আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’
বাণীর বীণা মোর পাশে,
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে,
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!।
জনসংস্কৃতি এবং জনগোষ্ঠীর যাপনের পরতে পরতে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির জীবনের সঙ্গে নজরুল জড়িয়ে রয়েছেন ওতপ্রোতভাবে। তাঁর গান-কবিতা ছাড়া বাঙালির রাজপথ থেকে শুরু করে উৎসবাদি, এমনকী প্রেমিকের আর্তি পর্যন্ত যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
কবির কথা
বাংলার হৃদয়ের অপর এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বের কবি কাজী নজরুল ইসলামের (Poet Kazi Nazrul Islam) ১২৩-তম জন্মবার্ষিকী ২৫ মে, ২০২২ (মতান্তরে, ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলাদেশ, ঢাকা)।
একই সঙ্গে এ বছর পূর্ণ হল তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ (Poet Kazi Nazrul Islam) রচনার শতবর্ষ। অজস্র গানে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীত-ভুবন। প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা গজল। কবিবর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামেই খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলেই মনে করা হয়।
১৯২৯ সালে কলকাতার আলবার্ট হলে— বর্তমান কফি-হাউস— তাঁকে জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নজরুলকে (Poet Kazi Nazrul Islam) ‘বাংলার কবি, বাঙালি কবি’ বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, ওই সময়ের বাঙালির আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল নজরুলের কবিতায়। তাঁর কবিতা বাঙালির জড়-জীবনে গতি এনেছিল। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল বাঙালিকে রাজপথে নামিয়ে এনেছিল। প্রেমেন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন, ‘ঘরে-বাইরে, মাঠে-ঘাটে, রাজপথে, সভায় এ কবিতা (বিদ্রোহী) নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত-শত পাঠক পড়েছেন।’ ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি সেদিন নজরুলের গান-কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনো তাঁর গান গাইব।’ আর আদতে তাই-ই হয়েছিল।
আমরা যে নজরুলকে চিনি, সে নজরুল (Poet Kazi Nazrul Islam) একজন স্বঘোষিত আইন না-মানা আউটলয়েড দুর্দম কবি। যিনি বিদ্রোহী, কামাল পাশা, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, আনন্দময়ীর আগমনির মতো কবিতা রচনা করে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন; ব্রিটিশ-শাসনের কোপানলে কারবরণ করেছিলেন, কারাভ্যন্তরে কয়েদিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অনিয়মের প্রতিবাদে ঊনচল্লিশ দিন অনশন পালন করে নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন; আবার কবি জীবনের শুরুতে পল্টনে যোগদান করে বাঙালির যুদ্ধে না যাওয়ার অভিযোগের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলেন।
আবার তিনিই কবি হিসাবে ছিলেন বসন্তের কন্টিবিউটর। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন, ‘নজরুল নিজেই বসন্ত; যে-সে বসন্ত নয়, জাতির জীবনের বসন্ত।’ সত্যিই, রোম্যান্টিক কবি-মানসের এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিলেন কবি নজরুল।
নজরুলের ব্যক্তি জীবনের মতো তাঁর কবি-মানসেও নারী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে নারীদের অবদান যে বেশ অর্থবহ তা কবিও সরলচিত্তে স্বীকার করেছেন।
১৯৩৭ সালের ১ অগাস্ট কবি তাঁর প্রথম স্ত্রী নার্গিস আসার খানমকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত; কি অসীম বেদনা। …তুমি এই আগুনের পরশ-মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না।’
কবি নার্গিস-বিচ্ছেদকে সঙ্গী করে অগ্নিবীণা’য় পৌঁছেছেন। নজরুলকে ‘কবি নজরুল’ হিসেবে গড়ে তুলতে নারীর প্রেম, বিরহ যে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে তা বলার অপেক্ষা আজ আর নেই। নারীর বিরহদহনে জ্বলে-পুড়ে পুরুষ যেমন নতুন করে সৃষ্টি হয়, তেমনি আবার নারীর প্রেম-ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পুরুষ লাভ করে নবজন্ম— এটাই জগতের নিয়ম। তাই কবির উক্তি : ‘নারীর বিরহে নারীর মিলনে নর পেলো কবি প্রাণ/ যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
নজরুল ও তৎকালীন সমাজ
তৎকালীন সমাজে নারীদের অবদান স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু কবি নজরুল পুরুষদের সর্বেসর্বা মনোভাবকে দলিত করে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন এক অমোঘ সত্য; দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী— ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নজরুলের নারীবিষয়ক যেসব কবিতা রয়েছে তার মধ্যে সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘নারী’ কবিতাটি বেশ আলোচিত। তৎকালীন সময়ে এই কবিতাটি রক্ষণশীল পুরুষ মহলেও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। কবিতায় কবি চেয়েছেন নারীরা জেগে উঠুক। ভাঙুক তাদের কয়েকশো বছরের দীর্ঘ ঘুম। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে শিকল বয়ে চলছে নারী, তা ছুঁড়ে ফেলা হোক বহুদূরে। কবি মনে করেছেন, ‘বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,/ কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।’
নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি নজরুল যে কতটা উন্মুখ অধীর ছিলেন তার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়। অনৈতিকতার শাস্তি কেবল নারীরা পাবে, পুরুষরা তার ধারও ধারবে না— নজরুল ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। তাই কবির ঘোষণা— ‘শুন ধর্মের চাঁই/ জারজ-কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রভেদ নাই!/ অসত্য মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়,/ অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’ কবি উপলব্ধি করেছেন নারীর অবদান স্বীকৃত হয় না। গণনা হয় না। ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না নারীর অনুপ্রেরণা, অবদান, চিরায়ত মহিমা।
নারী ও নজরুলের কবিতা:
নারীদের সমানাধিকার ও নারী-ক্ষমতায়নের কথা নজরুল আরও কয়েক দশক আগেই তাঁর কবিতায়-কাব্যে বলে গিয়েছেন। এমনকী নারীদের সব ক’টি রূপকেই সচেতনভাবে তাঁর কবিতায় স্থানও দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় যেমন নারীর সমানাধিকারের দাবি এসেছে, তেমনি সেই একই কলমে তিনি এঁকেছেন মাতৃরূপী নারীর মমতাময়ী স্নেহ, প্রেমময়ী নারীর প্রেমমূর্তি, বিরহের রুদ্র-প্রতাপের প্রতিচ্ছবি। নারীর বধূরূপ, কন্যারূপ, নারীর অসহায়ত্ব, গ্লানি, বঞ্চনা, নারীর উল্লাস, আনন্দ— সবকিছুই তিনি দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন। কখনও কখনও ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যে সিক্ত হয়েছেন কবি। তাঁর বিদ্রোহ : ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন মন উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশির। (বিদ্রোহী, অগ্নি-বীণা)।’
নজরুলের কবিতায় বিশেষ করে ‘নতুন চাঁদ’ এবং ‘আমার কবিতা তুমি’ কবিতায় নারী সৌন্দর্যের সঙ্গে স্রষ্টা, সৃষ্টি, প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নজরুলের কবি জীবনের পরিপূর্ণতায় নারীদের ভূমিকা যে অগ্রগণ্য তা আমরা জানি। বিশেষ করে নার্গিস-আসার-খানম, ফজিলাতুন্নেসা, জাহানারা চৌধুরির হৃদয়ের সংস্পর্শে এসে নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ সৃষ্টির স্রষ্টা রূপে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কবি তাঁর বহু কবিতায় তাঁর প্রিয়ার অবদান জানিয়েছেন। কিন্তু কবি বিদ্রোহী হলেও ছিলেন প্রেমিক হৃদয়ের অধিকারী, প্রেমের কাঙাল।
কবি মনে করেন, তাঁর জীবনে ‘প্রিয়’ নামক নারীটি না থাকলে তিনি কবি হতে পারতেন না। কবির উক্তি— ‘…আমার বাণী জয়মাল্য, রাণী! তোমার সবি।/ তুমি আমায় ভালোবাসো, তাইতো আমি কবি।/ আমার এ রূপ,— সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।’ (কবি-রাণী, দোলন-চাঁপা)।
নজরুলের কবিতায় উঠে এসেছে সহজ-সরল নারীদের জীবনবর্ণনাও। ‘বেলা গেলো বধূ’ ভাসে ননদী,/ ‘চলে জল নিতে যাবি লো যদি।’ এভাবেই বধূ, ননদীর দৈনন্দিন জীবনচারিতা ‘বসিয়া বিজনে একা মনে’ কবিতায় নজরুলের মাতৃভক্তির বর্ণনা, জীবনদর্শনও ছিল উল্লেখ করার মতো।
কবি ব্যক্তি-জীবনে অনেক নারীর সান্নিধ্যই পেয়েছেন, যাঁরা ছিলেন তাঁর মাতৃসম। কবি তাঁদের ‘মা’ বলে জ্ঞান করতেন। তাঁদের স্নেহ-মমতায় পূর্ণ হয়েছে কবি হৃদয়। কবি মাতৃহৃদয়ের আলোকেই বিশ্বকে চিনেছেন— ‘তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু/ মাতা তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী।’
তেমনি অসহায়, দুঃস্থ নারীদের জন্য কবি হয়েছেন শোকাতুর, সহমর্মী। এজন্য কবি স্পর্ধা করতেও ছাড়েননি। দুই নারীর নিদারুণ কষ্টে, অসহায়ত্বে ‘ফণি-মনসা’ কাব্যের ‘সত্য কবি’ কবিতায় কবির স্পর্ধা— ‘ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দুটি নারীর পানে?/ জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে!’
প্রেমের কবি নজরুল
প্রেমের কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এটা স্বীকার্য যে, প্রেমের কবিতায় তাঁর তুলনা নেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রেমে পড়েছেন বারবার। কবি যাঁদের প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে লিখেছেন গান, কবিতা আর প্রেমপত্র ; যা আজ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
আরও পড়ুন: তথ্যচিত্রে পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, এমন তরণী বাওয়া
এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। সৈয়দা খাতুনকে ভালবেসে কবি তাঁর নামও বদলে ফেলেন। নতুন নাম দিলেন নার্গিসের। কিন্তু সেই নার্গিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মিলনের পূর্ণতা পায়নি। বিয়ের রাত না ফুরাতেই বিদায় নিয়েছিলেন নজরুল। বলে গিয়েছিলেন শ্রাবণ মাসে ফিরবেন। কিন্তু কত কত ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না।’ নজরুল তখন প্রেমে পড়েছেন দোলনচাঁপার। কুমিল্লার দৌলতপুর থেকে কান্দিরপারের দূরত্ব আর কতটুকু। কিন্তু নার্গিস চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তাঁর বঁধুয়া আনবাড়ি গেলেন তাঁরই ‘আঙিনা দিয়া’। প্রথম প্রণয়িনীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কটি এ রকমই এক অপূর্ণতার হাহাকারে ভরা। ১৯২১ সালে ছেড়ে এসেছিলেন নার্গিসকে, ১৯২৪ সালে বিয়ে করলেন প্রমীলাকে।
আমাদের প্রিয় কবির নামের আগে ‘বিদ্রোহী’ তকমা জুড়ে দিলেও তিনি নিজেই কিন্তু ঘোষণা করেছিলেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী’। কৃষ্ণের বাঁশরী শুনে রাধার জগৎসংসার যে মাথায় উঠবে, এটাই তো চিরন্তনের গল্প। নজরুলের জীবনেও তাই নানাভাবে এসেছেন নারীরা। কখনও রানু সোম (প্রতিভা বসু), কখনও নোটন মৈত্র বা জাহানারা চৌধুরি, শিল্পী কানন দেবীর সঙ্গে তাঁর তৈরি হয়েছে নানা মাত্রার সম্পর্ক। এসব সম্পর্কে তিনি জড়িয়েছেন সহজে, আবার বাঁধন ছেঁড়ার সহজাত নৈপুণ্যে বেরিয়েও এসেছেন। শুধু কিছু অসাধারণ গান ও কবিতা এসব সম্পর্কের সাক্ষী হয়ে স্থায়ী থেকে গিয়েছিল পাঠক-শ্রোতার হৃদয়ে।
আবার ফজিলাতুন্নেসার ব্যাপারটি অন্য রকম। এই একটি সম্পর্ক রূঢ় প্রত্যাখ্যানের রূপটি চিনিয়েছিল কবিকে। সমুদ্রের ঢেউভাঙা জলের মতো নজরুলের নিবেদন স্পর্শ করতে চেয়েছে ফজিলাতুন্নেসার চরণ, কিন্তু কী আশ্চর্য উপেক্ষার শক্তি ছিল শ্যামাঙ্গী তরুণীর! তিনি ফিরে তাকালেন না, বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-অবহেলায় ক্ষত-বিক্ষত করেছেন কবির হৃদয়!
ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী। বাবার আর্থিক সংগতি না থাকলেও ফজিলাতুন্নেসার জীবনের লক্ষ্য যেমন ছিল সুদূর, তেমনই সেই লক্ষ্য পূরণে তাঁর সাহস ও একাগ্রতাও ছিল বিস্ময়কর।
এতকাল যে তরুণীদের সঙ্গে সান্নিধ্যের সুযোগ তাঁর হয়েছিল, ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অন্য ধাতুতে গড়া এই নারী তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁকে। প্রত্যাখ্যানের ভাষা ও আচরণ ছিল রীতিমতো কঠোর। এই আঘাত মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করেছিল কবিকে।
পরবর্তী সময়ে নজরুল তাঁর নির্বাচিত কবিতার সংকলন ‘সঞ্চিতা’ তাঁকে উৎসর্গ করার অনুমতি চেয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসার কাছে। সম্ভবত তাতেও আপত্তি ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন নজরুল।
উচ্চশিক্ষার জন্য ফজিলাতুন্নেসা ইংল্যান্ড চলে গেলে ধীরে ধীরে এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন কবি। তবে আঘাতে-অপমানে দীর্ণ দিনগুলো বিফলে যায়নি। আর যাই হোক, বাংলা সাহিত্য পেয়েছিল কিছু অবিস্মরণীয় গান ও কবিতা। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সংগীতে রূপান্তরিত করেছিলেন।
তাঁর লেখায় এভাবেই নজরুল নারীদের সমানাধিকার, নারীর প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ, প্রেয়সীর প্রেমের অনিবার্যতা ও মাতৃভক্তির পদতলে পরিপূর্ণতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন আর তারই ফসল নজরুলকে কবি নজরুল করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।