সম্প্রতি পার করলেন বিরাশি বছরের জন্মদিন। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘বব বিশ্বাস’, পেতে চলেছে ‘টনিক’, শুটিং শেষ হল ওয়েব সিরিজ ‘শব চরিত্র’ এবং প্রতিটা চরিত্র আলাদা, অনন্য। জীবনভর অভিনয় নাকি অভিনয়ই জীবন? কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
পরান : বড় মন কাড়া প্রশ্ন এটা। দুটোই সত্য। অন্তত আমার জন্য। জ্ঞান হওয়া ইস্তক, যখন জানতাম না অভিনেতা হব, তখন থেকেই আশপাশের মানুষের হাঁটাচলা-কথা বলা লক্ষ করতাম, নকল করতাম। পুরোটাই খেয়াল। কারণ সেই বয়সে আমি সচেতন ছিলাম না অভিনয় সম্পর্কে। কিন্তু ব্যাপারটা মজ্জায় মিশে রয়েছে তার মানে জীবনভর আবার অভিনয়ই জীবন কি না যদি জানাতে হয়, তাহলে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়-সন্দেহ ছাড়াই বলতে চাই, হ্যাঁ, তাই। আমার প্রথম প্রেম, প্রণয়, আমার অস্তিত্ব হল অভিনয়।
আরও পড়ুন-পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য, মৃত্যুর তদন্ত করবে সেনার তিন শাখা
শুরু করেছিলেন ‘আইপিটিএ’-এতে অভিনয় দিয়ে, দেব-এর সঙ্গে জুটিতে আগামী ২৪ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে ‘টনিক’। জার্নিটা কেমন ছিল?
পরান : যেহেতু আগেই বললাম আমার অস্তিত্বই হল অভিনয়, তাই মানুষ হিসেবেই হোক বা অভিনেতা, জার্নিটা আমার কাছে সব সময়ই উপভোগ্য ছিল। তার কারণ চাওয়া-পাওয়া নয়, আমি পথচলায় বিশ্বাসী। শুধু চলাটা সিনসিয়ারলি চলতে হয়েছে। কারণ অভিনেতা হয়তো বা চেষ্টা করলে হওয়া যায়, শিল্পী হওয়া সহজ নয়। সব অভিনেতা কিন্তু শিল্পী নয়! শিল্পী হতে গেলে অভিনেতাকে টপকে যেতে হয়। অভিনেতা অনুকরণশিল্পী কিন্তু শিল্পীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সৃজনশীলতা। তাই অভিনেতা সত্তাটিকে পরিচ্ছন্ন রেখে সর্বদা ধ্যানে থাকতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়। শিল্পী একবার হয়ে যেতে পারলে কী হয়, আর অনুকরণ করতে লাগে না! এরপর যা করবে তা তার নিজস্ব সৃষ্টি। এই পুরোটা একটা উত্তরণ। পুরোটা একটা জার্নি। তাই থিয়েটার দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে সিনেমা, সিরিয়াল, সিরিজ সবটাই আমার জার্নির অংশ। আমি সমৃদ্ধ হয়েছি, হয়ে চলেছি।
এই দীর্ঘ জার্নিতে শিক্ষক কেউ ছিলেন যিনি সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছিলেন?
পরান : ছিলেন তো! আমি খুব কনফিডেন্টলি বলি, আমার শিক্ষক হলেন মানুষ! অগুণতি মানুষ। তাঁদের থেকেই তো আমি শিখেছি। সেই সঙ্গে সমাজ সম্পর্কে সচেতন থাকাও শিক্ষার একটা অংশ। প্রত্যেকটা চরিত্র তো সমাজ থেকেই নেওয়া। মিথ্যাচার কতভাবে হয়, মাতাল কতরকমের হয়, পাগল কতরকমের হয়, ঝগড়ার কত প্রকারভেদ হয় এসব ওই কৈশোর বয়স থেকেই আমি লক্ষ করতাম বলে, আয়ত্তে আসাটা পরবর্তীতে অনায়াস হয়েছে। আসলে মানুষকে ভালবাসতে হবে। ভাল না বাসলে তাদের আশীর্বাদ পাওয়া যাবে না। আর মানুষের আশীর্বাদ ছাড়া পরিপূর্ণ শিল্পী হওয়াও যাবে না!
আপনি মানুষের কাছে এত বাধিত, বিনীত, এ অনুভবও কি নিজের ভেতর থেকেই পেয়েছেন?
পরান : শুরুটা পেয়েছি মানুষের সঙ্গে মিশে, তাদের মধ্যে থেকে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ করতাম। গ্রামে গ্রামে নাটক করতাম। প্রান্তিক মানুষের অফুরন্ত ভালবাসা যেমন পেতাম তেমনই পেতাম অফুরন্ত চরিত্র দেখার সুযোগ। সেই সব মানুষেরাই ক্রমশ আমাকে বিনীত করল, আমি বাধিত হলাম। যখন মঞ্চে অভিনয় করি, আমি এখনও আমাদের দলের ছেলেদের বলি, দর্শক হলেন আমাদের দেবতা। শিল্পীর শুদ্ধ বস্ত্র পরে আমি সেই দেবতাদের পূজায় বসি। দর্শক সন্তুষ্ট হলে আমার উন্নতি অনিবার্য, অসন্তুষ্ট হলে আমার পতন অনিবার্য। একটু হাই-সাউন্ডিং শোনাবে হয়তো, কিন্তু এগুলো আমার অন্তরের কথা। বিশ্বাসের কথা।
সিনেমায় অভিনয় করাটা কি ভবিতব্য ছিল? নাকি ধাপে ধাপে এখানেই পৌঁছতে চেয়েছিলেন?
পরান : না, না, আমি এভাবে ভাবিই না। আমি নিজেকে ভাবি একজন পথিক। জীবনের পথ হেঁটে চলেছি। এবার পথিমধ্যে কখনও নুড়ি-পাথর, কখনও মণি-মুক্তো যা পাচ্ছি কুড়িয়ে ঝুলি ভরছি। কখনও কুড়োতে গিয়ে আহত হচ্ছি, কখনও আনন্দিত। কিছু পেতে হবে বা কোথাও পৌঁছতে হবে এই লক্ষ্য কোনওদিন মনের মধ্যে ছিল না আমার।
তার মানে সমাপতন?
পরান : সেটা বলাই ভাল। ১৯৭৫ এ পরিচালক অজিত গাঙ্গুলি আমার একটা রেডিওর অভিনয়সূত্রে তাঁর ছবিতে আমাকে দিয়ে প্রথম পার্ট করান। সেই শুরু। তখন আমি নিয়মিত রেডিওতেও অভিনয় করতাম থিয়েটারের পাশাপাশি। আমার দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘চেনা অচেনা’, পুরস্কারও পেয়েছিলাম তার জন্য। সেটা আমায় খুব উৎসাহিত করল। হাজার হোক নতুন একটা মাধ্যম, মনে হল, তার মানে এখানে আমি পারব!
পারবেন মানে, সেই সময় একসঙ্গে থিয়েটার, পিডব্লুডি’র চাকরি, সংসার সব সামলে পরান বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সিনেমার সমুদ্রে ডিঙি ভাসালেন এবং সময়ের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম মাইলস্টোন অভিনেতা হয়ে উঠলেন।
পরান : সব তোমাদের ভালবাসা, আর মানুষের আশীর্বাদ।
‘টনিক’ও মানুষের বিপুল ভালবাসা পেতে চলেছে, ট্রেলরে আপনার আর দেবের রসায়ন দেখেই সবাই বলছে।
পরান : দেব দুর্দান্ত। এটা বলতে পারি। এরকম চরিত্র ও আগে কখনও করেনি। আর যেটা বলার সেটা হল দেবের উপস্থিতিটা শুধু সিনেমাতেই নয়, বাস্তবেও টনিকের মতোই। একটা ম্যাজিক আছে ওর ভেতর যার টানে সবাইকে এক কাছে করে নিয়ে চলতে পারে। ছবিটা বড় ক্যানভাসে ভাবা। একটা ইচ্ছেপূরণের গল্প। আমার নিজেরও অভিনয়ের এত সুযোগ আছে যে মনের সুখে অভিনয় করতে পেরেছিলাম অনেকদিন পর। পুরো টিমটাই দারুণ প্রশ্রয় দিয়েছিল আমায়। ‘টনিক’ নিশ্চিতভাবে সব বয়সি মানুষের কাছে উপভোগ্য হবে।
আরও পড়ুন-বাবুল-মনোজ দ্বৈরথ দিয়ে আজ শুরু MP CUP
অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে অভিনয় কেমন উপভোগ করলেন?
পরান : বেশ ভাল। ‘বব বিশ্বাস’-এ ওর সঙ্গে দিন দুই-তিন অভিনয় ছিল আমার। ভদ্র, হাসি-খুশি ছেলে। সাধ্যমতো নিজের মতো করে অভিনয়টা করে। বাংলা বুঝলেও বলতে তো পারে না, তাই আড্ডা যাকে বলে সেসব খুব বেশি হয়নি। কিন্তু ভাল লেগেছে ওর ব্যবহার।
এই মুহূর্তে আর কী কী ছবি করছেন?
পরান : শমীক রায়চৌধুরীর ‘বেলাইন’ এর শুটিং শেষ করলাম সদ্য। আর কিছু কথা পাকা হয়ে আছে। শুরু
হলেই বলব।