূরদূরান্ত থেকে তারা আলিয়ায় পড়তে আসছে। মেয়েদের পড়ার জন্য সরকার হোস্টেলও গড়ে দিয়েছে। কলকাতা শহরে থেকে তারা পড়াশুনা করছে। নিজের এবং এবং খেটে খাওয়া বাবা-মার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে। তার মাঝে জাদু বটিকার মতো কাজ করেছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প। গরিব মহিলার কাছে বছরে ৬ হাজার টাকা অনেক টাকা। মমতা এই টাকাকে মহিলাদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে জুড়তে পেরেছেন। এ টাকা যেন তাদেরই হকের টাকা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘রেলের প্রথম শ্রেণীর কামরা প্ল্যাটফর্ম ছুঁলে তৃতীয় শ্রেণীর কামরাও ছোঁবে। সেটাই বাস্তব। হয়ত একটু দেরি হয়।’ এক্ষেত্রে শিক্ষায় মুসলিমদের এগিয়ে আসায় খানিকটা দেরি হয়েছে। তবে তফসিলিদের উন্নয়নের লেখচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে তাকে তেমন একটা দেরি বলে মনে হবে না।
সবকিছুর উপরে হল বিশ্বাস। আজও বাংলার অধিকাংশ মুসলিম বিশ্বাস করেন বাংলা, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী হবে না। বাংলা মধ্যপ্রদেশের খারগন হবে না। বাংলায় বুলডোজার রাজনীতি জায়গা পাবে না। বাংলায় সম্প্রীতির যে পরিবেশ রয়েছে ঔদ্ধত্যপূর্ণ হুজুগে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। যেকোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসার পিছনে নিরাপত্তার আশ্বাস খুব জরুরি। তা না হলে মনে হতেই পারে ডাক্তার হয়ে হবেটা কী, যদি প্রাণটাই না থাকে কিংবা যদি বুলডোজার দিয়ে দোকানটা কিংবা ঘরটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়? সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেকোনও সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য সংখ্যালঘুর কাছ থেকে এই ভরসাটুকু জিতে নেওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেটা পেরেছেন। বেশি করেই পেরেছেন। বিরোধীরা যা-ই বলুক, মা-মাটি-মানুষের আমলে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা এগোচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের চরৈবেতি সত্যিই চর্চার দাবি রাখে ।